×

সাময়িকী

একজন মননশীল কাব্যশেরপা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২০, ১১:০৯ পিএম

একজন মননশীল কাব্যশেরপা

হাবিবুল্লাহ সিরাজী

বাংলা কবিতার বিশাল পরিমণ্ডলে সিরাজীর সাবলীল গতিবিধি বিশেষভাবে উল্লেখ্য। বিশ্ব কবিতার কাঁধে হাত রেখে বাংলা কবিতাও ষাট দশকে ইতিবাচক বাঁক নেয়। বিষয়বস্তু আঙ্গিক ও প্রকরণ আরো সৃজনশীল ও ঋদ্ধ হয়ে ওঠে। এই দশকে বাংলা কবিতার উন্নয়ন প্রচেষ্টায় হাতেগোনা যে ক’জন কবি তাঁদের মেধা ও শ্রম দিয়ে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তাদের মধ্যে কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী অন্যতম মননশীল কাব্যশেরপা। বাংলা কাব্য কাননে হাবীবুল্লাহ সিরাজীর সক্রিয় উপস্থিতি প্রলম্বিত। এই প্রলম্বিত কালখণ্ডে তার কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা অর্ধশতাধিকের সীমারেখা অতিক্রম করেছে। ‘দাও বৃক্ষ দাও দিন’ দিয়ে সূচিত গ্রন্থের কারাভাঁ অদ্যাবধি তীব্র ও বেগবান। বয়সের ভার তাঁকে কাবু করতে পারেনি। তার কাব্যদেহ বিশুদ্ধ ও নান্দনিক বহিঃপ্রকাশ। কবিতার শরীরে দেশ রাষ্ট্র ও সমাজ বাস্তবতাকে আত্মীকরণ করতে সিরাজী প্রয়োগ করেন তার চিন্তাশক্তিকে। তার শিল্পিত হাতের বিদ্যুৎস্পর্শে কবিতা হয়ে ওঠে শিল্পোত্তীর্ণ। -হাবীবুল্লাহ সিরাজী সমাজ ও রাজনীতি সচেতন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মনস্কতার অধিকারী। তাই তার কবিতার বিষয়বস্তু হিসাবে উঠে এসেছে দেশপ্রেম, মাটি ও মানুষ প্রকৃতি ও নিসর্গ, প্রেম, বেদনা, প্রতিবাদ দ্রোহ এবং মুক্তিযুদ্ধ। -যুগে যুগে কালে কালে কবিরা মাটি ও মানুষের পুজারি। মানুষের সুখ দুঃখ, আনন্দ বেদনায় যাতনা ও সংকটে মানুষের পাশে সদা দণ্ডায়মান। হাবীবুল্লাহ সিরাজীও মানুষের কল্যাণে অতন্দ্র প্রহরীর মতো দৃঢ় ও ঋজু। তাই তিনি উচ্চারণ করেন- -নিতান্ত অপ্রিয় সত্য/ সত্য কী না সন্দেহের সীমা/ ক্রোধে আর সম্ভব অভয়ে/ অগ্নি-জলে এক হ’য়ে যায়! নিতান্ত অদেখা লোক/ লোক কী না তা-ও স্পষ্ট নয়/ শোকে আর অনাগত য়ে/ বায়ুপথ স্থিত নিরালোকে! -প্রকৃতি ও নিসর্গ অন্যান্যের মতো হাবীবুল্লাহ সিরাজীকেও আন্দোলিত করে। তাই তার কবিতার বিশাল ক্যানভাসে আকাশ বাতাস পাহাড় নদী সমুদ্র চন্দ্র সূর্য তারকা বনভ‚মি ফসলের মাঠ ফুল ও ফল পাখ-পাখালি মূর্ত হয়ে উঠেছে। তার কবিতার শিল্পগুণ অসাধারণ যেমন : ‘আমি নিঃসঙ্গ, তুমি নিঃসঙ্গ একা হবে না দেখা ভেঙে দিয়ে বাঁধ, বৈরী মিলন রেখা? আমি ব’সে থাকি, তুমি বসে থাকো, ভিন্ন হবে না কথা, শব্দ যেখানে চেয়েছে হৃদয়-চিহ্ন!’ (চিহ্নরূপ \ ম্লান, ম্রিয়মাণ নয়) সিরাজী প্রেমিক কবি, সিরাজীর কবিতায় সেই প্রেম প্রগাঢ় হয়ে উঠেছে। তার কবিতা পাঠ করলে সহজেই বোঝা যায় যে তিনি যেমন নর-নারীর প্রেমের সমর্থক তেমনি গাছ বা প্রাণিকুলের প্রতিও তার ভালোবাসা প্রকট। একটি উদাহরণ আনন্দের পাশাপাশি সিরাজীর কবিতায় বেদনাও ফুটে উঠেছে। সামাজিক প্রেক্ষাপটে অমানবিক ঘটনা প্রবাহে তিনি ব্যথিত না হয়ে পারেন না। তাই তার কবিতায় বেদনাবোধ প্রবল হয়ে উঠেছে- কার্তিকের জোতে জেল্লা হাঁসফাঁস গাল পেতে ভোর শেখা হলে পাগল চেনার জন্য জোর তালি লাগে- কুমির যে হরিণ দেখে, তার দাঁতে নক্ষত্রের ফাঁদ অচেনা পাতাল এবং ন্যুব্জ হাসপাতাল পঙ্গপাল চিনেছিল এঁটো কুয়াশায়- মোহনায় তিন বিঘা জমি জাগিয়াছে...

কবি সিরাজী রাজনীতি সচেতন প্রজ্ঞাবান মানুষ। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে সেখানে গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা পরখ করেন সেখানে তিনি তার সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। পক্ষান্তরে যেখানে অগণতান্ত্রিক দুঃশাসন দেখেছেন সেখানেই তিনি প্রতিবাদে উচ্চকিত হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনে সবচেয়ে বড় ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সিরাজীর সমর্থন একজন লড়াকু সৈনিকের মতো বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধ কালে প্রতিপক্ষের অমানুষিক কর্মকাণ্ডে যেমন নির্বিচারে মানুষ হত্যা, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, লুণ্ঠন সর্বোপরি স্বাধীনতা বিরোধী তৎপরতায় কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী শুধু ব্যথিতই হননি একজন মুক্তিযোদ্ধার মত প্রতিবাদে ফেটে পড়েছেন। কণ্ঠচিরে বলেছেন- উকুন মগজ খায়, ঘাতকের নল খায় নিঃশ্বাসের ধ্বনি হানাদার মাংস খায়, শব্দ-সুর মেধা খায় পা-চাটা কুকুর; হায়েনারা রক্ত খায়, দাঁতে-চোখে মোহম্মদী বেগ হাতের অপর পিঠে অন্য হাত, আরেক মীরন সিরাজ কেবল মরে, বিশ্বাসের পদচিহ্ন মুছে যায় বারুদের তাপে! কাব্যচর্চায় নান্দনিক অনুষঙ্গ প্রয়োগ অপরিহার্য। এইসব কাব্যরীতির ব্যত্যয় ঘটলে কবিতার শিল্পগুণ ক্ষুণœ হয়। হাবীবুল্লাহ সিরাজী একজন সচেতন শিল্পী হিসেবে কাব্য প্রকরণের প্রতি অত্যন্ত যতে্নর পরিচয় দিয়েছেন। কবিতা উপযোগী শব্দচয়নে এবং সেইসব শব্দের যথার্থ প্রয়োগে সিরাজীর মুন্সিয়ানা প্রশংসার দাবিদার। কবিতার প্রয়োজনে কোমল কঠোর শব্দের ব্যবহারে তার কবিতা হয়ে উঠেছে নান্দনিক ও সুখপাঠ্য। সেরকম কিছু শব্দের উল্লেখ করা যেতে পারে। অঘ্রাণ তো গলা পেতে থাকে তেলজমা পেট আর তার ঘুমভাঙা ডানা পালং-এর পাতায় তোলে ঋতুঢেউ যেন উম, এলোমেলো চুম্বনের দ্বিধা ভেঙে দেয় কাঁকড়ার পিঠ নয়া চরে শিশু ফুটিয়াছে... ছন্দ কবিতার প্রধান অনুষঙ্গ। ছন্দ ছাড়া বিশুদ্ধ কবিতার চিন্তা করাও অবান্তর। হাবীবুল্লাহ সিরাজী ছন্দপটু কাব্য কারিগর। তার কবিতায় অক্ষরবৃত্ত, স্বরবৃত্ত, মাত্রবৃত্ত ছন্দের সাবলীল ব্যবহার প্রত্যক্ষ করা যায়। ছন্দপটু হওয়ার পরও সিরাজী ছন্দভাঙ্গার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর কারিশমাও দেখিয়েছেন। উদাহরণ ‘রৌদ্রের কুসুম ভেঙে হেঁটে গেলো একদল ছেলে হাতজোড়া কার্তুজের ভারি-ভারি ক্রেট পরনে গভীর নীল চাপা ট্রাউজার ঈষৎ কাদায় মাখা মাথার হেমলেট গোল ইয়ে নেমে গেছে রুক্ষ খোলা চুলে।’ (প্রার্থিত শীতের অরণ্য\ মোমাশিল্পের ক্ষয়ক্ষীতি) উপমা রূপক বিশুদ্ধ কবিতায় দুই অনুষঙ্গ। উপমা ও রূপকের আশ্রয়ী হয়ে কবিতা রচনা শক্তিশালী কবির পক্ষেই সম্ভব। হাবীবুল্লাহ সিরাজী সেইসব কবির একজন যারা কবিতায় যোগ্য উপমা ও রূপকাশ্রয়ী। উৎকৃষ্ট কবিতার প্রয়োজনীয় গুণ চিত্রকল্প। চিত্রকল্পহীন কবিতায় রস আস্বাদন পাঠকের জন্য কষ্টকর। তাই শক্তিমান কবিদের কবিতায় চিত্রকল্পের যোগ্য ব্যবহার দেখি। হাবীবুল্লাহ সিরাজী আত্মনিবেদিত এবং জীবনব্যাপী কাব্যচর্চার কারিগর। অন্তঃমিল কবিতায় এক ধরনের ‘তাল’-এর সৃষ্টি করে। যে তাল পাঠকের রস আস্বাদনে সহায়ক। তাবড় তাবড় কবির কবিতায় অন্তঃমিলের সন্ধান পাওয়া যায়। হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতাতেও আমরা সেই অন্তঃমিল অর্থাৎ সেই ‘তাল’- এর সন্ধান পাই। সর্বোপরি একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কাব্যচর্চার আত্মমগ্নতা তাকে বাংলা কবিতায় বিশেষ করে ষাট দশকের কবিতায় একজন তরুণ তুর্কি অথবা সাহসী শেরপা অভিধায় অভিসিক্ত করেছে। তার এই অভিধা যুগ যুগ ধরে অটুট থাকুক। জয়তু সিরাজী।

[কবি মুশাররাফ করিম মৃত্যুশয্যায় এ রচনাটি লিখেছেন]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App