×

জাতীয়

কূটনীতির ১০ চ্যালেঞ্জ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ জানুয়ারি ২০২১, ০৯:৫০ এএম

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মূল ফোকাস

গেল বছর ভার্চুয়াল কূটনীতিতে পার করলেও নতুন বছরে অন্তত ১০টি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে বাংলাদেশকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চালুর জন্য মিয়ানমারের ওপর চাপ তৈরি করা, আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গা সংক্রান্ত মামলার বিষয়গুলো জোরদার তদারকি করা, ভারত ও চীনের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনের সঙ্গে তালমিলিয়ে কাজ করা, মুসলিম বিশ্বের টালমাটাল রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান পোক্ত করা, ভূরাজনৈতিক ইস্যুতে বাংলাদেশকে ঠিকঠাক জায়গায় রাখা, বিদেশি বিনিয়োগ আনা, বিদেশে বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা এবং করোনার ভ্যাকসিন কূটনীতিতে বাংলাদেশকে এগিয়ে রাখাই ২০২১-এর কূটনীতিতে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা। এছাড়া প্রতিবেশী নীতিকে এগিয়ে রেখে ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়গুলোর সমাধানেরও জন্য নতুন বছরের কূটনীতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে বলে ধারণা করছেন তারা। এসব বিষয় ছাড়াও নতুন বছরটি কূটনীতির জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই ২০২১-এ মুজিববর্ষের সমাপনী অনুষ্ঠান ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করবে বাংলাদেশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আঞ্চলিক রাজনীতিতে এশিয়ার দুই ‘সুপার পাওয়ার’- ভারত ও চীন যখন আধিপত্য বিস্তারে ব্যস্ত, তখন বেশ কৌশলেই উভয় দেশের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়তে পেরেছে বাংলাদেশ। তবে অমীমাংসিত বিষয়গুলো সমাধানে এগিয়ে যাওয়ার বছর হবে ২০২১। বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনার ধাক্কায় তছনছ বিশ্বের নতুন সংযোজন ‘করোনা কূটনীতি’। এছাড়া কূটনৈতিক অঙ্গনে নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে আসতে পারে অর্থনীতি কিংবা স্বাস্থ্য কূটনীতির মতো বিষয়গুলোও। তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু না হলেও তাদের একটি অংশ ভাসানচরে স্থানান্তরের মধ্য দিয়ে বছর শেষে আবারো কূটনৈতিক অঙ্গনে আলোচনায় আসে বাংলাদেশ। এ বিষয়ে নতুন বছরে বাংলাদেশ কিভাবে মোকাবিলা করবে- বিষয়টি এখন থেকেই বড় প্রশ্ন হয়ে উঠছে।

জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন নতুন বছরের কূটনীতিতে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের কথা জানিয়ে ভোরের কাগজকে বলেন, নতুন বছরে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে নতুন বছরে রোহিঙ্গা ইস্যুটি জিইয়ে রাখার জন্য বিভিন্ন দেশ শক্তি দেখাতে চাইবে। কারণ আমরা যত উন্নতি করব, রোহিঙ্গা ইস্যুতে যত পদক্ষেপ নেব ততই আমাদের শত্রু বাড়বে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে শত্রুর মোকাবিলা করাও একটি চ্যালেঞ্জ। একই সঙ্গে ভূরাজনৈতিক ইস্যুগুলোও মোকাবিলা করতে গিয়ে অনেক চাপ আসবে, আর এই চাপকে মোকাবিলা করাও একটি চ্যালেঞ্জ। চাপ আসবে মুসলমান দেশগুলো থেকেও। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি মুসলমান দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও চাপ আসবে। তবে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের একটি পলিসি রয়েছে। সেই পলিসি অনুযায়ীই বাংলাদেশ চলবে বলে তিনি জানান। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানো নিয়ে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ থাকবে। বিদেশে বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থান নিয়েও চ্যালেঞ্জ থাকবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশিরা যেসব দেশে থাকেন সেসব দেশে কোভিডের কারণে মন্দা যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে দেশগুলোতে বাংলাদেশিরা কতটুকু কর্মসংস্থান টিকিয়ে রাখতে পারবেন সেটা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। লেবাননের উদাহরণ টেনে মন্ত্রী বলেন, দেশটির আর্থিক অবস্থা খারাপ। অথচ ওই দেশে প্রচুর বাংলাদেশি কাজ করেন। তিনি সৌদি আরবের কথা তুলে ধরে বলেন, দেশটিতে তেলের দাম পড়ছে। ফলে সেখানকার পরিস্থিতিও ভালো নয়। অথচ ওই দেশে প্রচুর বাংলাদেশি কাজ করেন। পরিস্থিতি ভালো না হলে কর্মরত বাংলাদেশিরা বেকার হয়ে যেতে পারেন। সেটিও একধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। মালদ্বীপ ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের কথা জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, দেশ দুটি পর্যটননির্ভর। কিন্তু কোভিডের কারণে সেখানে পর্যটন ব্যবসা বন্ধ রয়েছে। অথচ দেশ দুটিতে প্রচুর বাংলাদেশি কাজ করেন। পয়সা না থাকলে সেখানেও কাজ হারাতে পারেন বাংলাদেশিরা। সবমিলিয়ে চ্যালেঞ্জ থাকলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আশাহত নন জানিয়ে বলেন, নেত্রী (শেখ হাসিনা) দৃঢ়চিত্ত। নিশানা ঠিক। দেশবাসীর সমর্থন নিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ব এবং সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করব।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি দেশের কূটনৈতিক সাফল্য সংখ্যাগত দিক থেকে পরিমাপ করা কঠিন। এর সঠিক কোনো সূত্র বা যন্ত্রও নেই। একটি দেশের নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গে সেই দেশ সম্পর্কে যে ছবি ভেসে ওঠে কূটনৈতিক সাফল্যের বিচারে সেটাই বড় বিষয়। স্বাধীনতার পর দরিদ্র জাতি হিসেবে বাংলাদেশকে বিশ্ব চিনত। এখন চেনে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, পদ্মা সেতু, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট, মেট্রো রেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে। তাছাড়া জাতিসংঘের বিভিন্ন নির্বাচনে বাংলাদেশের বিজয় বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। তারা বলছেন, সুষম ভারসাম্য বজায় রেখে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের কূটনীতি সমানভাবে এগিয়ে চলছে। প্রয়োজন অনুসারে কোথাও দ্বিপক্ষীয় কূটনীতির মাধ্যমে কখনো বহুপক্ষীয় কূটনীতি প্রয়োগ করে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণ করে বিশ্বের বাংলাদেশের ইতিবাচক কূটনীতি তুলে ধরা হচ্ছে।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হক জানান, এই এক বছরের কূটনীতি স্থিতিশীল ছিল। বছরের শুরুর দিকে কূটনীতির যে সব উদ্দেশ্য ছিল তা সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকে অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সব চ্যালেঞ্জের মধ্যে নতুন বছরে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মিয়ানমারের ওপর চাপ তৈরি করে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে পাঠানো। রোহিঙ্গা সংকট শুরুর এক মাসের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে দেয়া ভাষণে সংকট সমাধানের জন্য পাঁচটি সুপারিশ তুলে ধরেছিলেন। একই সঙ্গে সংকট সমাধানের জন্য বিশে^র গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলোর সমর্থন লাভের চেষ্টাও করে বাংলাদেশ। সবমিলিয়ে বাংলাদেশের কূটনীতির বড় প্রচেষ্টা ছিল মিয়ানমারের ওপর চাপ তৈরি করা। একপর্যায়ে রোহিঙ্গা সংকট শুরুর তিন মাসের মধ্যে মিয়ানমারের সঙ্গে প্রত্যাবাসন সমঝোতা করে বাংলাদেশ। কিন্তু প্রত্যাবাসনের বিষয়ে এখনো কোনো অগ্রগতি হয়নি। তাছাড়া এ সমঝোতার মাধ্যমে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখিয়েছে যে সংকট সমাধানের জন্য তারা কাজ করছে, যদিও সমঝোতা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। কূটনীতির জন্য রোহিঙ্গা সংকট সত্যিই একটি বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ভারত এবং চীনকে বাংলাদেশ বন্ধু হিসেবেই বিবেচনা করে। কিন্তু সে বন্ধুত্বও রোহিঙ্গা ফেরাতে খুব একটা কাজে লাগেনি এখনো। এ জন্য রোহিঙ্গা ইস্যুতে এ দুটি দেশকে বাংলাদেশের পক্ষে আনা কূটনীতির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। যদিও সরকার মনে করেন ভারত ও চীন এ সংকট সমাধানের জন্য কাজ করছে। তবে তারা এও বলছেন, বছরজুড়ে কূটনৈতিক অঙ্গনে আলোচনায় থাকা এশিয়ার সুপার দুই পাওয়ার ভারত ও চীনের এমন মুখোমুখি অবস্থায়ও বাংলাদেশ সবার সঙ্গেই খুব ভালো সম্পর্ক রাখতে পেরেছে।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান ভোরের কাগজকে বলেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো, মিয়ানমারকে বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে চাপ সৃষ্টি করা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে নয়া মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করা, মিয়ানমারের প্রতি চীনের যে নীতি সেখান থেকে তাকে ফিরিয়ে আনার মতো বিষয়গুলোই হচ্ছে ২০২১-এর কূটনীতিতে কড় চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে চীনের পূর্ণ সমর্থন আদায় করার বিষয়টি বড়। কারণ চীন বাংলাদেশকে এক কথা বলছে আবার মিয়ানমারকেও সহযোগিতা করছে। চীন সত্যিই সত্যিই রোহিঙ্গা ফেরত পাঠাতে চায় কিনাÑ সেটা বাংলাদেশের জানতে হবে। এক্ষেত্রে ভারতও কতটুকু কূটনীতিক চাপ প্রয়োগ করবে সেটিও দেখা উচিত। তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের নৈকট্য রয়েছে। তবে এটাকে আরো সুসংহত করা প্রয়োজন। এছাড়া মুসলিম বিশে^ ভারসাম্য কূটনীতি প্রয়োগ করাকেও চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন এই অধ্যাপক। এদিকে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং দেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন উপলক্ষে আগামী ১৭ থেকে ২৬ মার্চ পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের নিয়ে এক বড় উৎসব পালনের পরিকল্পনা করেছে বাংলাদেশ সরকার। বিদায়ী বছরে সরকার বেশ কিছু বড় কর্মসূচির পরিকল্পনা করলেও করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির কারণে সব বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। মার্চের নির্ধারিত ওই ১০ দিনের মধ্যে যারা বাংলাদেশ সফরের বিষয়টি প্রায় নিশ্চিত করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন- ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান, মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম মোহামেদ সোলিহ, নেপালের প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভান্ডারি এবং ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং।

স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ আগামী বছর বিশ^ শান্তি সম্মেলনের আয়োজন করবে জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেছেন, আমরা একটি উপযুক্ত তারিখ খুঁজে বের করার জন্য কাজ করছি এবং এটি হবে বিশে^র সব শান্তিপ্রেমীর সমাবেশ। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে বহির্বিশ্বের ভুল ধারণা পুরোপুরি পরিবর্তন করতে চায় সরকার এবং বাংলাদেশ যে সম্ভাবনাময় অর্থনীতির দেশ সেটিও বিশ^কে জানাতে চায় ২০২১-এ।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, বিদায়ী ২০২০ সালে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সফলতা হলো ‘সৃজনশীল অর্থনীতির ক্ষেত্রে ইউনেস্কো-বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্তর্জাতিক পুরস্কার’ প্রবর্তন করা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App