×

মুক্তচিন্তা

করোনার নতুন ধরনে ‘আক্রান্ত’ প্রবাসী শ্রমিক!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর ২০২০, ১০:৩৫ পিএম

পৃথিবীতে যখনই কোনো সমস্যা বা সংকট তৈরি হয়, তার একটা অনিবার্য ভুক্তভোগী হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষ। দেশের বিবেচনায় অনিবার্য ভুক্তভোগী হচ্ছে অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশ। আর মানুষের বিবেচনায় শ্রমজীবী এবং নিম্নবিত্তের মানুষ। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার ক্ষেত্রে যেমন এ থিওরি প্রযোজ্য, আবার কোনো মহামারি হলেও তার অনিবার্য ভুক্তভোগী সেই শ্রমজীবী এবং নিম্নবিত্তের মানুষ। এটা এখন আরো প্রকট হয়ে হাজির হয়েছে, কেননা পুঁজিবাদের বিকাশের সূত্র ধরে মুনাফা যেখানে সবকিছুর নির্ধারকের কর্তৃত্ব গ্রহণ করে, সেখানে সমাজের ধনবাদী এবং পুঁজিপতিরা সমস্যা ও সংকটের হয়তো হয় সুবিধাভোগী নয় তুলনামূলক কম ভিকটিমস। এবং এটাই স্বাভাবিক। অন্যদিকে সমাজের খেটে খাওয়া মানুষ, শ্রমজীবী মানুষ, নিম্নবিত্তের মানুষ এবং নিম্নবর্গের মানুষ সব সংকট ও সমস্যার অনিবার্য ভোক্তা এবং গ্রহীতা। এটাই পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং মুনাফামুখী সমাজ ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠিত রীতি, অনুশীলন এবং ব্যাকরণ। আর সে কারণেই করোনা ভাইরাসের প্রবল আক্রমণে বিশ্বব্যাপী সমাজের নিম্নবিত্তের মানুষরাই সর্বাধিক আক্রান্ত এবং মৃত্যুর মিছিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। সমাজের শ্রমজীবী এবং নিম্নবিত্তের মানুষ তাদের সর্বস্ব হারিয়ে রীতিমতো পথে বসার জোগাড়। মার্চের পর থেকে করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচার জন্য যখন ‘স্টে হোম’ বা ‘ঘরে থাকার প্রেসক্রিপশন’ দেয়া হলো, তখন থেকেই এসব শ্রমজীবী মানুষ ‘ঘর’ আর ‘বাহির’-এর মধ্যে কানামাছি খেলে করোনা মোকাবিলা করেছে। কেননা যার ঠিকমতো ঘরই নেই, তার জন্য ‘স্টে হোম’ তো মশকরার শামিল! ফলে এ মোকাবিলায় যে হেরেছে, সে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে, আর যে জিতেছে সে এখনো ঠিকে আছে শারীরিকভাবে কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে রীতিমতো পঙ্গু হয়ে গেছে। এ পঙ্গুত্ব থেকে কবে সে মুক্তি পাবে তার কোনো হিসাব-নিকাশ নেই। মরার করোনা না মেরেও যেন রীতিমতো মেরে ফেলেছে। অনেকে অর্ধাহারে, অনেকে অনাহারে জীবনযাপন করছে। আর এ ‘ভাতে-মারা’র করাতে সবচেয়ে বেশি কাটা পড়ছে প্রবাসী শ্রমিক। বিশেষ করে যারা করোনার কারণে দেশে ফিরেছে কিন্তু আর বিদেশ যেতে পারছে না।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনে করোনা ভাইরাস প্রথম শনাক্ত হলেও করোনার আবির্ভাবের কারণে বিশ্বব্যাপী লকডাউন শুরু হয় ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি এবং মার্চ থেকে। আর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের লকডাউন শুরু হলে লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে দেশে ফিরে আসে। দেশে এসে কোনো কাজ নেই, কর্ম নেই। করোনায় বিপর্যস্ত সবকিছু। তাই একটা একটা করে দিন গুনছিল। কবে অবস্থা স্বাভাবিক হবে। আবার কবে বিদেশে যেতে পারবে। বউ-বাচ্চা, বাবা-মার মুখে হাসি ফুটাতে পারবে। নিজের জীবনের একটা গতি আনতে পারবে। আর প্রবাসী শ্রমিকদের একটা বড় অংশ হচ্ছে সৌদি আরব থেকে আসা। তাই আগস্ট-সেপ্টেম্বর থেকে যখন আস্তে আস্তে বিভিন্ন দেশের আকাশ পথ খুলে দেয়া হলো, দেশে আটকে পড়া এসব প্রবাসী শ্রমিক আবার বিদেশ যেতে শুরু করে। ফ্লাইট চলাচল শুরু হওয়ার পর এখনো পর্যন্ত প্রায় ২ লাখ শ্রমিক বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে, তার মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শ্রমিক গেছে সৌদি আরবে। আর যেসব সৌদি ফেরত শ্রমিক বাংলাদেশে আটকে পড়ে আছে তারা আবার সৌদি আরবে ফিরে যাওয়ার জন্য বহু কষ্টে সব ধরনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। উচ্চমূল্যে টিকেটের ব্যবস্থা করা। করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট সংগ্রহ করা। ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধি করা কিংবা নতুন ভিসা গ্রহণ প্রভৃতি করতে গিয়ে জান যাওয়ার জোগাড়। তারপরও সব বাধা-বিপত্তি পার হয়ে যখনই সৌদি আরবে যাওয়ার প্রস্তুতি প্রায় শেষ করেছে, তখনই পড়েছে মড়ার উপর খাঁড়ার এক ঘা। এরই মধ্যে খবর এলো করোনার নতুন ধরন পাওয়া গেছে যুক্তরাজ্যে। এবং ইতোমধ্যে ইতালি এবং নিউজিল্যান্ডেও এর অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এবং বলা হচ্ছে করোনার এ ধরন আগেরটার চেয়ে অধিক শক্তিশালী এবং ৭০ গুণ বেশি সংক্রমের শক্তি রাখে! ফলে ইউরোপের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু মাঝখান দিয়ে কপাল পুড়ল সৌদিগামী প্রবাসী শ্রমিকদের। করোনা ভাইরাসের নতুন ধরন পাওয়া যাওয়ার পর সৌদি আরব পৃথিবীর সব দেশের সঙ্গে বিমান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে করোনা ভাইরাসের নতুন ধরন বাংলাদেশে এখনো না এলে আক্রান্ত হয়েছে বাংলাদেশে আটকে পড়া সৌদি আরবগামী হাজার হাজার প্রবাসী শ্রমিক। কেননা সৌদি সরকারের এ সিদ্ধান্তের কারণে অনিশ্চয়তায় পড়ে গেল বাংলাদেশে সাময়িক সময়ের জন্য ফিরে আসা এবং আটকে পড়া হাজার হাজার সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিক। যাদের সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে, তারা পড়ে যাবে একটা বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি।

এখানে উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশ একটি অন্যতম শ্রমিক সরবরাহকারী দেশ হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। পৃথিবীর প্রায় ১৭৩টি দেশে বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটিরও অধিক অভিবাসী শ্রমিক কর্মরত আছে। তাদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশাক্তি। এমনকি এই করোনাকালেও শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ভেঙে পড়তে দেয়নি। তাই বর্তমানে বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে হয়েছে ৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এভাবেই শ্রমিকদের ঘামে এবং শ্রমে গড়ে উঠেছে এ দেশের অর্থনীতি। আর সৌদি আরব বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার। বর্তমানের প্রায় ২২ লাখ শ্রমিক সৌদি আরবে প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে কর্মরত আছে, যার একটা উল্লেখযোগ্য অংশ করোনাকালে কাজকর্ম বন্ধ থাকায় দেশে ফিরে আসে। কিন্তু এখন কাজে ফিরতে গিয়ে নতুন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে চরম অনিশ্চয়তার মুখে। সৌদি আরবের পাশাপাশি আরো অনেক দেশ থেকে করোনার কারণে দেশে ফিরে আসা প্রবাসী শ্রমিকরা নতুন করে আটকে পড়ছে করোনা ভাইরাসের এ নতুন ধরনের আবিষ্কারের কারণে।

পরিশেষে বলব, করোনা ভাইরাসের নতুন ধরনের দ্রæত সংক্রমণের সক্ষমতা বিবেচনা করে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সৌদি সরকার সব দেশের সঙ্গে সব ধরনের বিমান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। এটা সৌদি সরকারের এখতিয়ার এবং সে কারণেই এ বিষয়ে কারো খুব একটা কিছু করার নেই। কিন্তু এসব প্রবাসী শ্রমিক যারা এ দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি তাদের পাশে সরকারকে দাঁড়াতে হবে। আমরা জানি যে, করোনা ভাইরাসের শুরুতেই সরকার অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা এবং দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিয়ে বিভিন্ন সেক্টরের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক প্রণোদনা ঘোষণা করেছিল। সেখানে প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য বরাদ্দ ছিল প্রায় ৭০০ কোটি টাকা। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য বরাদ্দ ৭০০ কোটি টাকার মধ্যে মাত্র ৯০ কোটি টাকা প্রবাস থেকে ফেরত শ্রমিকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। অর্থাৎ বরাদ্দকৃত অর্থের সিংহভাগ এখনো অবিতরিত থেকে গেছে। যেহেতু করোনা ভাইরাসের নতুন ধরন ধরা পড়ার কারণে কবে সৌদি আরবে ফ্লাইট চলাচল আবার শুরু হবে, তার কোনো হিসাব নেই, সেহেতু এসব আটকে পড়া প্রবাসী শ্রমিককে কিছু প্রণোদনার অর্থ সহজলভ্য করে কীভাবে তাদের পাশে দাঁড়ানো যায়, সে বিষয়টি সক্রিয় বিবেচনায় নিতে হবে। পাশাপাশি অন্যান্য দেশ থেকে ফিরে আসা প্রবাসী শ্রমিকদেরও, যারা দেশে এসে চরমভাবে আর্থিক কষ্টে আছে, এ আর্থিক প্রণোদনার প্রক্রিয়া ‘সহজলভ্য’ করে বেঁচে থাকার সংগ্রামে কীভাবে সারথি হওয়া যায়, সেটাও সক্রিয় বিবেচনায় নিতে হবে। যেসব মানুষের শ্রমে-ঘামে এ দেশের অর্থনীতি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, সে অর্থনীতি যেন তাদের ক্রান্তিকালে তাদের দাঁড়িয়ে থাকার রসদ জোগায়। কেননা এরাই আবার এ দেশের অর্থনীতিকে তা সুদে-আসলে ফেরত দেবে। কেননা শ্রমজীবী মানুষ কখনো দেশের সঙ্গে গাদ্দারি করে না। শ্রমজীবী মানুষ দেশের টাকা কখনো বাইরে পাচার করে না, বরঞ্চ নিজের রক্ত পানি করে উপার্জিত টাকা দেশে পাঠায়। এ সত্য জানাটা অত্যন্ত জরুরি।

ড. রাহমান নাসির উদ্দিন : নৃবিজ্ঞানী ও অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App