×

সাময়িকী

নিত্য আবিষ্কারের কবি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২০, ১০:৫০ পিএম

নিত্য আবিষ্কারের কবি

হাবীবুল্লাহ সিরাজী

হাত বাড়ালেই উঠে আসে হাতে যার কাব্য; যার কবিতা পড়লে বুকে প্রশান্তির বৃষ্টি ঝরে; যার কবিতার পঙ্ক্তি মুগ্ধ করে, চরণ শেষে মনে হয় আরো একবার পড়ে জেনে নিই অনুভবের গভীর সত্য; যার কবিতার নির্মাণশৈলীতে খুঁজে পেতে চাই নান্দনিকতার নতুন দিশা; যার কবিতার গ্রন্থনা স্বপ্নবুননের স্বপ্নে বিভোর করে; যার কবিতার শিল্পসুষমা-রসবোধ-প্রকরণ বৈভব, কবি ও কবিতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তোলে, তেমন কবির সংখ্যা অঙুলিমেয়। বিরলপ্রজ সংখ্যালঘু কবির মধ্য থেকে আজ একজন কবিকে উপস্থাপন করতে চাই। প্রত্যহিক পাঠে যার কবিতা স্ফ‚র্তি পায়, নিত্য নতুন ভ‚গোল আবিষ্কারের তৃপ্তি পাওয়া যায়; সেই কবির নাম হাবীবুল্লাহ সিরাজী। যার আছে পাঠককে চমকে দেয়ার মতো অসাধারণ কাব্যমেধা; পাশাপাশি আছে তার কবিতার কলাকৌশল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিজের কবিতাকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়ার বিস্ময়কর সামর্থ্য। বাংলা কবিতার নিষ্ঠ পাঠকের সাথে হাবীবুল্লাহ সিরাজীকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না, জানি; তবুও সামান্য তুলে ধরি কবির পরিচয়। হাবীবুল্লাহ সিরাজীর জন্ম ১৯৪৮-এর ৩১ ডিসেম্বর, ফরিদপুর জেলায়। শিক্ষা ও পেশায় তিনি প্রকৌশলী; হাতেগোনা কয়েকজন প্রকৌশলী কবির অন্যতম হাবীবুল্লাহ সিরাজী। যদিও প্রকৌশল শাস্ত্রের সাথে কাব্য চর্চার কোনো বিরোধ নেই, তবুও প্রকৌশলীদের কবি হওয়ার প্রবণতা বোধগম্য কারণে অনেকটাই কম, সেখানেও হাবীবুল্লাহ সিরাজী যতটাই প্রকৌশলী ততটাই, অথবা তারচেয়ে কিছুটা বেশিই কবি। হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার স্বাতন্ত্র্যের সন্ধান পেতে প্রথমত তার প্রকাশিত কাব্যের তালিকার দিকে দৃষ্টি দিতে পারি; ধারণা করি গ্রন্থ তালিকা দেখেই পাঠক মোটা দাগে তার কাব্যচারিত্র্যের সন্ধান পেয়ে যাবেন, আর যারা তার কাব্যসৌন্দর্যের গলিঘুপচি আবিষ্কারে আগ্রহী তাদের প্রবেশ করতে হবে তার কাব্যভুবনের অন্দরে। হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য, তার পরিমিতিবোধ, বুননরীতি, শব্দ চয়নে স্বাতন্ত্র্য, নির্মাণশৈলীর কুশলী গ্রন্থনা, ছন্দবিন্যাসে নিষ্ঠা এবং সর্বোপরি দৃশ্যের অধিক বাক্সময় করার মুন্সিয়ানা ইত্যাদি অনুষঙ্গের কথা আরো একবার স্মরণ করে নিতে চাই। অচেনা ভুবনে ভ্রমণের আগে সেখানকার আবহাওয়া-জলবায়ু-পরিবেশ-পরিপার্শ্ব যেমন জেনে নেয়া আবশ্যক, এ-ও অনেকটা তেমনি। হাবীবুল্লাহ সিরাজী সহজ-সরল ভাষায় কাব্যচর্চা করেন না; সুতরাং যেখানে আড়াল থাকবে, সেখানে উন্মোচনের প্রচেষ্টা থাকতে হবে, যখন বিমূর্ততার ঘোমটা থাকবে তখন অন্তরালোকে মূর্ত করে নেয়ার প্রস্তুতি থাকতে হবে; যখন গতির ক্ষিপ্রতা থাকবে, সে ক্ষিপ্রতাকে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার গৌরব অর্জনের প্রয়োজন হবে। জটিল গ্রন্থি উন্মোচনের আনন্দ সহজপ্রাপ্য হবে তেমনটি আশা করাও অন্যায়। সিরাজীকাব্য পাঠে মস্তিষ্কের গ্রন্থিগুলোকে সজাগ রাখার পাশাপাশি হৃদয়ের কপাটগুলোকে শিথিল করে নেয়া ভালো। হৃদয়সংবেদী পাঠে উন্মোচিত হবে দুর্ভেদ্য সব অন্ধকার। একজন প্রাগ্রসর পাঠককে সিরাজীর কবিতা পড়তে হবে নিজেকে অগ্রসর প্রমাণের জন্য। তুচ্ছ অনুষঙ্গকেও তিনি অসামান্য কবিতা করে তুলতে জানেন; কবিতার নির্মাণশৈলীর সৌন্দর্য উপলব্ধির জন্য পড়তে হবে হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতা। তার বিভিন্ন কাব্যে তেমন দ্যুতির কবিতা পেয়ে যাই আমরা অগণন। সেসব উদাহরণ আগেই লিখেছি, আজ ভিন্ন আঙিনায় আলো ফেলতে চাই। সমকালের জীবনে বৈপরিত্যের বাস্তবতা প্রতীকী ব্যঞ্জনায় অসাধারণ উপস্থাপনা দেখি তার মাত্রাবৃত্তে লেখা নিচের কবিতায়- এক দাগ শোক, তামাশাও এক/ ফালি করে বেলা হাঁটে/ ভোরের সূর্য রাতের চন্দ্র/ মুখোমুখি বিভ্রাটে! (শোক ও তামাশা\ কবিরাজ বিল্ডিংয়ের ছাদ\ হাবীবুল্লাহ সিরাজী) আমার বক্তব্যের সমর্থনে হাবীবুল্লাহ সিরাজীর অগ্রন্থিত কয়েকটি কবিতায় মনোযোগ দিতে পারি। একদিকে কবিতার মায়াবী ভুবন, অন্যদিকে সমকালের অস্থিরতা; একদিকে কবিতার শিল্প-সুষমা, অন্যদিকে প্রযুক্তির যথেচ্ছাচার; এমন বাস্তবতায় কবি লিখেন-

১. বিক্রি হ’য়ে গেছে মাথা/ ঝুলছে পা শরীর ছুরির নিচে/ ফুসফুস ও হৃদয়ে/ কোন্ অভিমান/ তাজা ও পচার ভেদ/ রক্তে কি সমান (মিল\ হাবীবুল্লাহ সিরাজী) কবিতায় যখন অদৃশ্য সৌন্দর্য প্রতীক-ইঙ্গিতের আড়ালে থাকে, পাঠকের জন্য তখন প্রয়োজন সতর্ক-মনোযোগী পাঠ; আমি বিশ্বাস করি, হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতা নিষ্ঠপাঠেই সহজ উদ্ধার সম্ভব। নিষ্ঠপাঠের সীমায় পৌঁছাতে আমাদের বারবার যেতে হবে তার কবিতার কাছে। তেমনি একটি কবিতা পড়া যাক- উদাসীনতায় কতো কী যে ভাঙে/ নীল ভাঙে যতো/ জলের পাঁজরে/ মায়া তার ছায়া অবকাশ মতো বিকেল ভেঙেছে সন্ধ্যা-কুহকে/ রজনীর জের/ তারাদের ভাঙে/ কুয়াশা-প্রভাতে চায় ক্ষমা ফের অবহেলা যদি শরতের নামে/ ভাঁজ-ভাঙা মাঠে/ ফিকে শাদা লেখে/ ভাঙা তবে ডাকে খোলা চৌকাঠে আর ভাঙা যার সৃষ্টি-মন্ত্র/ তার দিনকাল/ মিলনসূত্রে/ অরূপের রূপে নতুন প্রবাল (ভাঙা\ হাবীবুল্লাহ সিরাজী) ছন্দের সৌন্দর্য পাঠে এবার মনোযোগী হতে চাই, যেখানে বৈপরিত্যের বাস্তবতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে- যে ডালে পাখির বাসা সে ডালেই সাপ যেই গল্পে পিপীলিকা সেই গল্পে পাপ- যে পাতায় অমাবস্যা সে পাতায় চাঁদ যেই মূলে মুক্তধারা সেই মূলে ফাঁদ- যে বৃক্ষে নদীর টান সে বৃক্ষেই চর যেই জলে নিজ স্বত্ব সেই জলে ডর কাফনে পকেট নেই তবু রাজা জমায় সম্পদ প্রজার পেয়ালা নেই তবু নাচে ক্ষুধার নারদ (নিয়তি\ হাবীবুল্লাহ সিরাজী) কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী তার কবিতায় নিত্য স্বপ্ন রচনা করে আমাদের কবিতামগ্ন হতে প্রাণিত করেন; তার গদ্য পড়েও আমরা পাই কবিতার স্বাদ। তার ‘পায়ে উর্বর পলি’ নামের গদ্য গ্রন্থে তিনি ‘পাখিপুরাণ’ নামে আমাকে নিয়ে একটি ছোট গদ্য লিখেছেন; যার সামান্য অংশ এখানে উপস্থাপন করতে চাই; যা পাঠ করে আমরা সহজেই জেনে নিতে পারি কতটা সহজ এবং কাব্যময় তার গদ্যভাষা- “এমন কেউ আছে, যাকে পিঁড়ি পেতে দিতে হয়। বলতে হয়, এসো বসো দু’টো মুড়ি-গুড় খাও। সে বসে, আগ্রহভরে মুঠোভর্তি মুড়ি মুখে ফেলে গুড়ে কামড় দেয়। তৃপ্তির সঙ্গে চিবুতে-চিবুতে ভরা গালে গল্প বলে প্রেম-সোহাগের, ‘যতদিন মিসকল ততদিন প্রণয়।’ এই প্রণয়-পুরুষ কবি ফরিদ আহমদ দুলালÑ কখন, কীভাবে তার ‘পাখিপুরাণ নিয়ে মুখর করা শুরু করেছে তা ধরার আগেই কানে বেজেছে’-... কোনো এক গ্রামে শীতের সকালে/তুমিও সেঁকে নিতে পারো ঠাণ্ডায় জব্দ করতল। ফরিদ আহমদ দুলাল, বুঝিবা সবার দুলাল হয়ে ভুল কল দিতে-দিতে মূল কলে আদ্যোপান্ত ঢুকে বসে আছে। তার বিষাদ, বিরহ, দুঃসময় যে ভাষায় প্রণতি জানায়Ñ তা গ্রহণ করতে হয় সর্বজনীন একাগ্রতায়। আমাদের সব বিষাদের চৌকাঠে দাঁড়িয়ে থাকে বিরহ, আর বিরহ তো দুঃসময়কে আলিঙ্গন করার অপেক্ষায় উন্মুখ। প্রত্যেকে ছুঁয়েছে তোমার বেদনা এই ছোঁয়া কিংবা স্পর্শ, এক অনন্ত যাত্রাসঙ্গী। ফরিদ আহমদ দুলাল তার শিল্পসত্তাকে বিস্তারিত করেছে নানা প্রকরণে। কবিতাকে কেন্দ্রে রেখে গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ-নাটককে আবর্তিত করেছে। তদুপরি আছে অসাধারণ এক সাংগঠনিক শক্তি। যে ডাকে সে তাকে পায়; ডাক দেয়ার ভাষাটি তার হৃদয়ে মোহ হয়ে জমে, মগ্ন হয়ে প্রকাশিত হয়। এই মোহ ও মগ্নতার সম্মিলনে দুলাল ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা হয়ে সমগ্র বাংলাদেশে নিজেকে ছড়িয়ে দেয়। পথে-পথে নিজের খোঁজের অন্তরালে থাকে প্রান্তরের আবহাওয়া। সেখানে খড়কুটোও পায় অস্তিত্বের আচরণ, প্রাণিকুলে জমে প্রেমময় অবস্থান। ‘এবঙ লাঠিয়াল’, ‘মানিক বাউলের পালা’, ‘লড়াই’ যেন নাটকই শুধু নয় আমাদের পরম্পরার এক অনিবার্য আয়োজন। নাট্যকার দুলাল যুদ্ধক্ষেত্রে এক অপরাজেয় শক্তি। তার গল্প তার মতোই পক্বকেশ ও দীর্ঘদেহকে ধারণ করে সময়ের সঙ্গে পরিকল্পিত হয়; পরিস্থিতি তাকে বেদনার ভাষার সঙ্গে বিরহের উপমা মিশিয়ে জীবন শেখায়। কবি ও গল্পকার একে অন্যের পরিপূরক। Ñ‘স্বতন্ত্র’ যেন নিজের স্বপ্ন-কল্পনার যৌথ এক যাত্রা। ছোট কাগজের মোড়কে সম্পাদকের গুচ্ছ-ইচ্ছার পূরণ। এই যে ফরিদ আহমদ দুলালকে নিয়ে খণ্ড খণ্ড চিত্র, তার দায় বহন করে যাপন। সই হবার পর তাতে মই ফেলার তাগিদ তৈরি করে ভিন্ন পথ। তবু প্রাক-প্রস্তুতি সে যাত্রাপথে মূল গতিটি নির্ণয় করে দেয়। ডিগবাজি দেয়া কিংবা চিৎ-কাৎ হয়ে পড়ে থাকা অপেক্ষা কেবল ফুটতে থাকে।” (পাখিপুরাণ\ পায়ে উর্বর পলি\ হাবীবুল্লাহ সিরাজী) এবং বিবিধ কারণে তার কবিতা পড়ে বুকে প্রশান্তির ছায়া খুঁজি; তার কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে মুগ্ধতা অন্বেষণ করি; তার কবিতার নির্মাণশৈলীতে খুঁজে পেতে চাই নান্দনিকতার নতুন দিশা; তার কবিতার গ্রন্থনা স্বপ্নবুননের স্বপ্নে বিভোর থাকি; তার কবিতার শিল্পসুষমা-রসবোধ-প্রকরণ-বৈভব, কবি ও কবিতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠি; আমি প্রত্যাশা করি আমার পাঠককুল সে ঋদ্ধি থেকে বঞ্চিত না হ’ন। কবির আসন্ন ৭৩তম জন্মদিন উপলক্ষে কবির প্রতি অপরিসীম শুভকামনা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App