×

জাতীয়

বছরের আলোচিত দশ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২০, ০৯:৫৩ এএম

বছরের আলোচিত দশ

শিক্ষায় হ-য-ব-র-ল

অভিজিৎ ভট্টাচার্য্য : করোনা ভাইরাস দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে তছনছ করে দিয়েছে। বিদায়ী বছরের ১০ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষার এই হযবরল অবস্থা ছিল ২০২০ সালের অন্যতম আলোচিত ঘটনা। উল্লিখিত এই সময়ে বাতিল করতে হয়েছে প্রাথমিক থেকে বিশ^বিদ্যালয় পর্যন্ত বহু পরীক্ষা। দিতে হয়েছে অটোপাস। বিশ^বিদ্যালয়ে বেড়েছে সেশনজট। বেড়েছে চাকরি প্রত্যাশীদের হতাশাও। নতুন বছরে এই ক্ষতি কিভাবে পুষিয়ে নেয়া হবে এটাই এখন শিক্ষা প্রশাসনের চিন্তা। করোনায় থাবায় সেই মার্চে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছিল এবং এই বন্ধ এত দীর্ঘ হবে তা কেউ ভাবতেও পারেননি। শিক্ষা খাতে এমন অচলাবস্থা ১৯৭১ সালের পর কখনো দেখেনি দেশের মানুষ। ১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধের জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। আর ২০২০-এ এসে করোনার থাবা। পরিস্থিতির ভয়াবহতার কারণে শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলতে চায়নি সরকারও। তবে ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নিতে সংসদ টিভি ও অনলাইনে ক্লাস পরীক্ষা নেয়া হয়। বছর শেষে এসে মূল্যায়নের নামে করা হয় এসাইনমেন্টের ব্যবস্থা। কিন্তু তাতেও খুব বেশি লাভ হয়নি। তবুও শিক্ষার্থীদের অটো পাস দিয়ে উপরের শ্রেণিতে তুলে দেয়া হয়। করোনা মহামারির শিকার সর্বস্তরের ক্ষতির শিকার চার কোটির বেশি শিক্ষার্থী। বিশেষ করে শিক্ষাজীবনের শেষস্তরে থাকা চাকরি প্রত্যাশীদের দিন কাটছে চরম হতাশায়। বহু শিক্ষার্থী করোনার প্রভাবে আর সরকারি চাকরিতে আবেদনই করতে পারবেন না। বয়স শেষ। করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবাই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় ঢাকা ছেড়েছেন অনেকেই। আবার পেশা বদলাতে বাধ্য হয়েছেন কোনো কোনো শিক্ষক। স্কুল বিক্রির ঘটনাও ঘটেছে। ক্লাস-পরীক্ষা না হলেও ষোলআনাই ফি আদায় করেছে বহু প্রতিষ্ঠান। সুখবর নেই নতুন বছরেও। ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত বন্ধই থাকছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। হচ্ছে না এবারের বই উৎসবও। এসবের মধ্যেই প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে নতুন বছরের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার। প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে মেডিকেল ও বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিচ্ছুদের। করোনা মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে এলে মার্চ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম স্বাভাবিক হতে পারে। তবে এ বছর শিক্ষায় যে ক্ষতি হলো তা পুষিয়ে নিতে ব্যাপক পরিকল্পনা নিতে পরামর্শ দিচ্ছেন শিক্ষা গবেষকরা। শিক্ষা বিশ্লেষক ও গণসাক্ষরতা অভিযানের প্রধান নির্বাহী রাশেদা কে চৌধুরী বলেছেন, আমরা বড় বড় ভবন, কালভার্ট পরবর্তীতেও বানাতে পারব। কিন্তু শিক্ষায় যদি কোনো প্রজন্মের ক্ষতি হয় সেই ক্ষতি যত দ্রুত সম্ভব পুষিয়ে নিতে হবে।

করোনা ভ্যাকসিন

রাশেদ আলী : করোনাকালের সবচেয়ে আলোচিত শব্দগুলোর মধ্যে একটি ভ্যাকসিন। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও ‘ভ্যাকসিন দুশ্চিন্তা’ সঙ্গে করেই পাড়ি দিয়েছে মহামারির বছর ২০২০। বছরের শেষ দিকে এসে করোনার কার্যকর ভ্যাকসিন বা টিকা আবিষ্কারের খবর শুনে কিছুটা স্বস্তি পান দেশের মানুষ। এই করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কারই বিদায়ী বছরের সবচেয়ে আলোচিত ও প্রত্যাশিত ঘটনা। তবে বাংলাদেশে কবে, কোথায়, কীভাবে টিকা মিলবে এসব নিয়ে এখনো উদ্বেগ রয়েছে। ভ্যাকসিন সংগ্রহে সরকারের পদক্ষেপ নিয়ে বিদায়ী বছরে আলোচনা-সমালোচনা ছিল প্রবল। দেশের ৮০ শতাংশ বা ১৩ কোটি ৮২ লাখ ৪৭ হাজার ৫০৮ মানুষকে টিকা দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। সে অনুযায়ী প্রায় ২৭ কোটি ৬৫ লাখ টিকা প্রয়োজন। তবে এ পর্যন্ত বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের মাধ্যমে ৩ কোটি টিকা আনার চুক্তি হয়েছে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও অ্যাস্ট্রাজেনকা ভারতে এসব টিকা তৈরি করছে। নতুন বছরের শুরুর দিকে ৫০ লাখ টিকা আসার কথা দেশে। আর গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস এন্ড ইমিউনাইজেশনস (গ্যাভি) ৬ কোটি ৮০ লাখ ডোজ টিকা দেয়ার আশ্বাস দিয়েছে বাংলাদেশকে। এ খাতে সরকার প্রাথমিকভাবে বরাদ্দ রেখেছে দেড় হাজার কোটি টাকা। আরো সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণের চেষ্টা চলছে। অন্যের ফর্মুলায় টিকা তৈরির প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছে দেশের প্রথম সারির ওষুধ কোম্পানিগুলো। টিকা তৈরি প্রচেষ্টায় গেল বছর কয়েক হাজার প্রতিষ্ঠান সফলতার মুখ না দেখলেও ৫৬টি প্রতিষ্ঠান ক্লিনিক্যাল ডেভেলপমেন্ট পর্যায়ে আসে। রাশিয়ায় স্পুৎনিক-ভি, মার্কিন কোম্পানি ফাইজার, মর্ডানা, জার্মানের বায়োএনটেক, চীনের সিনোভ্যাকসহ কয়েক প্রতিষ্ঠানের টিকা এর মধ্যে অনুমোদন পেয়েছে। এরই মধ্যে হঠাৎ আলোচনায় চলে আসে বাংলাদেশের কোম্পানি গ্লোব বায়েটেকের নাম। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের কাছাকাছি আসার দাবি করে তারা। গেল বছর গেøাবের ভ্যাকসিন আলোর মুখ দেখেনি। তবে এখনো আশাবাদী দেশের মানুষ। যেন নিজের দেশে টিকা বানানোর স্বপ্ন নিয়ে দুঃসময়ের দিনগুলো জয় করতে চায় বাংলাদেশ।

ঘাতক ভাইরাস

সেবিকা দেবনাথ : মধ্য চীনের উহান শহর থেকে বিশ্ব তোলপাড় করা রহস্যময় এক ভাইরাসের সূচনা হয়। ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর এই শহরে নিউমোনিয়ার মতো একটি রোগ ছড়াতে দেখে প্রথম চীনের কর্তৃপক্ষ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে (ডব্লিউএইচও) সতর্ক করে। এরপর ২০২০ সালের ১১ জানুয়ারি এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রথম একজনের মৃত্যু হয়। ওই দিনই সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ডবিøউএইচওর কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে নতুন এই ভাইরাসের নাম দেয়া হয় কোভিড (সিওভিআইডি)-১৯। ‘সিও’ দিয়ে করোনা, ‘ভিআই’ দিয়ে ভাইরাস, ‘ডি’ দিয়ে ডিজিজ বা রোগ এবং ১৯ দিয়ে ২০১৯ সালকে নির্দেশ করা হয়েছে বলে জানানো হয়। ডব্লিউএইচও এই মহামারিকে ‘সন্ত্রাসবাদী আক্রমণের চেয়েও বেশি শক্তিশালী’ বলে আখ্যায়িত করে। ২০২০ সালে ২৩ জানুয়ারি একে জনস্বাস্থ্যের জন্য জরুরি অবস্থা বলে ঘোষণা করে জাতিসংঘের অন্তর্ভুক্ত এই সংস্থা। এদিকে সংক্রমণ শুরুর পরপরই নতুন এই ভাইরাসের উৎপত্তি স্থল নিয়ে শুরু হয় নানা বিতর্ক। পশ্চিমা সরকার ও গণমাধ্যমগুলো দাবি করে প্রথম ধরা পড়া চীনের উহান থেকেই ছড়িয়ে পড়ে নতুন এই ভাইরাস। কেউ দাবি করে চীনের ল্যাব থেকে ছড়িয়েছে। আবার পশ্চিমা বিরোধীরা দাবি করে মার্কিন সেনারা এই ভাইরাস ছড়িয়েছে। এসব বিতর্ককে উড়িয়ে দিয়ে ২১ এপ্রিল ডব্লিউএইচও নিশ্চিত করে জৈব গবেষণাগার নয়; প্রাণী থেকেই এই ভাইরাস মানুষে ছড়িয়েছে। এই ভাইরাস বাদুড় থেকেই বিস্তার লাভ করেছে। নতুন এই ভাইরাসের এতটাই বিচিত্র ছিল, বিজ্ঞানী ও গবেষকদের কিছুক্ষণ আগে করা বক্তব্যকেও পরমুহূর্তেই বদলাতে হয়েছে। তবে বিজ্ঞানীরা জানান, করোনা ভাইরাস একজন মানুষের দেহ থেকে আরেকজন মানুষের দেহে অত্যন্ত দ্রæত গতিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। করোনা ভাইরাসের অনেক রকম প্রজাতি আছে, কিন্তু এর মধ্যে মাত্র ৭টি মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে। সংক্রমিত ব্যক্তির স্পর্শ এড়িয়ে চলা, হাঁচি-কাশি শিষ্টাচার মেনে চলা, সাবান পানি দিয়ে বারবার হাত ধোয়া, হাত দিয়ে নাক-মুখ স্পর্শ না করা, ঘরের বাইরে গেলে মুখোশ পরার পরামর্শ দেন তারা। সংক্রমণ ঠেকাতে অনেক দেশই লকডাউন কার্যকর করে। বন্ধ করে দেয় এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের বিমানসহ বিভিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা। ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্তের ঘোষণা আসে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওই দিন জানায় তিন জনের করোনা ভাইরাস সংক্রমণ শনাক্তের খবর। যাদের দুইজন ইটালিফেরত এবং তাদের একজনের মাধ্যমে আরেক নারী আক্রান্ত হয়েছেন। এরপর প্রতিদিনই বাড়তে থাকে আক্রান্তের সংখ্যা। আর ১৯ মার্চ সত্তরোর্ধ্ব এক ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর খবর আসে সরকারের পক্ষ থেকে। করোনার কারণে থমকে যায় পুরো বিশ্ব। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। মুজিব শতবর্ষের অনুষ্ঠান বাতিল ও বন্ধ করা হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বিদেশফেরতদের ১৪ দিন বাধ্যতামূলক হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশ, জনগণের ওপর জারি করা হয় বিধিনিষেধ। বিভিন্ন এলাকায় দেয়া হয় লকডাউন। যদিও তা খুব একটা কার্যকর হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় সব ধরনের ব্যবস্থা রয়েছে বলে দাবি করা হলেও পরবর্তী সময়ে তার মিল পাওয়া যায়নি। রোগ শনাক্তে অপর্যাপ্ততা, হাসপাতালে চিকিৎসা কর্মীদের নিরাপত্তার জন্য জরুরি ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই) সংকটসহ নানা অনিয়ম সামনে আসে। পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে স্বাস্থ্যসেবার পরিধি বাড়ানো হয়।

মুজিব জন্মশতবর্ষ

ঝর্ণা মনি : মুজিব মানেই বাংলাদেশ। দারিদ্র্যমুক্ত-অসাম্প্রদায়িক-সমৃদ্ধ-আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্রের মঙ্গলবারতা। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট কালরাত্রিতে ঘাতকের নির্মম বুলেটে জীবন থেমে গেলেও বঙ্গবন্ধু আজ শতাব্দীর মহাপুরুষ। বিদায়ী ২০২০ সাল ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শততম জন্মবর্ষ। এ কারণে বছরটিকে মুজিববর্ষ হিসেবে পালন করছে জাতি। মুজিব জন্মশতবর্ষে বিশ্বব্যাপী সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ব্যাপক কর্মযজ্ঞের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল। বর্ণাঢ্য উদ্বোধনের সবচেয়ে বড় আয়োজন ছিল রাজধানীর জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে। আমন্ত্রিত ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ বিশ্বনেতারা। জমকালো আয়োজনে জন্মশতবর্ষে পিতার প্রতি সম্মান জানানোর সব প্রস্তুতি নেয়া হলেও দেশের প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী ধরা পড়ার পরই বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে বাতিল করা হয় আয়োজন। ডিজিটাল মাধ্যমে পালন করা হয় অনুষ্ঠান। সীমিত করা হয় বিশ্বজুড়ে মুজিববর্ষের কর্মযজ্ঞ। করোনার কারণে সময় বাড়িয়ে স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তীর সঙ্গে যুগপৎভাবে আগামী ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত উদযাপিত হবে মুজিববর্ষ। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নপূরণের শপথ নেবে জাতি। বাংলাদেশকে আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন দেখতেন জাতির পিতা। বাংলার মানুষের মুক্তি আর উন্নতিই ছিল তার আজীবনের সাধনা। বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির শিখরে দেয়ার মাধ্যমে তার প্রতি সম্মান জানানো সম্ভব। সরকারের পরিকল্পনাও তাই। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের পথ ধরেই এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। মুজিববর্ষ এমন এক শুভক্ষণে যখন বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার হাতে দেশের নেতৃত্ব। পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে যিনি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন দেশকে। উন্নয়নের পথ দেখাচ্ছেন জাতিকে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়নসহ মানব উন্নয়নে বিশ্বে রোল মডেল বাংলাদেশ। উন্নয়নের মহাসড়কে দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা। বেড়েছে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার। নিশ্চিত হয়েছে মৌলিক মানবাধিকার। দারিদ্র্যপীড়িত বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। স্বপ্নডানায় ভর করে এগিয়ে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ আর খুব বেশি দূরে নয়। রূপকল্প-২০২১, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, স্বাক্ষরতায় শতভাগ অর্জন, তৃণমূলে নাগরিকসেবা পৌঁছে দেয়া, স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন, অবকাঠামো নির্মাণ, মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে উন্নয়নে নজর সরকারের। হৃদয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ গড়ার প্রত্যয়।

স্বপ্নের পদ্মা সেতু

দেব দুলাল মিত্র : গত ১০ ডিসেম্বর স্বপ্ন স্পর্শ করেছে বাংলাদেশ। সেদিন মূলসেতুতে ৪১তম স্প্যান বসানোর সঙ্গে সঙ্গে পুরোপুরি দৃশ্যমান হয় পদ্মা সেতু। বিদায়ী বছরে পদ্মা সেতুর কাজের এই অগ্রগতি বাঙালির জাতীয় জীবনে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। পদ্মা সেতুর কাজ বাকি আছে আর ১০ ভাগ। সেতুতে রোড ও রেল স্ল্যাব বসানোর কাজ চলছে। আগামী বছরের জুনের মধ্যে স্প্যান বসানোর কাজ শেষ হবে। পদ্মা সেতুর ২২ মিটার চওড়া ও ৪ লেনের সড়কের জন্য ২৯১৭টি রোডওয়ে স্ল্রাবের মধ্যে সহস্রাধিক বসানো হয়েছে। প্রতিদিনই বসছে রেল স্ল্যাব। ইউরোপের লুক্সেমবার্গ থেকে আনা লোহার স্টিঙ্গারে রেললাইন নির্মিত হবে। দুইতলা সেতুর উপর দিয়ে ঢাকা-যশোর ট্রেন চলবে। ২৯৫৯টি রেলওয়ে স্ল্যবের মধ্যে ইতোমধ্যে দুই সহস্রাধিক স্প্যান বসানো হয়েছে। আগামী এক বছরের মধ্যেই সেতুর কাজ পুরোপুরি শেষ করার টার্গেট নিয়েছে সেতু বিভাগ। ১৯৯৮ সালে পদ্মা সেতুর প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই হয়। সমীক্ষার পর ২০০৪ সালে মাওয়া-জাজিরা প্রান্তে পদ্মা সেতু নির্মাণের পরামর্শ দেয় জাইকা। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে পদ্মা সেতু নির্মাণে ২০০১ সালের ৪ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০০৭ সালে একনেকে পাস হওয়া পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। ২০১১ সালে ব্যয় বেড়ে হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে দ্বিতীয় দফা সংশোধনের পর ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। পরবর্তী সময়ে প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন না করে ২০১৮ সালের জুনে আবারো ব্যয় বেড়ে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। বিশ্বব্যাংকসহ দাতারা সরে দাঁড়ালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। ২০১৪ সালে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু করে চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি (এমবিইসি) ও সিনো হাইড্রো করপোরেশন। পদ্মা সেতুর ৩টি বিশ্ব রেকর্ড হলো সর্বোচ্চ ১২২ মিটার গভীরে স্টিলের পাইল বসানো, ভ‚মিকম্প থেকে সেতু রক্ষায় ১০ হাজার টন বিয়ারিংয়ের সক্ষমতা সম্পন্ন ‘ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং’ লাগানো ও নদীশাসনে চীনের ঠিকাদার সিনোহাইড্রো করপোরেশনের সঙ্গে ১১০ কোটি মার্কিন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর।

ইসরায়েলি চমক

মিলটন মোললা : গত অর্ধশতক জুড়ে আরব বিশ্বের ধনুর্ভঙ্গ প্রতিজ্ঞা ছিল, যতদিন ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা ও স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেবে না ইসরায়েল, ততদিন ‘অচ্ছুৎ’ হয়ে থাকতে হবে তাদের। কিন্তু চলতি বছর ডোনাল্ড ট্রাম্পের তথাকথিত ‘আব্রাহাম চুক্তির’ আবির্ভাবে ‘বড়’ ধরনের ফাটল দেখা গেছে তাদের সে প্রতিজ্ঞায়। মুসলিম-অধ্যুষিত চারটি আরব দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত, সুদান, মরক্কো ও বাইরাইন বন্ধুত্বের মালা পরিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় একঘরে হয়ে থাকা ইহুদি-অধ্যুষিত ইসরায়েলের গলায়। বৈশি^ক ক‚টনীতির অঙ্গনে ইসরায়েল-আরব গাঁটছড়া ছিল ২০২০ সালের সবচেয়ে বড় চমক। তবে পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ব্যতিক্রমী এ বন্ধুত্বের পেছনে দেশগুলোর মূল স্বার্থ হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রের চালান পাওয়া এবং ওয়াশিংটনের ক‚টনৈতিক সমর্থন লাভ। আপাতদৃষ্টে, বিগত নব্বই দশকের পর এটাই মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় বিজয়। পক্ষান্তরে, ফিলিস্তিনিদের সবচেয়ে বড় পরাজয়। কেননা, পশ্চিম তীর ও গাজায় ইহুদি আগ্রাসন এবং নিয়মিত ফিলিস্তিন নিধনের ঘটনা অব্যাহত থাকার পরও ফিলিস্তিনির রক্তে রঞ্জিত তেলআবিবের হাত ফিরিয়ে দিতে পারেনি এসব মুসলিম দেশ। লক্ষ্যণীয়, আশির দশকে মিসর এবং নব্বই দশকে জর্ডানের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হলেও মাত্র গত আগস্টে বন্ধু হওয়া আরব আমিরাতের সঙ্গেই এ মুহূর্তে ইসরায়েলের দহরম-মহরম দেখা যাচ্ছে সবচেয়ে বেশি। গত চার মাসে আবুধাবি সফর করেছেন হাজার হাজার ইসরায়েলি। উপরন্তু, এ মাসের শুরুতে ইসরায়েলের কট্টর-ইহুদি ফুটবল ক্লাবটির বড় অংশের মালিকানাও কিনে নিয়েছেন আমিরাতের রাজপরিবার। শুনতে অবাক লাগলেও, ফিলিস্তিনকে পাশ কাটিয়ে আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের এসব চুক্তির পেছনে মূল কলকাঠি নাড়ছেন কিন্তু একজন ফিলিস্তিনিই; তিনি গাজার সাবেক নিরাপত্তা প্রধান মোহাম্মাদ দাহলান। প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের বিরোধী শিবিরে অবস্থানকারী দাহলান প্রায় এক দশক আগে দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড থেকে বিতাড়িত হন। বর্তমানে থাকছেন আবু ধাবিতে, কাজ করছেন সে দেশের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের উপদেষ্টা হিসেবে। অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র প্রণীত ‘সন্ত্রাসী’ দেশের তালিকায় নাম ছিল সুদানের। কিছুদিন আগে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও সে দেশে গিয়ে বললেন, ইসরায়েলের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ো, কালো-তালিকা থেকে নাম কেটে দেয়া হবে। ফলে, তেলআবিবের বাড়িয়ে দেয়া বন্ধুত্বের হাতটি ফিরিয়ে দিয়ে নিজেকে বাঁচানোর কোনো পথই আসলে খোলা ছিল না যুগ যুগ ধরে দুর্ভিক্ষ, গৃহযুদ্ধ ও দারিদ্র্যপীড়িত মরুরাজ্য সুদানের।

মার্কিন নির্বাচন

ওয়াহেদুজ্জামান সরকার : করোনা মহামারির মধ্যেও চলতি বছর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ। শেষ পর্যন্ত রিপাবলিকান দলীয় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হারিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন। তার রানিংমেট কমলা হ্যারিস প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ও প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। অবশ্য পরাজিত হলেও এখন পর্যন্ত ডোনাল্ড ট্রাম্প হার স্বীকার করে নেননি। বরং ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে এখনো তিনি বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছেন। তবে আগামী ২০ জানুয়ারি ৭৭ বছর বয়সি জো বাইডেনই যে শপথ নিয়ে হোয়াইট হাউসে যাচ্ছেন তা এক রকম নিশ্চিত। যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিশংসনের মুখে পড়েও সিনেটের জোরে ক্ষমতায় বহাল থাকা ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরিণতি যে এমন হবে বছরের শুরুতেও তা মনে হয়নি। কিন্তু কোভিড-১৯ মোকাবিলায় ব্যর্থতা, যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে পুলিশি নির্যাতন ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন, শ্বেতাঙ্গদের আস্ফালন, মহামারির কারণে অর্থনীতির বেহাল দশা এসবই চার বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা এ রাজনীতিবিদের দম্ভ চূর্ণ করে দিয়েছে। নির্বাচনী প্রচার সমাবেশগুলোতে করোনা ভাইরাসজনিত সুরক্ষা না মানা, হোয়াইট হাউসে অস্থিরতা, প্রভাবশালী অনেক রিপাবলিকানের বিরোধিতাও ট্রাম্পের জন্য কাল হয়েছে। ৭৪ বছর বয়সি এ প্রেসিডেন্ট অবশ্য দায় চাপাচ্ছেন ‘ভোট কারচুপির’ ওপর। ভোট কারচুপি নিয়ে তিনি সর্বোচ্চ আদালতেও পর্যন্ত গেছেন। কিন্তু সেখান থেকেও তাকে খালি হাতে ফিরতে হয়েছে। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল নির্বাচন কমিশন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জালিয়াতির দাবি নাকচ করে দিয়েছে। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলছেন, তিনি ট্রাম্প আমলের উল্টোপাল্টা নীতি বদলে যুক্তরাষ্ট্রকে ফের বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে নিয়ে যাবেন। নারী, কৃষ্ণাঙ্গ, আদিবাসী ও ল্যাটিনোদের প্রাধান্য দিয়ে গঠিত তার প্রশাসনও যুক্তরাষ্ট্রের বহুত্ববাদ ও উদারনৈতিকতার পুরনো রূপে ফেরারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

ধর্ষণকাণ্ড

আজিজুর রহমান জিদনী : নোয়াখালীতে স্বামীকে বেঁধে রেখে গৃহবধূ, কুর্মিটোলা বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী ও সিলেট এমসি কলেজ হোস্টেলে নববধূকে ধর্ষণ। এমন নানা ধর্ষণকাণ্ডে আলোচনায় ছিল বছরজুড়েই। তবে সব কিছুকে ছাপিয়ে টক অফ দ্য কান্ট্রি ছিল রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে মৃত নারীদের ধর্ষণের ঘটনা। আর বিকৃত এ কাজটি করেছে তরুণ বয়সি মর্গের এক কর্মী। তবে এসবের মধ্যে স্বস্তির বিষয় ছিল ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) বিল-২০০০ বিল পাস। এরপরেই এ আইনে বিচার হয় বেশ কয়েকজনের। বছরের শুরুর দিকে গত ৫ জানুয়ারি ঢাবি এক ছাত্রী বান্ধবীর বাসা রাজধানীর শেওড়ার উদ্দেশে যাওয়ার সময় ভুলে কুর্মিটোলা বাসস্ট্যান্ডে নেমে যান। ফুটপাথ দিয়ে যাওয়ার সময় ধর্ষণের শিকার হন তিনি। এ নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হলে ধর্ষণের অভিযোগে র‌্যারের হাতে গ্রেপ্তার হয় মজনু নামে এক ভবঘুরে। পরে সে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করায় ছেলেমেয়েকে নিয়ে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের একলাশপুরে বাবার বাড়িতে থাকতেন এক নারী। ১০ বছর পর গত ২ সেপ্টেম্বর স্বামী তার কাছে এলে দেলোয়ার বাহিনীর ক্যাডাররা দরজা ভেঙে ওই নারীর ঘরে ঢোকে। এরপর তারা স্বামীকে পাশের রুমে বেঁধে রেখে ওই নারীকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করে। গত ৪ অক্টোবর সে ভিডিও ফেসবুকে প্রকাশ করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় ৯ জনকে আসামি করে মামলায় করা হয়। এদের মধ্যে ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। দেলোয়ার বাহিনীর প্রধান দেলোয়ার ওই নারীকে এর আগে নৌকায় ও বিভিন্ন স্থানে একাধিকার ফুসলিয়ে ধর্ষণ করেছিল বলেও জানা যায়। গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে সিলেটের টিলাগড় এলাকায় মুরারি চাঁদ কলেজ (এমসি) স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে যাওয়া এক নববধূকে ক্যাম্পাস থেকে তুলে ছাত্রাবাসে নিয়ে কয়েকজন দল বেঁধে ধর্ষণ করে। ঘটনার পরদিন তার স্বামী শাহপরাণ থানায় ছাত্রলীগ কর্মী সাইফুর রহমানকে প্রধান আসামি করে ৬ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরো ২-৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। গ্রেপ্তার ৮ আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব বলছে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ৫৪৬ নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ৩১১ জনকে ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। ধর্ষণের শিকার ৫১ জন মারা যান আর আত্মহত্যার পথ বেছে নেন ১৪ জন। তবে সব ঘটনাকে ছাপিয়ে যায় গত ১৯ নভেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গ থেকে মুন্না (২০) নামের এক ডোম সহকারীকে গ্রেপ্তারের পর। মুন্না প্রায় ৩ বছর ধরে মর্গে মৃত তরুণীদের লাশ ধর্ষণ করেছে বলে জানায় সিআইডি। মৃত নারীদের মধ্যে যাদের বয়স ১৫-২০ বছর তাদের টার্গেট করত ডোম মুন্না। তবে এসবের মধ্যে স্বস্তির বিষয় ছিল ১৭ নভেম্বর ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে বিল পাস। পরে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে আইন কার্যকরের পরই বিচারে অনেকের শাস্তি হয়।

ভাস্কর্য বিতর্ক

মুহাম্মদ রুহুল আমিন : ‘ভাস্কর্য’ শিল্পকলার একটি প্রাচীনতম মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব দেশেই ভাস্কর্য নির্মাণ ও স্থাপন হয়ে আসছে হাজার বছর ধরে। শিল্পমাধ্যম হিসেবে ভাস্কর্যের সঙ্গে ইসলাম ধর্মের কোনো সংঘাত না থাকলেও একটি মৌলবাদী চক্রের রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের কারণে বছরের শেষে এসে ‘ভাস্কর্য বিতর্কে’ পড়ে দেশ। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করে কয়েকটি ইসলামপন্থি সংগঠন। পাল্টা হিসেবে মাঠে নামে প্রগতিশীলরা। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়ে উত্তাপ। এর প্রধান বিরোধিতাকারী হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক ও আমির জুনাইদ বাবুনগরীর বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ প্রগতিশীলরা। ক্ষোভ প্রকাশ করা হয় নানা মহল থেকে। সব মিলিয়ে ভাস্কর্য বিতর্ক ছিল বিদায়ী বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা। মূলত রাজধানীর ধোলাইপাড় চত্বরে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হচ্ছে। ১৩ নভেম্বর মামুনুল হক বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ থেকে সরে না দাঁড়ালে আরেকটি শাপলা চত্বরের ঘটনা ও ভাস্কর্য ছুঁড়ে ফেলার হুঁশিয়ারি দেন। ২৭ নভেম্বর চট্টগ্রামে জুনাইদ বাবুনগরী ভাস্কর্য ছিঁড়ে, টেনেহিঁচড়ে ফেলে দেয়ার হুমকি দেন। ৫ ডিসেম্বর গভীর রাতে কুষ্টিয়ার পাঁচ মাথা মোড়ে বঙ্গবন্ধুর নির্মাণাধীন ভাস্কর্যের আংশিক ভেঙে ফেলে দুর্বৃত্তরা। ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ সারাদেশে সরকারি দলের নেতাকর্মীরা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে শুরু করে। প্রতিহতের ঘোষণা দেয়া হয় বিরোধিতাকারীদের। কঠোর প্রতিক্রিয়া আসে সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে। দলটির সাধারণ সম্পাদক ভাস্কর্যের বিরোধিতাকারীদের চরম মূল্য দিতে হবে বলেও হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ বাবুনগরী ও মামুনুলদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেন। বিরোধিতাকারীরা এ ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের আগ্রহ দেখিয়ে চিঠি দেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ধর্মবিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে কয়েকদফা বৈঠকে বসেন তারা। এর আগে ২৯ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনে এসে মামুনুল তার বক্তব্যে পূর্বের অবস্থান থেকে সরে আসার কিছুটা ইঙ্গিত দেন। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ভাসিয়ে দেয়া বা এ ধরনের কোনো বক্তব্য দেননি বলে উল্লেখ করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান মুসলিম নেতা হিসেবে তার পরিপূর্ণ শ্রদ্ধার কথা জানান।

হেফাজতকাণ্ড

এস এম মিজান : ২০২০ সালে দেশে ঘটে যাওয়া বেশ কিছু ঘটনার মধ্যে আলোচনা-সমালোচনার অন্যতম বিষয় ছিল হেফাজতে ইসলাম। আলোচিত এ সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা আমির প্রয়াত আহমদ শফীর মৃত্যুপরবর্তী দ্বিধাবিভক্ত হেফাজতের নতুন বিতর্কিত কমিটি গঠন ও এ নিয়ে সারাদেশের কওমি অঙ্গনে অস্থিরতার মধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যবিরোধী অবস্থান নিয়ে সমালোচনা, হুমকি ও ভাস্কর্য ভাঙার ঘটনা ছিল অন্যতম। এর মধ্যে আল্লামা শফীকে হত্যার অভিযোগে হেফাজতের ৩৬ জন নেতাকে আসামি করে একটি মামলা করে তার স্বজনরা, যা নিয়ে হেফাজতের বিবাদমান দুটি গ্রæপের পাল্টাপাল্টি সংবাদ সম্মেলন ও হুমকি-ধমকি অব্যাহত রয়েছে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে শাহ আহমদ শফী ১০৩ বছর বয়সে মারা যান। এর দুই মাস পর কাউন্সিল আহ্বান করে প্রতিষ্ঠাকালীন মহাসচিব আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরীকে আমির নির্বাচিত করে হেফাজতের নতুন কমিটি গঠন করা হয়। গঠিত কমিটিতে প্রয়াত আমির শফীর অনুসারীদের কাউকে রাখা হয়নি বলে অভিযোগ করে তারা পাল্টা কমিটি করার জন্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এ পরিস্থিতির মধ্যেই ঢাকা ও চট্টগ্রামে সংবাদ সম্মেলন করে হেফাজতের সাবেক কয়েকজন নেতা অভিযোগ করেছিলেন, পরিকল্পনা করে আহমদ শফীকে হত্যা করা হয়েছে। হেফাজতের নতুন কমিটিতে পদ না পাওয়া এসব নেতা শাহ আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানীর অনুসারী এবং সরকার ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। পরবর্তী সময়ে হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হকসহ ৩৬ জনকে আসামি করে চট্টগ্রামের আদালতে গত ১৭ ডিসেম্বর আল্লামা শফীর শ্যালক একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। আসামিরা সবাই হেফাজতের বর্তমান আমির জুনাইদ বাবুনগরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। এদিকে হেফাজতের নতুন কমিটি নিয়ে টানাটানির মধ্যেই রাজধানীর ধোলাইপাড়ে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণকাজের বিরোধিতা করে বক্তব্য দেন মাওলানা মামুনুল হক। এরপর একই দাবিতে হেফাজতে ইসলামসহ কয়েকটি ধর্মভিত্তিক সংগঠন বক্তৃতা-বিবৃতি, বিক্ষোভ করে আসছিল। এর মধ্যে কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর নির্মাণাধীন ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এরপর ভাস্কর্য নিয়ে সমালোচনা ও হুমকি দেয়ার অভিযোগে হেফাজতের আমির জুনাইদ বাবুনগরী, মাওলানা মামুনুল হক ও মুফতি ফয়জুল করিমের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের দুটি মামলা দায়ের করা হয়। পরবর্তী সময়ে ভাস্কর্য বিষয়ে পাঁচ দফা দাবি নিয়ে হেফাজতের শীর্ষ স্থানীয় আলেমরা বৈঠক করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে।  

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App