×

সাময়িকী

হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২০, ১১:০২ পিএম

হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতা

কবিতা অনেক সময় জাগতিক যুক্তিকে অতিক্রম করে, এক রহস্যময়, অধরা ও দুরূহ ভাষাঅর্থ উপস্থাপন করে। একটি কবিতা থেকে সত্য উদ্ধারে পাঠকের যোগ্যতা ও কৃতী যে ভ‚মিকা নিয়ে উপস্থিত থাকে তার প্রস্তুতির আয়োজনে পাঠক কবিতার সত্যকে উপলব্ধি করতে পারে। কবিতা মূলত ভাষায় ভাবের প্রকাশ। বলা যায় কবিতায় শব্দকে চেঁছে নিয়ে সুঠাম করতে হয় অর্থের নতুন দ্যোতনা দিতে, ভাষ্যের পঙক্তিতে শব্দের আগপিছ, গঠনক্রিয়া, প্রত্যাশিত অর্থসংযোজনায় প্রয়োজনীয় শব্দের জোগান, যা অর্থকে ভিন্ন মাত্রা দেয়। যেমন কেউ বললেন ‘আমার এখন বাড়ি যাবার সময়’, সাধারণভাবে যে কেউ মনে করতে পারে বক্তা তার বাড়ি যাবার কথা বলছেন, কিন্তু অর্থদ্যোতনা লক্ষ করলে বোঝা যায় তিনি মৃত্যুর কথা বলছেন। এই অর্থ সচরাচর বা প্রাত্যহিক নয়, যদিও প্রচল শব্দেই এর গঠন কাঠামো। কাঠামোবাদী তত্তে¡ সকল সৃষ্টির মৌলিক একই এবং ভাষার হেরফেরে নতুন হয়ে ওঠে। শব্দের একমুখিতাও কাঠামোবাদী ক্রিয়ারই প্রকাশ যা কাব্যে অধিকই ব্যবহৃত হয় এবং এরকম জনপ্রিয় কবিতাও বিস্তর রয়েছে বা সৃষ্ট হচ্ছে প্রতিদিন। কিন্তু জনপ্রিয়তা আর সার্থক কবিতা শত প্রশ্নের এক উত্তরে নয়। যে শব্দ দ্যোতনার দিক থেকে সময়কে ধরতে পারে না বা গতির মুখে প্রতিস্থাপন করতে পারে না, গুণগ্রাহীকে সেগুলো গতানুগতিক, সেকালের এবং আধুনিকতা থেকে বিস্তরদূরবর্তী রাখে। বাস্তবে এরকম কবিতায় সমসাময়িকতা যুক্ত থাকে অতীতের রুচি অভ্যেসের সাথে যুক্ত হয়ে। সম্মিলিত সঙ্গতিতে আগামীর বোধবুদ্ধি, বিজ্ঞানচেতনার সংযুক্তির কোনো সংকেত থাকে না। কেবল পাঠ-আনন্দ ছাড়া এই কবিতায় আর কোনো অনুসন্ধান পাঠককে সমৃদ্ধ করে না, বরং কবিতা ও বিবৃতভাষা পরস্পর থেকে দূর বিন্দুতে লগ্ন হয়। দার্শনিক হাইডেগার তার নন্দনতত্তে¡ ‘কবিতা’ শব্দটির মূল্যায়ন করেছেন নতুনভাবে।

তিনি মনে করতেন ‘যে কোনো শুদ্ধ শিল্প সত্যের সন্ধান দিতে পারে। কবিতা-শিল্পের রূপ ও স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে হাইডেগার ওপেন (খোলামেলা) শব্দটির ওপর জোর দিয়েছেন কারণ সত্তার গহীনে যে গোপন তাকে উন্মোচন করাই হলো শিল্পের কাজ’। তার বক্তব্যানুসারে মানুষের সত্তার নিবাস হলো তার ভাষায়। মানুষ ভাষার রাজ্যে বসবাস করে এবং ভাষাই তার মনগঠনক্রিয়াকে প্রকাশঋদ্ধ করে। জীবনের সব কিছুই শব্দে গ্রথিত আর সে কারণে তার সৃষ্টিকে বুঝতে হলে সত্তার মর্মার্থকে অনুসন্ধানে নেয়ার প্রয়োজন। ফ্রয়েড মতে, মানুষের মন ভীষণভাবে গতিশীল এবং তাড়না, বিরোধ, বাসনা, অবদমন ইত্যাদির মতো ক্রিয়া দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আমাদের চারপাশের বাস্তবতাকে এসবের প্রেক্ষায় বিশ্লেষণ করে সৃষ্টির গহীনকে খানিকটা উপলব্ধিতে আনা সম্ভব। এই তত্ত¡ বিশ্লেষণ করে জ্যাক লাকাঁ যে ধারণা উপস্থিত করেছেন তা আমাদের বর্তমান চেতনাকাঠামো গ্রাহ্য এবং যৌক্তিক বলে মনে করেন তত্ত¡বিদরা। সিরাজীর কবিতা এইসব তত্ত¡কে বিস্তর উপাত্তে ধারণ করে স্বতন্ত্র মহিমায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। -আমাদের কাব্যাঙ্গনে ৬০ দশকের অন্যতম শক্তিমান কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী। যিনি, উত্তোরিত দক্ষতায় বাংলা কবিতায় ভিন্নমাত্রার রূপান্তর ঘটিয়ে এক ভাষাশব্দঘর তৈরি করতে পেরেছেন। তার কবিতায় এই ভাষা-ভাষ্য যা ঊর্ধ্বমুখী আর নিম্নমুখী প্রবণতাগুলোকে নতুন শিল্পমাত্রায় বিভাসিত করে। কান্ট যাকে বলেছেন ‘এ্যকাডেমিক্যালি ট্রেইন্ড’। তার কবিতায় বিষয় এবং শৈলী একেবারে পৃথক না হলেও অনেকখানি ভিন্নতর এখনও।

অন্তরবয়নের বাহিরবুনন এমনভাবে সন্নিহিত যে বাহির ও ভেতর কাঠামোকে যুক্ত করে প্রবেশ জরুরি এবং যুক্ত করা যায় অন্তরসুর- ঘটমানতার সঙ্গে। সপ্তদশ শতাব্দীতে নন্দন তাত্তি¡ক গবেষণার প্রসার ঘটতে থাকে। নতুন নতুন শব্দের ব্যবহার পুরাতন শব্দের নতুন অর্থ যোজনায় নতুন করে উপস্থাপনা এবং শিল্প বিষয়ে নানারকম সমালোচনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হতে থাকে। এই সময় রুচি, বুদ্ধি, কল্পনা, দুর্বার কল্পনা, অনুভ‚তিগুলোর গভীরতম বিশ্লেষণ শুরু হয়ে যায়। এবং তা শিল্পের নানা আলোচনায় ছড়িয়ে পড়ে। ‘পাদ্রী মুরাটোরি’ যে কল্পনার কথা বলেছেন তা পুরোপুরি ইন্দ্রিয়জ। তার মতে বল্গাহীন কল্পনা যদি প্রজ্ঞার (ইনটেলেক্ট) নিয়ন্ত্রণহীন হয় তা হলে তার পরিণতি হবে ভয়াবহ। দেকার্ত এ্যলিগরি বা রূপকে সাগ্রহ সমর্থন জানিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন যুক্তিবাদের প্রবক্তা। দেকার্তপন্থিরা আইডিয়া বা ভাবভাবনায় পরিবতর্নযোগ্য ধারণার উপর নির্ভরশীল ছিলেন। ইতালীয় লেখক ‘কন্টির’ মত ছিল ‘কবিদের সব কিছুই চিত্রকল্পের (ইমেজ) মাধ্যমে বলা উচিত।’ এভাবেই কবিরা সমাজে কখনও হয়েছেন রূপবিলাসী, কখনও তিমির হনন প্রত্যাশী, কখনও বিমূর্ত ভাবধারায় নিমজ্জমান ভাবনা বিলাসী এবং কখনও নৈতিকতার শুদ্ধস্বর।

দুই. ভেঙে পড়তে পড়তে যতো টানাপোড়েন বলি / চূর্ণ হতে হতে যতো মিশ মাটি/ দম হারাতে হারাতে যতো অতল জল/ পাতালে অবিরাম আগুনের কোলাহল/ যুদ্ধ একার সঙ্গে ছায়া/ ঘৃণাও একাই করতে হয়/ তারও পথে হাওয়া/ অহংকারের জন্য একজন প্রতিদ্ব›দ্বী চাই (প্রতিদ্ব›দ্বী) -কবিতা কি, কেন এতোকাল ধরে কবিতা মানুষের কাছে সমান আদৃত হয়ে আসতে পারলো? ‘ভেঙে পড়তে পড়তে’ আবার দাঁড়িয়ে যাওয়া কতভাবে তার শরীর গড়লো, কতো তত্তে¡ হয়ে উঠলো ধরা/অধরা এবং তারপরও তার গভীরে থাকলো সেই শক্তি যে আগুন; ‘সৃষ্টি শক্তি’ উত্তাপ ভালোবাসায়/ঘৃণা। কেন কবিতা আপন মহিমায় নানা চড়াই-উৎরাই পার হয়ে সমকালেও সমান মর্যাদায় দাঁড়িয়ে থাকল কারণ তার আগুন আছে, শক্তপোক্ত পা আছে। কেন কবিতা হয়ে উঠল এক বাণী যা ধ্বনিত হলো দর্শন বিজ্ঞান সকল কলায়? আর তাই নিয়ে গড়ে উঠলো নানা চিন্তা চেতন/অবচেতন নিশ্চেতনার জিজ্ঞাসা? কখনো জুটলো রাজরোষ কখনো অবহেলা আবার দিশা যা সকল বৈরী দেয়াল ভেঙে মনোভ‚মিকে উর্বর করে প্রতিদিন। কবিতা একটি শিল্প, শিল্প তাই, যা আনন্দ দেয় মনকে আহ্লাদিত করে, জীবন বীক্ষণের উন্মিলিত চক্ষে দেখে দৃশ্য আলো/ছায়া প্রতিচ্ছায়া যা বস্তু’র নব্যরূপ যা ঠিক ঠিক বস্তু নয়। তবু মনের সন্ধিতে নতুন ভাবকল্প ছড়িয়ে দেয় স্নিগ্ধ আকাশের মতো। কডওয়েল বলেছেন, ‘শিল্প সংগ্রামের মধ্য থেকে জন্ম নেয়; কারণ সমাজে অলীককল্পনা ও বাস্তবের মধ্যে একটা সংঘাত থাকে। এটা স্নায়ুরোগীর সংঘাত নয়, সামাজিক সমস্যা এবং সমাজের হয়ে শিল্পী তার সমাধান খোঁজেন। কবি সামাজিক ভ‚মিকা পালন করেন’ মনোসমীক্ষকরা কবিকে স্নায়ুরোগী ভাবেন। কোনো শিল্পকর্মের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মনঃসমীক্ষক সেই কারণে সেই প্রতীকগুলোরই সন্ধান করেন যেগুলো বিশিষ্টভাবে ব্যক্তিগত অর্থাৎ নিউরোটিক। [ইল্যুয়েশন এন্ড রিয়ালিটি] সত্য এই যে আলোচকরা সৃষ্টির স্রষ্টাকে বস্তু বিচ্যুত করে তার ভাবনার পাখাকে ভিত্তি করে বলেই তারা ভুলে যান কবি সামাজিক মানুষ, সংবেদন সঞ্চারণশীল বলেই পারিপার্শি¦কতার বিষয়-আসয় থেকে সংবেদনের উপকরণগুলো পেয়ে যান এবং প্রকাশমুখী করেন ভাবনায়। টলেস্টয় শিল্পের ব্যাপকতার পক্ষে তার ‘শিল্প কী’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, তিনি শিল্পের বহুর গ্রহণযোগ্যতাকে সমর্থন করেছেন। রবীন্দ্রনাথ শিল্পের সুন্দরকেই সমর্থন করেছেন এবং শিল্প উদ্দেশ্যপূর্ণ হওয়া উচিত নয় এমন মতে বলেছেন ‘উদ্দেশ্যর শিল্প নয়, শিল্পই শিল্পের উদ্দেশ্য’, জীবনানন্দও এই মতের সমর্থক হয়ে সৃষ্টিতে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং বহুর স্থান সংকুলান করেছেন [আর তাতেই প্রমাণিত শিল্পের উদ্দেশ্য শিল্প নয়, বরং সামাজিক প্রেরণাই সামাজিক উদ্দেশ্যে শিল্পের সৃষ্টি] তাহলে এইসব মতগুলো ভিন্নমতে ক্ষয়ে যাচ্ছে এবং যেহেতু এর ভোক্তা মানুষ, সমাজ তাই শেষতক মানুষের, অনুভ‚তি আকাক্সক্ষার বাইরে কেউ দাঁড়িয়ে নেই। ‘হাবীবুল্লাহ সিরাজী’ ব্যক্তিজীবনে একজন প্রকৌশলী, নির্মাণ দর্শনে তার যে ভিন্নতা থাকবে সে অনিবার্য। কবি ফরিদ আহমদ দুলাল সিরাজীর কবিতা আলোচনায় ‘পোস্টমর্ডান নির্মাণ কৌশলে’র উল্লেখ করছেন। যুক্তি হিসেবে সিরাজীর কবিতায় পোস্টমর্ডান কবিতার ছাপ আছে। তার কিছু কিছু কবিতায় লজিক্যাল ক্রাকডাউন আছে, বাস্তবতায় সন্দেহ আছে, দিশা কেন্দ্রমুখী নয়, সাবটেক্সটগুলো খণ্ড খণ্ড পরস্পর বিচ্ছিন্ন। কবি মলয় রায়চৌধুরীসহ আরো অনেকে এবং আমাদের এখানেও এ বিষয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে কিছু কিছু নির্মাণ সেই ধাঁচে যে নেই তা নয়। সিরাজীর নির্মাণে এই তত্তে¡র প্রয়োগ নতুন কিছু ভাবনারও অবকাশ তৈরি হচ্ছে। আসলে এটা এমন নয় যে প্রাগআধুনিক/আধুনিক/অধুনান্তিকতা মানে আধুনিকতা এখন শেষ আর তার থেকে আরেকটি ধারা যা ‘অধুনান্তিকতা’ শুরু তেমন বলছেন কেউ কেউ। তারা বলছেন এ হচ্ছে আর একটি ধারা কারণ আধুনিকতা আর মানব সভ্যতার দাবি মেটাতে পারছে না। একটি কবিতা ‘লাল মৃত্যু’ মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে পেন্ডুলাম গির্জার ঘড়ির নিচে টিকটিকি থিকথিক অন্ধকার বড়োদিন মাথা তুলে বোঝে কতোখানি পাহারায় মানুষ’ ‘পেন্ডুলাম’ খাড়া দণ্ড যা দিয়ে অনুসন্ধানকারী অনুসন্ধান করে ভূগর্ভস্থ পানি, খনিজ বা প্রয়োজনীয়, যা দোলক ঘড়ির সময় কাঁটা ঘূর্ণনে সময়ের দিকের সে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে। অর্থাৎ সভ্যতার শেষ ধাপ এখন সে উপরের দিকে নয়তো নিচে। এখানে লজিক্যাল ক্রাকডাউন। যে সময়ের সন্ধিস্থলে দাঁড়িয়ে নির্ধারণ করছে তার পরবর্তী স্টেপ সেও মাকড়শা বা টিকটিকি হয়ে ওঠা এবং থিক থিকে অন্ধকার ভেদ করে ‘বড়দিন’ যার জাগরণ ঘটছে সে অনুভব করছে মানুষের জনগণের সজাগতা যা যুক্ত পরিকল্পনায় একবিশ্ব নীতির মোড়কে বা দুর্বিত্তের পরিকল্পনা নকশার বিস্তারে। এইভাবে এক প্রকাশবাদী নির্মাণ কৌশলে তার এই কবিতাগুলো টুকরো টুকরো (প্রকাশবাদী রূপ পেয়েছে) অখণ্ড হয়ে নানা দৃশ্য একইরূপ এবং বিপরীত; বিপ্রতীপ আবার পরিপূরকতা নিয়ে গ্রথিত। তার কবিতায় পূর্ণমাত্রায় আধুনিতার লক্ষণের একটা ভোজবাজি আছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App