×

সাময়িকী

‘উন্মোচন’ কবিতায় ‘সৃষ্টি-রূপে’র অভিনব ব্যাখ্যা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২০, ১০:১১ পিএম

‘উন্মোচন’ কবিতায় ‘সৃষ্টি-রূপে’র অভিনব ব্যাখ্যা

কবির কাজ গভীর থেকে গভীরতর পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধান। পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কবি সেই পথ দিয়েই প্রচলিত ঘটনা ও দৃশ্যের অন্তর্লোক ভেদ করে নতুন তথ্য ও তত্ত¡ আবিষ্কার করেন! কবির সেই গভীরতর পর্যবেক্ষণ এবং আবিষ্কারে কল্লোলিত হয়ে ওঠে দৃশ্য-অদৃশ্যের মর্মবাহী ভুবন। বাংলাদেশের খ্যাতিমান কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতা পাঠককে সে ধরনের অভিজ্ঞতায় জারিত ও রসবোধে উত্তীর্ণ করে। হাবীবুল্লাহ সিরাজীর অনেক কবিতার দৃষ্টান্ত দিয়ে এই উপলব্ধির প্রমাণ করা সম্ভব। এখানে একটি কবিতার দৃষ্টান্ত দিয়ে তাঁর কবিতার অন্তর্গত পর্যবেক্ষণ ও মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনার প্রমাণ উপস্থাপন করা হচ্ছে। কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কতো কাছে জলছত্র, কতো দূর চেরাপুঞ্জির কাব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘উন্মোচন’ শীর্ষক কবিতায় অসাধারণ পর্যবেক্ষণে প্রজ্ঞাবান কবির ঋদ্ধমনের পরিচয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই কবিতার শুরুতেই কবি বৈজ্ঞানিকের সূত্রের মতো বলেছেন: ‘মেঘের গল্প প্রথমত সমুদ্রের তলদেশ থেকে আসে”রর। সূত্র যাই হোক, কবির এই কাব্যিক চয়নে উল্লিখিত মেঘ এবং সমুদ্রের তলদেশকে মিলিয়ে দেখানোর প্রক্রিয়া পাঠককে শুরুতেই বিস্ময়ে ফেলে দেয়। কেননা মেঘ থাকে অনন্ত আকাশে বিস্তারিত, আর সমুদ্রের তলদেশ সে তো মানুষের পদতলের ভ‚মিতে গ্রথিত! কিন্তু সমুদ্র তলদেশও অনন্ত রহস্যে ঠাসা, শুধু তাই নয় সেখানে রয়েছে জীব-বৈচিত্র্যের সমাহার, রয়েছে ‘বালি ও লবণ’, ‘পাথর ও বরফের দাপট’, কবির ভাষ্যে পাই ‘পাথর ও বরফের দাপট শেষ হ’লে / জল এসে মেশে হাওয়ার সঙ্গে’ এবং ‘দু’বাহু বাড়িয়ে ডাকে: / ও সলোমন, তুই কোথায়’ররর? কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী এইখানে এসে যখনই হাওয়ায় মেশা জলের কণ্ঠস্বর নিয়ে বললেন-‘ও সলোমন, তুই কোথায়?’ তখন অনেকগুলি ভাব-ব্যঞ্জনা পাঠকের চেতনায় নাড়া দিয়ে যায়। কেননা, সলোমন নামটি এমনই ব্যঞ্জনাময় যে তার সাথে মহাকাব্যিক ইতিহাস বা অতিলৌকিক মিথের চরিত্রের সম্পর্ক রয়েছে। আসলে ইতিহাস ও মিথের মিশ্রণে জারিত ঋদ্ধপাঠকের পরিচিত সলোমন চরিত্রটি জীব-জগতের সকলের ভাষা হৃদয়ঙ্গম করতে পারতেন। কবিও জানতেন জল হয়ে হাওয়ার সঙ্গে মিশে গেলে তার কণ্ঠস্বর সেই সলোমন ছাড়া আর কে বুঝতে পারবে? তাই তিনি হৃদয়ের আবেগ দিয়ে সলোমনকে ডেকেছেন। কবি যত স্বাভাবিকভাবেই সলোমনকে ডাকুন না কেন সচেতন পাঠকের মনে-চেতনায় কবির সলোমন সম্বোধনে সহসা ঢেউ খেলে যায় প্রাচীন ইতিহাসের আলো। সলোমন ছিলেন দারুণ নবি ও বাথসেবার সন্তান। হিব্রæ বাইবেল অনুসারে তিনি ইসরায়েলের প্রথম এবং গুরুত্বপূর্ণ একজন রাজা ছিলেন।রা তাঁর জন্ম হয়েছিল আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১০১১ অব্দে এবং মৃত্যু আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৯৩১ অব্দে। কথিত আছে যে, সলোমনই জেরুজালেম নগরী প্রতিষ্ঠা করেন। ধর্মীয় বিশ্বাসমতে সলোমন ছিলেন পুরো বিশ্বের সম্রাট। খ্রিস্টপূর্ব ৯৭০-৯৩১ অব্দ পর্যন্ত টানা ৪০ বছর সলোমন পুরো পৃথিবী শাসন করেন। শুধু মানুষেরই নয় তিনি উদ্ভিদ ও প্রাণীকুলেরও সম্রাট ছিলেন, বুঝতেন মানুষ ছাড়াও পশু-পাখি ও জীবজগতের সকলের ভাষা।া ইতিহাসের সেই মহানায়ক সলোমনের নাম লোকায়তভঙ্গিতে কবিতায় গ্রন্থনের মাধ্যমে কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী অসাধারণ দক্ষতায় উন্মোচন করেছেন এ জগতের ‘সৃষ্টি-রূপ’ ও তার অন্তর্গত অন্ত্যমিল! কিন্তু কীভাবে? এই প্রশ্ন থেকে ‘উন্মোচন’ কবিতার পরবর্তী স্তরগুলো পাঠ করা যেতে পারে। কবির একান্ত অভিপ্সা প্রকৃতির বায়ুস্তরের মতো তিনি তাঁর ভাই সলোমনের সঙ্গে যাবেন ‘পুব থেকে পশ্চিমে’, এমনকি ‘উত্তর-দক্ষিণে’। এই অভিযাত্রার ভেতর তিনি নিশ্চিত ভাবেই জানেন ‘স্তরে স্তরে’ ফুটে উঠবে ‘কুসুমের কলি’, আর সেই সুযোগে তিনি ও তার ভাই সলোমন ‘মসলা-মেঠাই মেখে’ ‘ঝাঁপ’ দেবেন ‘তরুণীর গালে’। এই তরুণী আর কেউ নয়, পৃথিবীর ঊর্বরাশক্তির প্রতীক, প্রেমের প্রতীক, মায়া ও মমতার প্রতীক, এমনকি সন্তানবৎসল মাতৃত্বের প্রতীক। তাই তো মায়াময়ী ও কল্পনাপ্রবণ কবির লোকায়ত কামনা বলেছে ‘দৃষ্টি শুভ হোক, বৃষ্টি হোক / অসামান্য সুন্দরের চুলে।’ার এই যে ‘অসামান্য সুন্দরের চুলে’ গড়ে যাওয়া বৃষ্টির ব্যঞ্জনা! কবি তার ভেতর অবলোকন করেন গ্রামীণ জনপদের দৃশ্য-অদৃশ্যে গ্রথিত প্রাণী-প্রকৃতির বিচিত্র অনুষঙ্গ, যা থেকে বাদ পড়ে না ‘পিঁপড়ের চোখ’, ‘তেলাপোকার নোখ’, ‘হাঁস ও শালুক’। কিন্তু কবির চোখ শুধু মাটির দিকে থাকে না, তা পৌঁছে যায় ভ‚গোলের সীমাবদ্ধ গÐি পেরিয়ে দিগন্তে বিস্তৃত অস্থির মেঘের দিকে। তিনি তাই প্রশ্ন করেন: ‘ওরে মেঘ, তোর বুকে কে খলবল করে?’ারর এই জিজ্ঞাস্য থেকে কবি এবার বৃষ্টি ও মেঘের গল্পের আদ্যপ্রান্ত অবলোকন করেন। এপর্যায়ে কবি ভ‚গোল, আবহাওয়া ও ঋতু বিশেষজ্ঞের প্রতিভায় পুরো দক্ষিণ এশিয়াকে চারটি চরণের ভেতর গেঁথে ফেলে বলেন: ঘুরেফিরে বৃষ্টির গল্প মেঘে আর মেঘের গল্প হিমালয় হাঁটু মুড়ে জিরিয়ে বেলা বেড়ে-বেড়ে দার্জিলিং গ্যাংটক হয়ে ভরসন্ধ্যায় তেঁতুলিয়ায় পৌঁছলে এখানে মেঘদূতের কবি কালিদাসের মতো কবির অভিজ্ঞান পাঠককে আপ্লুত করে দিতে পারে। কিন্তু কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী ‘উন্মোচন’ কবিতায় বৃষ্টি ও মেঘের যে ভ‚গোল আবিষ্কার করেছেন তার সাথে তিনি কালিদাসের অধিক বাঙালির নিকটবর্তী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মেঘ ও বৃষ্টি বন্দনার সাদৃশ্য খুঁজে দেখতে চেয়ে প্রশ্ন করেছেন, তিনি পাঠকের দিকে অথবা নিজের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বুঝে নিতে চেয়েছেন- তাঁর এই ভ‚গোল আবিষ্কার আগেই রবীন্দ্রনাথের জানা ছিলো? কবি লিখেছেনÑ তিনি যেভাবে বৃষ্টি ও মেঘের ভ‚গোলকে চিনেছেন, জেনেছেন তার মতো ‘রবীন্দ্রনাথ কি সবকিছু জানতেন?’রী এই দ্বিধামিশ্রিত প্রশ্ন কবিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। এরপর কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী মেঘ ও বৃষ্টির ভ‚গোলের সাথে সামুদ্রিক ভ‚গোলের পাঠ এবং নারীর হাসিখেলা, ফসলের মাঠ, জঙ্গল ও নদী-হ্রদের ভ্রমণের গতিবিধির অনুসন্ধান করতে গিয়ে লিখেছেন:

... পুরি আর কক্সবাজার একই সমুদ্রের বাঁকে-বাঁকে যে নাম লেখে আর যেসব মেঘ এবং মেয়েরা হেসে-খেলে ফসলের মাঠ, জঙ্গল, নদী ও হ্রদের ভেতর দিয়ে যায় তাদের কি ভ্রমণের কোনো দিক-নিশানা থাকে? লক্ষণীয় বিষয়, প্রশ্ন থাকলেও কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর ভূগোলে সমুদ্র, নদী, হ্রদ, জঙ্গল, ফসলের মাঠ, মেঘ ও মেয়েরা একসূত্রে গাঁথা। কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী ‘উন্মোচন’ কবিতায় মেঘ-বৃষ্টি ও প্রকৃতির ভৌগোলিক জ্ঞানকে গ্রন্থন করতে গিয়ে যথাক্রমে তিনটি প্রশ্ন উপস্থাপন করেছেন: ১. ‘ওরে মেঘ, তোর বুকে কে খলবল করে?’ ২. ‘রবীন্দ্রনাথ কি সবকিছু জানতেন?’ এবং ৩. ‘তাদের কি ভ্রমণের কোনো দিক-নিশানা থাকে?’ উপর্যুক্ত প্রশ্নটির উত্তর অন্বেষণ করতে গিয়ে তিনি কবিতাটির শেষস্তবক রচনা করেছেন। এক্ষেত্রে শেষস্তবকের ৫টি চরণে অপূর্ব এক শৈল্পিক দক্ষতায় কবি তাঁর তিনটি প্রশ্নের সমাধান উপস্থাপন করে লিখেছেন: মেঘের গল্প, হাওয়ার গল্প, ভ‚মি ও পাথরের গল্প আগুন ও প্রাণের গল্পের সঙ্গে মিশে প্রকৃতি অভিন্ন গল্প তৈরি করে আর প্রকৃতি-ই স্তরে-স্তরে উন্মোচন করে সৃষ্টি-রূপ অনন্ত-অসীম, স্থিতি ও গতি, আস্থা ও শূন্যতা! কবির পর্যবেক্ষণ যতই সৃষ্টি আবেগের গ্রন্থনায় ঘটুক, তার সঙ্গে বৈজ্ঞানিকের দৃষ্টিভঙ্গি তীব্রভাবেই প্রত্যক্ষ করা যায়। কবি ‘অনন্ত-অসীম’-এর সৃষ্টি-রূপের অন্তর্গত বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করে সহসা বলে ওঠেন-‘প্রকৃতি-ই স্তরে-স্তরে উন্মোচন করে সৃষ্টি-রূপ’ আর প্রকৃতির গভীরে মূর্তমান রয়েছে সৃষ্টির ‘অনন্ত-অসীম, স্থিতি ও গতি, আস্থা ও শূন্যতা!’ কবির এই ভাষ্য অনেকটা বৈজ্ঞানিকসূত্রের মতো হলেও তা পবিত্র ধর্মগ্রন্থের ভাষার মতো রহস্যে পরিপূর্ণ তথা প্রোফেটিক। কবির কাজ যেমন দৃশ্যগত প্রকৃতির অন্তর্গত সত্যকে নতুন ব্যাখ্যায় অভিসিক্ত করা এবং পাঠকের চেতনায় চেনা দৃশ্যকে নতুনভাবে ব্যঞ্জনাময় করে তোলা। কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজীর এই কবিতাটি সেই বৈশিষ্ট্যে নিশ্চিতভাবেই অনন্য। পরিশেষে ‘উন্মোচন’ কবিতার সূত্র ধরে বিশেষকের বিবেচনায় স্পষ্ট করে বলা যায় যে, সৃষ্টি-রূপকে নতুনভাবে গ্রন্থন ও ব্যাখ্যার জন্য কবি হাবীবুল্লাহ সিরাজী অভিনন্দিত হবেন বারবার।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App