×

মুক্তচিন্তা

নির্বাচনের পারা না-পারা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০২০, ১১:৩৪ পিএম

নির্বাচন যে কী করতে পারে না-পারে তার পরিচয় তো আমাদের দেশের ইতিহাসেই লেখা হয়ে রয়েছে। ১৯৪৫-এ বাংলায় প্রায়-বিপ্লবী পরিস্থিতি বিরাজ করছিল, তাকে সামলাবার জন্য যে পদক্ষেপগুলো নেয়া হয়েছিল তার মধ্যে সবচেয়ে অধিক কার্যকর হয়েছে নির্বাচন। সেই নির্বাচনে কংগ্রেস ও লীগের মধ্যে বিরোধিতাটা তীব্র হলো, মারাত্মক হয়ে দেখা দিল দাঙ্গা এবং পরিণতিতে ১৯৪৭-এর মর্মান্তিক দেশভাগের ঘটনা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়াল। এরপরে ১৯৫২তে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আবার বিক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছিল। তার মোকাবিলা করা হয় ১৯৫৪ সালের নির্বাচন দিয়ে; নির্বাচনের পরে বিজয়ী যুক্তফ্রন্টের দুই পক্ষের ভেতর ঝগড়া বাধিয়ে দিয়ে পথটা প্রশস্ত করে দেয়া হয়েছিল সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের জন্য। এলো আইয়ুবের সামরিক শাসন। আইয়ুবী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের পরিণতিতে আইয়ুবেরই দোসর (তবে তার তুলনায় অনেক নিকৃষ্ট) ইয়াহিয়া খানের যে সামরিক শাসন জারি করা হয় সেই শাসনের কর্তারা নির্বাচন দিয়ে ভেবেছিল মানুষকে বিভক্ত করে ক্ষমতায় টিকে থাকা যাবে। নির্বাচনের পরিণামে ঘটেছে গণহত্যা। ঘটনার এই প্রবাহের সারমর্মটা হলো এই যে, নির্বাচন বিদ্যমান শোষণমূলক ব্যবস্থাকে রক্ষা করার কাজটাই সম্পন্ন করেছে। তাকে বদলাতে চায়নি। তা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরও নির্বাচন তো আমরা কম দেখলাম না, কিন্তু পরিবর্তন যতটুকু হয়েছে তা নামের এবং ক্ষেত্রবিশেষে পোশাকের, ভেতরে ভেতরে যা ঘটেছে তা হলো আমলাতন্ত্রের সাহায্যে দুরন্ত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার নিরন্তর শক্তি সংগ্রহ। আর অধুনা তো লোকদেখানো ওই পোশাকি পরিবর্তনটুকুও ঘটছে না; যে দল ক্ষমতায় রয়েছে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তারাই রয়ে যাওয়ার বৈধতা অর্জন করছে। তা সে নির্বাচন যে ধরনেরই হোক না কেন। নির্বাচনের পরে কয়েকটি উপনির্বাচনও হয়েছে, তাতেও ওই একই ঘটনা। ক্ষমতাসীনরাই জিতে এসেছে। অতিসম্প্রতি দুটি উপনির্বাচনের নির্ঝঞ্ঝাট সমাপ্তি শেষে আমাদের প্রধান নির্বাচন কমিশনার বেশ গর্ব করেই বলেছেন যে, ‘ভোট গণনার ব্যাপারে আমেরিকার উচিত আমাদের কাছ থেকে শিক্ষা নেয়া; তারা যেখানে চার-পাঁচ দিনেও কেন্দ্রের ফল দিতে পারে না, আমরা সেখানে চার-পাঁচ মিনিটেই কেন্দ্রের ফল জানিয়ে দিয়েছি।’ ইচ্ছা করলে তিনি অবশ্য শিক্ষার জন্য আরো ক্ষেত্র চিহ্নিত করতে পারতেন; যেমন এমনকি একজন ভোটার না এলেও কেমন করে অর্ধেকের বেশি আসনে ক্ষমতাসীনরা জিতে যায়, অথবা মধ্যরাতে, ভোটারের উপস্থিতি ছাড়াই, কীভাবে নির্বাচনের কাজ নির্বিঘেœ সুসম্পন্ন করা সম্ভব হয়, সেসব বিষয়কে। ফেসবুকে আজকাল অনেক রকম মন্তব্য আসে; শুনলাম একজন লিখেছে, প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটাও বলতে পারতেন যে আমেরিকাতে যেখানে ভোটের অনেক দিন পরও ঘোষণা আসে না কোন দল জিতেছে, বাংলাদেশে সেখানে নির্বাচনের পাঁচ বছর আগেই নিশ্চিন্তে বলে দেয়া সম্ভব কারা জিতবে। আমেরিকার বেলাতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অবশ্য আগেই বলে রেখেছিলেন যে নির্বাচনের চ‚ড়ান্ত ফল আদালতে নির্ধারিত হবে। শেষ পর্যন্ত অতদূর গড়াল না। কারণ সর্বোচ্চ আদালতটিকে যদিও তিনি তার দল-মনোনীত বিচারকদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়ে পূর্বাহ্নেই ঠিকমতো সাজিয়ে রেখেছিলেন, তবুও মামলা ওই পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলো না। স্থানীয় আদালতই মামলা খারিজ করে দিল এবং অন্তত পেনসেলভিনিয়ায় কারচুপি হয়েছে বলে সাক্ষী দেয়ার মতো ডাক বিভাগের যে একজন কর্মচারীকে জোগাড় করা হয়েছিল তিনিও আমাদের দেশের জজ মিয়াটি হতে রাজি হলেন না। আশ্চর্য ঘটনা আরো আছে। বিরোধী দল নয়, স্বয়ং প্রেসিডেন্টই অভিযোগ এনেছেন যে নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। আমাদের জন্য বিস্ময়ের ব্যাপার এটাও যে, নির্বাচনের দায়িত্বে নিয়োজিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো বলেছে সরকারের দাবি মিথ্যা, কারচুপির একটি ঘটনাও ঘটেনি। ট্রাম্প যদি খাঁটি বাপের বেটা হন তবে এরাও কিন্তু কম যান না, যা সত্য বলে জানেন তাই বলে নিয়েছেন; প্রেসিডেন্টের রাগ-অনুরাগের তোয়াক্কা করেননি। ট্রাম্প সাহেব প্রেসিডেন্টের রাষ্ট্রীয় বাসভবনেই সংবাদ সম্মেলন করে ঘোষণাটা দিয়েছিলেন যে তার বিজয় চুরি হয়ে গেছে। ঘোষণা দিয়েই তিনি আর কালক্ষেপণ করেননি, দ্রæত সম্মেলন স্থল থেকে প্রস্থান করেছেন। সাংবাদিকদের তিনি হাড়ে হাড়ে চেনেন, তারা যে প্রমাণ দিন প্রমাণ চাই বলে তেড়ে আসবেন তা তিনি বিলক্ষণ জানতেন, তাই নিজেকে তাদের নাগালের ভেতরেই রাখেননি, নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিয়েছেন। তাতে অবশ্য প্রেসিডেন্ট সাহেবের শেষ রক্ষাটা হয়নি। ওই সাংবাদিকরা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন যে প্রেসিডেন্ট সাহেব যা বলেছেন তার কোনো প্রমাণ তিনি হাজির করেননি। যেসব টেলিভিশন চ্যানেল সরাসরি সংবাদ সম্মেলনে তার ঘোষণাটি প্রচার করছিল তাদের মধ্যে তিনটি মধ্যপথেই ক্যামেরা গুটিয়ে ফেলেছে, ভাবখানা এমন যে এতটা মিথ্যাচার ক্যামেরাও সইবে না। বলা হচ্ছে আমেরিকার নির্বাচনে একটি মস্তবড় ঘটনা ঘটেছে। ঐতিহাসিকই বলা চলে, কারণ আগে এমনটা কল্পনা করাও কঠিন ছিল। সেটা হলো এই যে, এই প্রথমবার একজন নারী, প্রেসিডেন্ট না হোন, অন্তত ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। তার চেয়েও বড় কথা, ওই নারী দেখতে সাদা নন, কৃষ্ণ বর্ণের। এবং আরও আছে। তার মা ভারতীয়। নির্বাচিত হয়ে কমলা হ্যারিস বলেছেন যে, তার মা যখন আমেরিকাতে এসেছিলেন তখন মা জানতেন যে এ হলো অপার সম্ভাবনার এক দেশ, এবং কমলাকে যদিও কৃষ্ণাঙ্গদের স্কুলেই এবং বর্ণবাদী পরিবেশেই পড়াশোনা করতে হয়েছে তবুও তার মা তাকে শিখিয়েছিলেন যে অধ্যবসায় থাকলে এখানে অনেক কিছু অর্জন করা সম্ভব। তার কৃষ্ণাঙ্গ পিতা এবং ভারতীয় মাতার মধ্যে যখন ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় কমলার বয়স তখন পাঁচ, এর পরে মা একাই তাকে লালনপালন করেছেন এবং মা তার সন্তানের যে উন্নতির স্বপ্ন দেখতেন বাস্তবে তার চেয়ে বেশিই ঘটেছে। সেটা ঠিক। কিন্তু কমলা আর কতদূর যাবেন? শুরুতে ডেমোক্রেটিক পার্টি থেকে প্রেসিডেন্ট মনোনয়ন প্রার্থী হয়ে প্রতিযোগিতার কালে তিনি জো বাইডেনের বিস্তর সমালোচনা করেছিলেন, কিন্তু পরে তিনি তার সহযাত্রী হয়ে তবেই ভাইস প্রেসিডেন্ট হতে পেরেছেন। ওই পদের জন্য যখন মনোনয়ন পেলেন তখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার স্বাভাবিক বাচালতায় টুইট করে মন্তব্য করেছিলেন যে, কমলা একজন বিপজ্জনক মহিলা। নিতান্ত মিথ্যা বলেননি। নির্বাচনী প্রচারে নেমে কমলা হ্যারিস ট্রাম্পের যতটা ক্ষতি করেছেন ট্রাম্পের স্ত্রী ও কন্যা একত্র হয়ে প্রচারে নেমেও তা পূরণ করতে পারেননি। কমলা যে তার জন্য অসুবিধার কারণ হবেন ট্রাম্প সাহেবের এই অনুমান নির্ভুলই ছিল। জাত ব্যবসায়ী, প্রেসিডেন্ট হয়েও লাভ-লোকসানের হিসাব কীভাবে করতে হয় সেটা ভোলেননি। কমলা হ্যারিসের ভেতর এক ধরনের বিদ্রোহ আছে। এই মহিলা তার পরিস্থিতি ও পরিবেশকে হটিয়ে এবং ছাপিয়ে উঠেছেন। অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। প্রেসিডেন্ট পদের জন্যই তিনি প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন; প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আর এগোতে পারবেন না দেখে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন; পরে জো বাইডেন তাকে কাছে টেনে নিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী করে, তিনিও সম্মত হয়েছেন সানন্দে। এবং বলেছেন বাইডেনের পিতৃ-স্নেহপ্রাপ্তিতে তিনি কৃতার্থ; বলেছেন দুজনের সম্পর্কটা হবে পিতা-কন্যার। বিদ্রোহটা কিন্তু ওই পর্যন্তই। এর বেশি এগোলে তিনি সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়তেন। তা তিনি যে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের পক্ষে বলেন এবং বলা যে অব্যাহত রেখেছেন সেটাই বা কম কিসে? পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পাশে দাঁড়ালে তার উচ্চতাটা অধরা থাকে না। কমলার নির্বাচনের পরে মোদি অবশ্য বলেছেন কমলা ভারতীয় নারীদের জন্য গর্বের বিষয়; কিন্তু নির্বাচনের সময় তিনি নিশ্চয়ই কমলা হ্যারিসের জয় চাননি, কারণ তার বন্ধুত্বটা বাইডেনের সঙ্গে নয়, ট্রাম্পের সঙ্গেই। হরিহর আত্মা তারা, দুজনে দুজনকে চিনেছিলেন, লোকে বলেছে রতন চিনেছে রতনকে। নির্বাচনের বছরখানেক আগে খোদ আমেরিকাতেই ভারতীয়দের এক সভাতে তিনি দুহাত তুলে উঁচু গলায় আওয়াজ দিয়েছিলেন, ‘আরেক বার ট্রাম্প সরকার’। ট্রাম্প সাহেব নিজেও উপস্থিত ছিলেন ওই সভাতে, ভারতীয়দের ভোটের আশাতে। তিনিও উঠে দাঁড়িয়ে সহাস্য-বদনে মোদিকে বন্ধু বলে সম্বোধন করেছেন। প্রতিক্রিয়াশীলরা অবশ্য এভবেই জোট বাঁধে। যেন রক্তের বন্ধন। কাশ্মিরে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে বলে কমলা আগেই মন্তব্য করে রেখেছেন। মোদি যে কমলাকে হিন্দু বলবেন এমন উপায়ও নেই। কারণ কমলার মা বিয়ে করেছিলেন একজন কৃষ্ণাঙ্গ অহিন্দুকে এবং কমলা নিজেও যাকে বিয়ে করেছেন তিনি ইহুদি বংশোদ্ভ‚ত আমেরিকান। তবে কমলা দক্ষিণ এশীয় ও কৃষ্ণাঙ্গ, তার এই দুই পরিচয়ের কোনোটিকেই অস্পষ্ট রাখতে চান না; বরং গর্বের সঙ্গেই সে পরিচয় ঘোষণা করে থাকেন। যেটাকে তার বিদ্রোহ-স্পৃহার প্রকাশ বললে হয়তো ভুল বলা হবে না। তবে সেটা ব্যক্তিগতই, তার বেশি নয়; সমষ্টিগত বিদ্রোহের সঙ্গে তার কোনো সংযোগ নেই। ঢেউ যেমন মিশে যায় ঢেউয়ের সঙ্গে তিনিও তেমনি মিশে গেছেন ভদ্র, প্রায়-রক্ষণশীল ও পুরোপুরি পিতৃতান্ত্রিক জো বাইডেনের সঙ্গে। আমেরিকাতে বিভিন্ন পর্যায়ের নির্বাচনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভ‚তরাও দাঁড়িয়ে থাকেন; কয়েকজন এবারো দাঁড়িয়েছিলেন। দুজন দেখলাম প্রতিনিধি সভায় নির্বাচিতও হয়েছেন। আমাদের পত্রপত্রিকায় তাদের বিজয় সংবাদ সগর্বে ছাপা হয়েছে। কিন্তু তারা যে একই পার্টির হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তা কিন্তু নয়, অনেকেই হয়তো ধরে নিয়েছিলেন যে দুজনেই ডেমোক্রেট হবেন, কারণ রিপাবলিকানরা তো বর্ণবিদ্বেষী। কিন্তু দুজনের একজন দেখা যাচ্ছে বর্ণবাদী রিপাবলিকান পার্টিরই সদস্য। ঘটনাটা কিন্তু মোটেই অস্বাভাবিক নয়, কারণ বাংলাদেশীয় তথা দক্ষিণ এশীয়দের মধ্যেও অনেক মানুষই আছেন যারা রক্ষণশীল। পুঁজিবাদী উন্নতির ধারা থেকে তারা ছিটেফোঁটা সুবিধা ইতোমধ্যে পেয়েছেন, আগামীতে আরো পাবেন বলে আশা রাখেন। ডেমোক্রেটিক পার্টি যে পুঁজিবাদবিরোধী তা মোটেই নয়, তবে তাদের তুলনায় রিপাবলিকানরা একেবারে খাঁটি বান্দা। খাঁটি জিনিসের নিশ্চয়ই আকর্ষণ আছে। এমনকি বর্ণবাদের শিকার যে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী তাদের ভেতরেও যে রিপাবলিকান নেই এমন তো নয়। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App