×

সাময়িকী

আলী ইমাম শিশুসাহিত্যের উজ্জ্বল লেখক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২০, ১০:০৬ পিএম

আলী ইমাম শিশুসাহিত্যের উজ্জ্বল লেখক

আলী ইমাম

আলী ইমাম এবং শিশুসাহিত্য- দুটোই সমার্থক। প্রায় ৫০ বছর ধরে নিরন্তর স্বপ্নবিলাসী শিশুসাহিত্য রচনার এক দক্ষ রাজকুমার তিনি। কেবলই শিশুমানস, শিশুজগৎ, শিশু কল্পনাকে ধারণ করে বহু বিচিত্র রচনা সম্ভারে সমৃদ্ধ করেছে তিনি বাংলা শিশুসাহিত্য। চিরায়ত রচনাভঙ্গি, ধ্রুপদ কাহিনী নির্মাণ এবং ক্লাসিকাল শিশুসাহিত্যের মর্মকে তিনি কর্মে রূপান্তর করেছেন। দেড় শতাধিক গ্রন্থের আয়নায় আলী ইমামকে প্রতিবিম্বিত করলে বিস্মিত হতে হয়। শিশুসাহিত্য জগতের যাবতীয় অনুষঙ্গ ও কলকব্জাকে সযতনে তিনি আত্মস্থ করেছেন। শব্দজালে বন্দি করেছেন মধুর ও বিধুর রূপকল্পনাকে। আলী ইমাম সেই বিরল বাক্য শ্রমিকদের একজন, ত্যাগ ও মোহের ছলনে যিনি শিশুসাহিত্যের ভঙ্গুর ও বেপথু পথ থেকে কখনোই সরে দাঁড়াননি। কমপ্লিট শিশুসাহিত্য বলতে যা বোঝায় আলী ইমাম তারই স্বয়ম্ভু প্রতীক। শুধুই অর্থহীন কল্পনার উড্ডীন ফানুস নয়, আলী ইমামের রচনা বাস্তব পৃথিবীর ধুলোকণাকেও স্পর্শ করেছে। আলী ইমামের মূল ক্ষেত্র গদ্য-রচনা। গল্প উপন্যাস ফিচার ভ্রমণকাহিনী বিজ্ঞানবিষয়ক রচনা নিবন্ধ-প্রবন্ধ-বিন্দু বিন্দু বহু রতœকণায় তিনি আমাদের শিশুসাহিত্যকে পত্র পুষ্প পল্লবে সজ্জিত করেছেন। আলী ইমাম নিজস্ব অবস্থান তৈরি করেছে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে। নিষ্ফলা, অনুর্বর, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত শিশুহীন, অভিভাবকহীন আমাদের শিশুসাহিত্যকে তিনি সাবালক করেছেন। অজস্র, অবিরাম, ক্লান্তিহীন রচনা তার। দূর লক্ষ্যপানে একাকী অভিলাষী যাত্রা তার। আলোর মশাল হাতে, গভীর ও সুপ্তি-ভাঙানিয়া, তিমির-বিদারী অভ্যুদয়ের সৈনিক তিনি। এক সামগ্রিক জীবন-মগ্নতায় শিশুচৈতন্যকে যিনি লালন করেন। তার মতো সার্থকনামা শিশুসাহিত্যকে সমগ্র বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষাপটেই খুঁজে পাওয়া ভার। দ্বিধাহীন বাক্যে লেখা যায়- আলী ইমাম এক মেবাদ্বিতীয়ম। শিশুসাহিত্য কী? শিশুসাহিত্য স্বাতন্ত্র্য কোনো বিষয় নয়। জীবন যদি শিল্পসাহিত্যের দর্পণ বা প্রতিচ্ছবি হয়। শিশুসাহিত্য এর ব্যতিক্রম নয়। সার্থক শিশুসাহিত্যে বড়রাও সমান আনন্দ পান। আবার শিশুকিশোর পাঠকেরাও আবহমান সাহিত্যের অনতিক্ষুদ্র বিচিত্র অংশের উত্তরাধিকারী। যেসব গ্রন্থ চিরকালের আনন্দ ভাণ্ডার ছোটদের অধিকার এবং দাবি সর্বাগ্রে সেখানেই। শিশুপাঠ্য রচনা তখনই উৎকৃষ্ট যখন তাতে সার্বজনীনতার স্বাদ থাকে। বাংলা শিশুসাহিত্যে সেই প্রেক্ষাপটে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রান্তে দুর্লক্ষণ কাটিয়ে উঠেছে। বিংশ শতাব্দীর সূচনায় স্বর্ণালি যুগের শুরু হয়। শুদ্ধ সরল স্বাচ্ছন্দ্য শিশুসাহিত্যের আকাশে দেখা দেয় রাঙা প্রভাতের হাতছানি। রাঙা প্রভাতের যারা কাণ্ডারি, তারা সংখ্যায় কম। গ্রন্থের প্রাচুর্য নেই, প্রকাশনা নয়ন মনোহর নয়। কিন্তু রচনার স্বাদু গুণে তা কালোত্তীর্ণ। এই সময়ের অধিকাংশ গ্রন্থই আজ বাংলা শিশুসাহিত্যের ক্লাসিক বলে গণ্য। শিশুরা ভবিষ্যৎ সমাজের অঙ্কুর। সেই আগামী দিনকে জ্ঞানে-কর্মে-মহত্তে¡ সর্বাঙ্গীণভাবে গড়ে তুলতে হলে তার জন্য বিপুলভাবে আয়োজন করা উচিত। অনাগত ইতিহাসের নেতৃত্ব যারা গ্রহণ করবে, পূর্ণ সার্থকতার দিকে লক্ষ্য রেখে তাদের মানসিক পুষ্টিসাধন করা প্রাথমিক কর্তব্য। অর্থাৎ সৎ ও প্রকৃত শিশুসাহিত্য গড়ে তোলা একটি সুকঠিন দায়িত্ব। তাদের উপযুক্ত আত্মিক বিকাশ ঘটাতে হলে এমন সুসাহিত্য রচনা করতে হবে, যা তাদের মনকে প্রসারিত। করবে, কল্পনাশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করবে, তাদের চরিত্রে একটি স্থায়ী প্রভাব মুদ্রিত করে দেবে। স্বপ্ন কল্পনায় গড়া আবেগে উচ্ছসিত, নব প্রাণে আনন্দে চঞ্চল এসব শিশুর মর্মকোষে যে রহস্য লুকানো রয়েছে তা অনন্ত আকাশের মতোই বিরাট ও বিচিত্র। মানস আকাশে কল্পনার যে রঙধনু ফুটে ওঠে তাকে তুলির রেখায় জাগিয়ে তোলা শক্তিমান শিল্পী ব্যতীত অসম্ভব। শিশুসাহিত্যের জন্য প্রয়োজন শক্তিমান ও সহানুভ‚তিশীল লোক, উৎকৃষ্ট সাহিত্য রস এবং সর্বোপরি চরিত্র গঠনের উপযুক্তনীতি বিন্যাস। নীতিকে শুষ্ক উপদেশে পর্যবসিত না করে আনন্দের মোড়কে মুড়ে দেয়া শিশুসাহিত্যিকের প্রধান কৃতিত্ব। শিশুরা আনন্দের স্বাদ গ্রহণ করে, উপদেশ তার রক্তধারায় নিঃশব্দে স্বাস্থ্য সঞ্চার করে দেয়। শিশুসাহিত্য ধারণ করে বহুবিচিত্র বিষয়। এই সাহিত্যের মধ্যে থাকে প্রতীক, কল্পনার মুক্তি এবং ইতিহাসের ক্ষীণ ছায়া। শক্তি ও সাহস, সত্যের প্রতি আনুগত্য বাসনা হচ্ছে মৌল বিশ্বাস। শুধু গল্প-কবিতা-ছড়াই নয়- ইতিহাস, বিজ্ঞান ও জীবনের নানাবিধ জিজ্ঞাসা সব নিয়ে শিশুসাহিত্যের সামগ্রিক আয়োজন। জীবন ও প্রকৃতির সৌন্দর্য সন্ধান এবং ন্যায় ও মূল্যবোধ এই নিয়ে যে স্বতন্ত্র শিল্পরূপ গড়ে ওঠে, তাই শিশুসাহিত্য। বাংলা শিশুসাহিত্য সৌভাগ্যবান সূচনা পর্বেই অসম্ভব শক্তিমান লেখকেরা এর ভিত্তি নির্মাণ করেন। যাদের হাতে শিশুসাহিত্য পুষ্টি অর্জন করেছে, যাদের হাতে ক্ষীণকায়া নিঝরিণী পরিপূর্ণ স্রোতস্বিনীর মতো ভরে উঠল তারা হচ্ছেন- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী, সুকুমার রায়, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার। এছাড়া পরবর্তীতে জগদানন্দ রায়, নবকৃষ্ণ ভট্টাচার্য, যোগীন্দ্রনাথ সরকার, সুনির্মল বসু, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, কার্তিকচন্দ্র দাশগুপ্ত, ধনগোপাল মুখোপাধ্যায়। তাদের সোনালি স্পর্শে বাঙালি শিশুর সম্মুখে উন্মুক্ত হলো অনুপম এক রাজভাণ্ডার। এই লেখকেরা পৃথিবীর যে কোনো ভাষার বড় লেখকদের সমকক্ষ। হয়তো তারা আরো খ্যাতি গৌরবের অধিকারী হতেন। আলী ইমাম বাংলা শিশুসাহিত্যের উত্থান পর্বের এই সকল প্রাতঃস্মরণীয় লেখকদের স্রোতবাহী পথের দক্ষ রূপযাত্রী। বাংলা শিশুসাহিত্যের ক্লাসিক ঘরানার তিনি একজন সার্থক উত্তরাধিকারী। আলী ইমামের বিপুল রচনাশৈলী তাই ব্যাপক ও বিস্তৃত আলোচনার অপেক্ষা রাখে। আলী ইমাম দুই শতাধিক গ্রন্থ লিখেছেন। গ্রন্থের নামকরণের তালিকার দিকে তাকালেই বোঝা যাবে কত বিচিত্র ও অভিনব বিষয়বস্তুকে তিনি ধারণ করেছেন। উপন্যাস লিখেছেন, ছোটগল্প লিখেছেন, ছড়া-কবিতা লিখেছেন, জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিচিত্র কথকতায় পরিপূর্ণ তার সাহিত্যভাণ্ডার। তিনি ছোটদের জন্য আনন্দের মৌচাক নির্মাণ করেছেন। প্রকৃতি প্রেম ও গভীর মমতা তার যে কোনো রচনাকে বরণীয় করে তুলেছে। ভাষা ভঙ্গি অনুপম, একেবারেই নিজস্ব। গদ্যরীতি- সুরেলা ঝংকৃত এবং হৃদয়ের পরশ বুলানো। ইতিহাস ঐতিহ্য, দেশপ্রেম, প্রকৃতি বৃক্ষলতা, পাখি গ্রামবাংলা নগরজীবন কৌত‚হলী জগৎ, অ্যাডভেঞ্চার রহস্য, ফিকশন, সায়েন্স ফিকশন, কাব্যসুষমা, ছড়ার ধ্বনি, রোমান্টিকতা কী নেই আলী ইমামের রচনায়! ছোটদের জগতের সার্থক রূপকার তিনি। অবিশ্রান্ত লেখনী তার। টানা ৩৫ বছর ধরে বিরামহীনভাবে লিখে চলেছেন। প্রকাশনার প্রতি তার অবিমিশ্র প্রেম। বিষয় বৈচিত্র্যের প্রতি তার আকণ্ঠ নিমজ্জন। সকল ধরনের বিষয়কেই তিনি তার জাদুকরি গদ্যের মাধ্যমে অক্ষরমালায় বন্দি করেছেন। আলী ইমামের সমগ্র শিশুসাহিত্যের গতিরেখা সামান্য আলোচনায় তুলে ধরা অসম্ভব। তবে জসীমউদ্দীন, হাবীবুর রহমান, ফয়েজ আহমদ, রোকনুজ্জামান খান, আতোয়ার রহমান, মোহাম্মদ নাসির আলী, হোসনে আরা, বন্দে আলী মিয়ারা যে ভিত্তিভূমি রচনা করেছেন আলী ইমাম তারই সার্থক উত্তরাধিকার। প্রায় নিঃসঙ্গ পথিক আলী ইমাম। বিষয়বস্তুর অভিনবত্বে, অন্তর্নিহিত ভাবের দ্যোতনায় তার অধিকাংশ রচনাই সার্থক প্রয়াস। তার শিল্পিত মানস পরিস্ফুট হয়েছে দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধের মাধ্যমে। শিশুর জগৎ হচ্ছে উত্তঙ্গ কল্পনার জগৎ। শিশু মানস অস্থির ও চঞ্চল। তার কৌত‚হল আকাশের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত। আলী ইমামও অসীমের পানে কল্পনার অভিযাত্রী। তাই যখন যা খুশি, যা নতুন, যা আগ্রহী করে তোলে শিশুদের সেসব প্রায় প্রতিটা বিষয় নিয়ে তিনি লিখেছেন। তিনি পাখিদের প্রতি মমতা ও দরদি মনে লিখেছেন প্রায় ২০টি বই। অপর পরিবেশ, সাহিত্য, বিখ্যাত মানুষদের জীবন কথা, পদার্থ, চলচ্চিত্র, রসায়ন, জীববিজ্ঞানের জটিল বিষয়সমূহকে উত্থাপন করেছেন সহজ ও অনাড়ম্বরভাবে। সমগ্র বাংলা শিশুসাহিত্য বিবেচনায় রেখেই বলা যায় আলী ইমাম একজন বড় মাপের লোক। সবাই শিশুসাহিত্যিক হতে পারেন না। ছোটদের জন্য লিখলেই শিশুসাহিত্যিক হওয়া যায় না। ছোটদের মন জয় করা সহজসাধ্য নয়।

আলী ইমাম সেই লোক যিনি ছোটদের মন জয় করেছেন। যিনি শিশুসাহিত্যিকদের শিশুসাহিত্যিক। আমাদের বিরল সৌভাগ্য এক অরাজক সময়ে, মূল্যবোধহীন, নীতিহীন এক দুঃসময়ে আলী ইমাম স্বপ্ন কল্পনার এক নিশান উড়িয়ে মুগ্ধ করেছেন আমাদের। পতনশীল এক সমাজ ব্যবস্থায় আলী ইমাম একক এ অপরিমেয় পরিশ্রমে আমাদের শিশুসাহিত্যকে মুক্তি দিয়েছেন। আলোর ঝরনাধারায় স্নাত করেছেন আমাদের গ্লানিমা ও কালিমাকে। তিনি সেই রাজহংসÑ যিনি ক্লেদ ও ঘর্ম থেকে মুক্ত। কেবল শিশুদের জন্য আনন্দনগর নির্মাণেই ব্যস্ত রয়েছেন। সোনার কাঠি, রূপার কাঠি নিয়ে রূপকথার বন্ধ অর্গল যিনি খুলেছেন। যিনি বঙ্গোপসাগরের ধুধু বাতাসকে প্রবেশ করিয়েছেন আমাদের দূষিত ফুসফুসে। আলী ইমাম আমাদের মানসিক বিকাশে সাহায্য করেছেন। জুগিয়েছেন মনের পুষ্টি। আমাদের অবহেলিত উপেক্ষিত শিশুসাহিত্যের মরুভ‚মে তিনি বারিবর্ষণ। আলী ইমামের রচনাশৈলী অসংখ্য বলেই মনোযোগ পাঠকদের কাছে কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ রচনা উপেক্ষিত থেকেছে। সমালোচকদের মনোভঙ্গিও তিনি জ্ঞাত হননি। অনাদর এবং উপেক্ষা থাকলেও গত ৩০ বছর শিশুকিশোর পাঠকরা তার হৃদয়ের কাছাকাছি আছে। এখানেই তিনি সার্থক। পাঠকরা তাকে বঞ্চিত করেনি। শিশু পাঠকরা সমালোচক নয় তারা আত্মপ্রচার সার্থক নয়। এ কারণেই শিশুসাহিত্যিকরা সামাজিকভাবে উপেক্ষিত হন। কারণ তাদের ভালোবাসার সন্তানেরা নবীন ও শিশু। আলী ইমামের ভালোবাসার সন্তানেরা তাকে হৃদয় ও মন দিয়ে চিরদিন গ্রহণ করেছে। পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখেও প্রমাণ করা যাবে না যে, আলী ইমাম কত বড় সাহিত্যিক। আবার এক কলম না লিখেও সহজেই বোঝা যাবে আলী ইমাম কত বড় লোক। কারণ তার সমগ্র রচনার মধ্যেই দীপ্যমান হয়ে আছেন তিনি। বইগুলো তার কথা কয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App