×

মুক্তচিন্তা

করোনাতঙ্কে আয়েশের শীতকাল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২০, ০৮:৫৪ পিএম

আমাদের দেশসহ বিশ্বের সব দেশেই অঞ্চলভেদে ঋতু-প্রকৃতির ভিন্নতা রয়েছে। দেশে এবারের শীত মৌসুমেও গতবারের মতো শীতের প্রকোপ তেমন নেই। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসের বিদায়ের পর জানুয়ারিও এসে গেল অথচ এবারো শীত তেমন পড়ল না। মাঘের শীতে বাঘ পালানোর গল্প, গল্পই হয়ে যাবে বোধ করি। বাস্তবের সঙ্গে মেলানো গেল না। মাঘ মাসেও শীতের তীব্রতা অনুভব করা যাবে বলে মনে হয় না। এলো না শৈত্যপ্রবাহের প্রবল শীতের প্রাবল্য। ষড় ঋতুর আমাদের ভূখণ্ডের সবচেয়ে আয়েশের ঋতুটি শীতকাল। সব ঋতুই ইতি-নেতির প্রভাবমুক্ত নয়। তুলনামূলক বিচারে শীতকালেই পরিমাণগত ইতির পরিমাণ বেশি। নেতি বলতে প্রধানত ধুলাবালিতে সর্বত্র ছেয়ে যায়। ধুলার আস্তরণে ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, দ্রব্যসামগ্রী, এমনকি গাছগাছালির সবুজ পত্রপল্লব পর্যন্ত ধূসর হয়ে পড়ে। ধুলার কারণে শ্বাসকষ্টজনিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। গত কয়েক বছর ধরে শহরের যত্রতত্র শুকনো পাতা, খড়কুটা পোড়ানোর মহোৎসব চলছে। যে কেউ খড়কুটা স্ত‚প করে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে যে কি পরিমাণ বায়ুদূষণ ঘটে সেটা বোঝার সাধ্য যেন কারো নেই। পোড়া গন্ধের দূষিত অক্সিজেন গ্রহণে মানুষ নাকাল হলেও এ নিয়ে রাষ্ট্রের বা পরিবেশবাদীদের মুখে কোনো শব্দ নেই। যাদের শ্বাসকষ্টের সমস্যা আছে তাদের জীবন তো এতে ঝুঁকির মুখে পড়ে। অথচ এ বিষয়ে জনসচেতনতার দৃশ্যমান দৃষ্টান্ত দেখা যায় না। ঝড়, বৃষ্টিহীন গরমের তীব্র দাবদাহমুক্ত শীতকাল সঙ্গত কারণে সবারই প্রিয়। যেন নিকটজন। ভ্রমণ, বনভোজন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক উৎসব পার্বণের উৎকৃষ্ট সময় রূপেও গণ্য করা হয় শীতকালকে। যারা কায়িক শ্রমে জীবিকা নির্বাহ করে তাদের জন্যও সহনীয় সময় এই শীতকাল। একেবারে শীতকালের ইতির পাশাপাশি অতিমাত্রায় নেতির শঙ্কা-আতঙ্ক দেখা দিয়েছে, শীতে করোনার মারাত্মক প্রভাব নিয়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিশেষজ্ঞরা আগাম সতর্ক বার্তা দিয়েছিল শীতের আগমনে করোনার প্রভাবের ভয়াবহতা নিয়ে। তাদের কথা মিথ্যা হয়নি। ইতোমধ্যে করোনা চরম আকার ধারণ করে প্রবল আগ্রাসন চালিয়ে ইউরোপ, আমেরিকা মহাদেশে তীব্রতর হয়েছে। আমরাও নিরাপদে নেই। আমাদের দেশেও আক্রান্ত ও মৃত্যের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। জীবন ও জীবিকার তাড়নায় মানুষ স্বাস্থ্যনীতি মেনে গৃহকোণে আত্মগোপনে করোনা থেকে মুক্তি পেলেও অনাহারে তো থাকা যাবে না। তাই চরম ঝুঁকি নিয়েই মানুষ জীবিকার প্রয়োজনে পথে নেমেছে। কেননা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই জীবিকানির্ভর অর্থাৎ চাকুরে এবং নিম্নমানের কায়িক পরিশ্রমনির্ভর। তাদের নিত্যকার জীবন নিত্যদিনের জীবিকার ওপর নির্ভরশীল। তাই করোনাকালে পথে-ঘটে সর্বত্রে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করতে দেখা যায়। এতে করোনা বিস্তারে হয়তো সহায়ক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বাড়ছে করোনার আক্রান্তের সংখ্যাও। রাষ্ট্র ও সরকার ওই বিষয়ে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারায় মানুষের দুর্গতি কমেনি। বরং বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের ভূখণ্ডের মতো সহনীয় আরামদায়ক শীতকাল বিশ্বের নগণ্য দেশেই দেখা মিলবে। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী ভারতের সব অঞ্চলকেও আমাদের শীতকালের সঙ্গে মেলানো যাবে না। ইউরোপ-আমেরিকা মহাদেশজুড়ে তীব্র শীত, ঘন কুয়াশা, প্রচণ্ড তুষারপাতে জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়ে। বিমান, সড়কসহ সব যোগাযোগ ব্যবস্থা হয়ে পড়ে স্থবির। অচল ও স্থবির হয়ে পড়ে জনজীবন। মহাদেশ দুটি শীতপ্রধান। তবে এশিয়ার অনেক দেশ ও অঞ্চল শীতের তীব্রতামুক্ত কিন্তু নয়। শীতপ্রধান দেশগুলোতে শীতকালে বৃষ্টিপাত হয়, তুষারপাতও হয়। সূর্য দেখা যায় না। এতে শীতের তীব্রতায় মানুষ গৃহবন্দি হয়ে পড়ে। সূর্য দেখা দিলে তুষার গলার সময় তীব্র ঠাণ্ডা বাতাস শরীরের যে অংশে স্পর্শ করে মনে হয় কেউ ওই অংশে ছুরি ঢুকিয়ে দিচ্ছে। শীতপ্রধান দেশগুলোর তালিকায় উন্নত দেশই সর্বাধিক। শীত নিয়ন্ত্রণে ব্যয়াধিক্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে নিজেদের রক্ষার নানা কৌশল তারা অবলম্বন করে নিয়েছে। অর্থনৈতিক কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলোর পক্ষে ব্যয়াধিক্য অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার সম্ভব হয়নি। সে কারণে শীতে তাদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। শীতে প্রচুর মানুষের মৃত্যুর ঘটনাও তাই ঘটে। শুরুতে একই দেশের অঞ্চলভেদে শীতের ভিন্নতার কথা বলেছি। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলাম এপ্রিল মাসে দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়–তে গিয়ে। চেন্নাইতে গরমে টিকতে না পেরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে থাকতে বাধ্য হয়েছিলাম। অথচ চেন্নাই থেকে কোয়ামবাটর-কানুর হয়ে অনেক উঁচুতে অবস্থিত উটি গিয়ে তীব্র শীতে নাকাল হতে হয়েছিল। বাধ্য হয়েছিলাম বেশ কিছু শীতবস্ত্র ক্রয় করতে। বন্ধ ঘরে দুই কম্বল গায়ে দিয়েও শীতে কাঁপতে হয়েছে। একই তামিলনাড়– প্রদেশের দুই অঞ্চলের আবহাওয়ার বৈপরীত্য দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। ফেব্রুয়ারি মাসে পশ্চিম বাংলা প্রদেশের কলকাতা থেকে দার্জিলিং ভ্রমণে শীতের দুর্ভোগের শিক্ষালাভও করেছিলাম। সে শিক্ষা দুর্ভোগ-যাতনার। আর সেটা শীতের প্রকোপের শিক্ষা। আমাদের দেশের উত্তরবঙ্গে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে অধিক শীত থাকে। কিন্তু চেন্নাই আর উটি এবং কলকাতা আর দার্জিলিংয়ের মতো অমন চরম বৈপরীত্যে নয়। মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কে আমাদের সনাতনি ধারণা মরু অঞ্চল উষ্ণপ্রধান মধ্যপ্রাচ্য। সেখানকার গরমের সংবাদ যেভাবে চাউর হয়েছে, শীত নিয়ে ততটা নয়। ইরাকের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঁচ বছর ছিলাম। গরমের তীব্রতা যেমন দেখেছি। ঠিক তেমনি দেখেছি শীতের তীব্রতাও। অঞ্চলভেদে শীত কম-বেশি হলেও সেখানকার শীতও ভয়ঙ্কর। সিরিয়া সীমান্তে আল-কাইম, জর্ডান ও সিরিয়ার সীমান্তের সমদূরত্বের আকাসাত নামক স্থানে শীতের তীব্রতা দেখেছি। সর্বাধিক মাইনাস ফাইভ শীত দেখেছি সেখানে। দেখেছি তুষারপাত এবং একই সঙ্গে শীত মৌসুমব্যাপী বৃষ্টিপাতও। গরমকালে ওখানে বৃষ্টি দেখিনি। এতে শীতের তীব্রতা ভয়ঙ্কর ওয়ে ওঠে। আল-কাইম, আকাসাতের শীতের তীব্রতা দেখেই আঁচ করা যায় সিরিয়া এবং জর্ডানের শীতের তীব্রতা। উত্তর ইরাকের মোশুল, কিরকুক, সোলমানিয়া, সালাহউদ্দিনেও দেখেছি শীতের তীব্রতা সেখানেও ভয়ানক। তুরস্কের সীমান্তবর্তী উত্তর ইরাক। তুরস্ক এশিয়ার সর্বশেষ দেশ এবং ইউরোপ সংলগ্ন। উত্তর ইরাকের শীতের তীব্রতা দেখে বুঝতে অসুবিধা হয়নি তুরস্কের ভয়ঙ্কর শীতের বিষয়টি। দক্ষিণ ইরাকের বসরা ইরান সংলগ্ন। সেখানেও তীব্র শীত। ইরানও যে শীতমুক্ত নয় বসরা বসবাসে সেটা অনুমান করতে অসুবিধা হয়নি। ইরাকজুড়েই যেমন গরমের তীব্রতা, তেমনি শীতেরও। বাগদাদ, রামাদি, ফালুজা প্রভৃতি স্থানে অসহনীয় শীতের দাপট প্রত্যক্ষ করেছি। মধ্যপ্রাচ্য কেবল উষ্ণ অঞ্চল নয়। তীব্র শীতের জন্যও খ্যাত। শীতপ্রধান উন্নয়নশীল দেশগুলো শীত প্রতিরোধে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারে না অর্থনৈতিক কারণে। যেটি উন্নত বিশ্বের পক্ষে সম্ভব হয়েছে। ইরাকের অভিজ্ঞতায় বরফ উনানে গরম করে পানির চাহিদা পর্যন্ত পূরণ করেছি। কেননা জিরো ডিগ্রিতে পানি আর পানি থাকে না। বরফে পরিণত হয়ে যায়। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ হিটার-পানির গিজার ব্যবহারের সুযোগ থাকলেও কেন্দ্রীয়ভাবে ছিল না। যেটি উন্নত দেশগুলোতে রয়েছে। শীত নিয়ন্ত্রণে ধনী দেশগুলো নানা পন্থায় আরাম-আয়েশ নিরাপদ নিশ্চিত করলেও উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে সেটা সম্ভব হয়নি। এতে তাদের শীতকাল আসে সীমাহীন দুর্ভোগ-যাতনা নিয়ে। আমাদের দেশের শীতকাল এক কথায় আরামপ্রদ এবং আয়েশের। আমাদের ফসলের মাঠ ভরে ওঠে শীতকালীন নানা প্রকার রবিশস্যে। গ্রামাঞ্চলে খেজুর গাছের রসে পিঠা-পুলি তৈরি হয় ঘরে ঘরে। আমাদের দেশে শীতকাল আসে উৎসব আর আরাম-আয়েশের বারতা নিয়ে। ষড় ঋতুর সবচেয়ে চমৎকার ঋতুটি হচ্ছে শীতকাল। আমাদের দেশে বছরের সিংহভাগ সময় গ্রীষ্ম ভর করে থাকে। জনজীবনকে গরমের তীব্রতা অতিষ্ঠ করে তোলে। শীতকাল আমাদের সামগ্রিক জীবনাচারে ভিন্ন উপাদান-অনুভ‚তি নিয়ে হাজির হয়। এবং দ্রুত চলেও যায়। সুদিন যেমন কখনো দীর্ঘায়িত হয় না। ঠিক তেমনি শীতকাল আসে এবং দ্রুত বিদায়ও নেয়। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসব-পার্বণের জন্য আমরা শীতকালকেই বেছে নিই। এবং এটা যুগ-যুগান্তরের ধারাবাহিকতা। শীতে শহরে যেমন উন্মুক্ত স্থানজুড়ে নানা অনুষ্ঠানের আধিক্য লক্ষ্য করি। তেমনি গ্রামাঞ্চলেও পালাগান, যাত্রা, নাটক ইত্যাদি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রতি শীত মৌসুমেই অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। গ্রীষ্ম-বর্ষা এড়িয়ে বিয়েসহ যাবতীয় সামাজিক অনুষ্ঠানও শীতকালে নির্ধারণ হয়ে থাকে। আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে শীতকালকে সুদিনকাল রূপে গণ্য করা হয়। আচমকা শৈত্যপ্রবাহ নিশ্চয় আমাদের নাকাল করে। তবে তার স্থায়িত্ব স্বল্প সময়ের জন্য। সব বিবেচনায় আমাদের শ্রেষ্ঠ মৌসুম স্বল্পায়ু এই শীতকাল। শীতকাল যৌক্তিক কারণেই সবার প্রিয় মৌসুম রূপে স্বীকৃত। এবারের শীতে আমাদের জন্য উৎসব-আনন্দের বার্তার বিপরীতে শঙ্কা-আতঙ্ক নিয়ে হাজির হয়েছে। শীতের সময়কার সব অনুষ্ঠানাদি পণ্ড হয়ে গেছে। করোনা নতুন মাত্রায় আরো শক্তি সঞ্চয় করে বিস্তার লাভ করেছে, শীতকে উপলক্ষ করে। তাই এবারের বড়দিন, নববর্ষ পালনের মতো উৎসবগুলো বাতিল হয়েছে। বাতিল হয়েছে শীত মৌসুমের সব অনুষ্ঠান-পার্বণ। আমাদের চিরায়ত শীতকালীন সব সামাজিক অনুষ্ঠানও স্থগিত হয়ে পড়েছে করোনা মহামারির আগ্রাসনে। করোনা আমাদের সামষ্টিক সামাজিকতাকে ভেঙে চুরমার করে অসামাজিকতার বৃত্তবন্দি করে ছেড়েছে। এই যে বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হলো করোনা পরবর্তী সেটা আবার ফিরে আসবে কিনা সেটাও কিন্তু অমূলক ভাবনা নয়। বিদ্যমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা এমনিতেই আমাদের বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছিল। করোনা সেটাকে প্রায় স্থায়ী করে দিল। যদিও করোনাকালে করোনার প্রকোপে মানুষ তার স্বাভাবিক জীবন-জীবিকা নিয়ে চরম ঝুঁকির মুখে। শীতে করোনার প্রকোপ বৃদ্ধিতে বিশ্ব থমকে গেছে। অনেক দেশে চলছে লাগাতার লকডাউন। বিশ্ব নিশ্চয় অতীতের কলেরা, প্লেগ ইত্যাদি মহামারি থেকে পরিত্রাণ পেয়েছিল। এবারো পাবে, প্রতিষেধক প্রাথমিকভাবে হলেও আবিষ্কৃত হয়েছে। আরো উন্নত হবে, কেননা মানুষ করোনার কাছে আত্মসমর্পণে সম্মত হবে না।

মযহারুল ইসলাম বাবলা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App