×

মুক্তচিন্তা

অর্থ পাচারে প্যাঁচ-প্যাঁচাল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর ২০২০, ১০:২৭ পিএম

কানাডার বেগমপাড়াসহ বিভিন্ন দেশ ও জায়গায় অর্থ পাচারকারীদের নাম-ঠিকানাসহ পরিপূর্ণ তালিকা দাখিল করতে হাইকোর্টের নির্দেশের কার্যকারিতা দেখার প্রতীক্ষায় অধীর অনেকে। নির্দেশনা অনুযায়ী দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে দাখিল করা তালিকায় সন্তুষ্ট হয়নি হাইকোর্ট। তালিকাটিকে বলা হয়েছে অসম্পূর্ণ-অপর্যাপ্ত, খাপছাড়া। জবাবে দুদক জানিয়েছে, তারা কাজ করছেন এ নিয়ে। হাইকোর্টের স্বপ্রণোদিত নির্দেশ দৃষ্টে ২৮ ফেব্রুয়ারি দুদকের পরিপূর্ণ তালিকা দেয়ার প্রস্তুতি চলছে। সেদিন গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি তালিকাও দাখিলের নির্দেশ জারি হয়েছে হাইকোর্টের একই বেঞ্চ থেকে। বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার ও আহমেদ সোহেলের ভার্চুয়াল বেঞ্চ সোমবার দ্বৈত নাগরিক ও পাসপোর্টধারীদের তালিকা চেয়েছে। স্পেশাল ব্রাঞ্চের এসপি-ইমেগ্রেশনকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে ২৮ ফেব্রæয়ারির মধ্যে এ তালিকা দাখিল করতে। এর আগে ২২ নভেম্বর এই বেঞ্চ থেকেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছিল কানাডার বেগমপাড়াসহ বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচারকারীদের নাম-ঠিকানাসহ তালিকা দিতে। কর্তৃপক্ষ হিসেবে বোঝানো হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এনবিআর এবং বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে। স্বপ্রণোদিত বা স্যুয়োমুটো বলা হলেও আদালত এ বিষয়ে প্রণোদিত হয়েছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেনের বক্তব্যের জেরে। ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির এক অনুষ্ঠানে তিনি স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যতাড়িত হয়ে বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে কানাডায় টাকা পাচারের গুঞ্জনের কিছুটা সত্যতা তিনি পেয়েছেন। আর প্রাথমিক তথ্যে দেখেছেন, টাকা পাচারে কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সরকারি চাকুরেই বেশি। এ তথ্য দিতে গিয়ে আরো জানিয়েছেন, তার ধারণা ছিল পাচারকারীদের মধ্যে রাজনীতিকের সংখ্যাই বেশি হবে। কিন্তু দেখলেন রাজনীতিবিদ মাত্র চারজন। ব্যবসায়ী আছেন সামান্য কয়েকজন। ২৮টি কেস স্টাডির কথা বললেও পাচারকারীদের নাম বা তালিকা দেননি তিনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের রেশ ধরে হাইকোর্টের রুলিংটি বিবেকবানদের কাছে সমাদৃত হয়েছে। রুলিংয়ের আগে-পিছে আরো কিছু প্রাসঙ্গিক কথা রয়েছে। পাচারকারীদের নাম প্রকাশ করা না হলে এ ধরনের অপরাধ কমবে না, বরং বাড়বে বলেও মনে করে উচ্চ আদালত। দেশে পড়াশোনা করে, দেশের মাটিতে থেকে, দেশের বাইরে টাকা পাচার করবে, এটা কি বেইমানি নয়? এমন প্রশ্নও ছোড়া হয়েছে। আদালতের প্রশ্নের সঙ্গে একমত হয়ে দুদক আইনজীবী খুরশীদ আলম খান আক্ষেপের সঙ্গে বলেছেন, এটা কালচার হয়ে গেছে। তথ্য জোগানের পাশাপাশি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য কিছু জিজ্ঞাসা তৈরি করেছে। এতদিন পর কেন কোন পরিপ্রেক্ষিতে চাঞ্চল্যকর তথ্য ছাড়লেন তিনি। এমনি এমনি? কথাচ্ছলে? বলার জন্যই বলা? মানে বাতকে বাত? দেশের শত-হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের ঘটনা বছর কয়েক ধরেই আলোচিত। সরকারের দিক থেকে যে কোনো ছাড় বা নমনীয়তা রয়েছে, এমনও নয়। কিন্তু পাচারকারী চক্র দমছে না। বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে এগিয়েই যাচ্ছে। তার ওপর কানাডায় অর্থ পাচার বা বিনিয়োগকারীদের সম্পর্কে খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করে আসছিল দুর্নীতি দমন কমিশন। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার কাছে তাগাদাপত্রের মতো করে চিঠিও দিয়েছিল। কিন্তু তথ্য কেমন পেয়েছে সেই সম্পর্কিত খবর ধোঁয়াশাময়। তবে গণমাধ্যমের তথ্য হচ্ছে, ৬০ জন দুর্নীতিবাজের বিদেশে পাচার করা টাকা দেশে ফেরত আনতে কাজ করছে দুদক। সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, ব্যাংকার মিলিয়ে এই ৬০ জনের পাচার করা টাকা ফেরত আনতে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট রিকোয়েস্ট-এমএলএআর পাঠানো হয়েছে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ১৮টি দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এই আবেদন করা হয়েছে। কেবল সাধারণ মানুষ নয়, অর্থ পাচার এবং লুটপাট নিয়ে যখন সরকারি পর্যায়েও কথা বলা শুরু হয়েছে, ওই সময়ে ‘আলেম সমাজ’ নামে একদল সামনে নিয়ে আসে ভাস্কর্য ভাঙার এজেন্ডা। তারা রাজনীতিতেও ভালো সাবজেক্ট হয়ে গেলেন। পাচার প্যাঁচ খেয়ে গেল হেফাজত আর ভাস্কর্যে। এই প্যাঁচের মধ্যেও হাইকোর্টের স্বপ্রণোদিত রুলিংয়ের কার্যকারিতায় দুদককে ব্যস্ত হতে হচ্ছে পাচার ও পাচারকারীর তথ্য জোগাড়ে। অর্থ পাচার প্রশ্নে কানাডার বেগমপাড়া বেশ আলোচিত। নামটিও মুখে মুখে প্রচারিত। বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশে দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হওয়া বহু ব্যবসায়ী-আমলা-রাজনীতিক তাদের স্ত্রী-সন্তানদের পাঠিয়ে দিয়েছেন কানাডায়। তাদের নিয়েই গড়ে উঠেছে এই বেগমপাড়া। কিন্তু দাগ-খতিয়ানে টরেন্টো বা কানাডায় বেগমপাড়া বলে কোনো জায়গা নেই। টরেন্টোর পাশে লেক অন্টারিওর তীরে মিসিসাগা শহরের একটি বড় কন্ডোমিনিয়াম হঠাৎ করেই কানাডার গণমাধ্যমের আগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত হয় বছর দশেক আগে। যেখানে থাকে মূলত দক্ষিণ এশিয়া থেকে আসা বহু অভিবাসী পরিবার। এসব পরিবারের স্বামীরা কাজ করেন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। স্বামীদের অনুপস্থিতিতে স্ত্রীদের নিঃসঙ্গ জীবন এবং কঠিন জীবন সংগ্রাম নিয়ে এক ভারতীয় পরিচালক রশ্মি লাম্বা তৈরি করেছিলেন বেগমপুরা নামের একটি ডকুমেন্টারি ফিল্ম। এই বেগমপুরার কাহিনী থেকেই বেগমপাড়া নামের উৎপত্তি। এই বেগমপাড়া ব্যবহৃত হয় কানাডায় পাড়ি জমানো দুর্নীতিগ্রস্তদের স্ত্রীদের দ্বিতীয় নিবাস অর্থে। পুরো কানাডায় প্রায় ৮০ হাজার বাংলাদেশি রয়েছেন বলে ধারণা করা হয়। তাদের বেশিরভাগের বাস টরেন্টো বা তার আশপাশে। গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে বহু উচ্চশিক্ষিত পেশাজীবী কানাডায় গেছেন অভিবাসী হয়ে। ২০০৮ থেকে ২০১৪ সময়কালে বেশি গেছেন ব্যবসায়ীরা। তখন ইনভেস্টমেন্ট ক্যাটাগরিতে একটি ভিসা দেয়া হতো, তখন কানাডায় একটি নির্দিষ্ট অঙ্ক বিনিয়োগ করে বা কানাডার সরকারের কাছে অর্থ জমা রেখে ইমিগ্রেশনের সুযোগ ছিল। রূপক অর্থে কানাডার বেগমবাড়ি বেশি আলোচনায় এলেও পাচার হওয়া দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাই, মালয়েশিয়া, ইন্ডিয়া, থাইল্যান্ডও রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে পাচার করা অর্থ প্রবাহ ঠেকানোর সাধ্য কানাডাসহ বিভিন্ন দেশ ও কর্তৃপক্ষের রয়েছে কিনা? এ প্রশ্নের জবাব এখনো নিষ্পত্তিহীন। আবার বাংলাদেশ বা বিশ্বের কোনো দেশের পক্ষে পাচারকারীর সংখ্যা ও পাচারের অর্থের তথ্য বের করা সহজ কাজ নয়। যে কারণে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার কথা হলেও পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার তথ্য দুর্বল। গোটা প্রক্রিয়াটাই জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি। তারপরও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, বাংলাদেশ থেকে কানাডা অর্থ পাচারের যে গুঞ্জন এতদিন ছিল তার সত্যতা পাওয়া গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে দুর্নীতি দমন কমিশন বলছে, তারাও এ নিয়ে কাজ শুরু করেছে এবং এ সংক্রান্ত তথ্য তারা সরকারের কাছে চেয়েছে। সব মিলিয়ে খবরটা ভালো। আশা জাগানিয়া। বিভিন্ন সংস্থা ও কর্তৃপক্ষের এ সংক্রান্ত গবেষণাগুলোকে ফেলনা ভাবা যায় না। এর আগে চলতি বছর মার্চে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অর্থ পাচারবিরোধী সংস্থা গেøাবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি-জিএফআই জানিয়েছিল, গত ৭ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৫ হাজার ২৭০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, যা স্থানীয় মুদ্রায় সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট-বিআইবিএমের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে মালয়েশিয়া, কানাডা, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে বসবাস করছেন। ব্যাংকের গ্রাহকদের আমানতের অর্থ নানা কৌশলে তারা বিদেশে পাচার করে সেখানে সেকেন্ড হোম গড়ে তুলছেন। এদিকে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-বিএফআইইউর তথ্য অনুযায়ী বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালেই বেশি টাকা পাচার হয়। এভাবে নানা পন্থায় বিদেশে টাকা পাচার করে সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগ আছে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী, আমলা ও রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে। কিন্তু পাচার হওয়া টাকার প্রকৃত পরিমাণ কত বা কারা টাকা পাচার করেছে, সে ধরনের বিস্তারিত তথ্য খুব একটা জানা যায় না। একমাত্র পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়া বাংলাদেশ সরকার বা রাষ্ট্রীয় কোনো কর্তৃপক্ষও কখনো এসব বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেনি। সাধারণ কাÐজ্ঞানে বলে, অর্থ পাচারের ব্যাপারে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেতে হবে। তিনি যেখানে পাচার করেছেন সেখান থেকে যে কোনো মাধ্যমে সঠিক তথ্যটিও পেতে হবে। পাচার যে দেশে হয়েছে সেখানকার তথ্য পাওয়ার পর দুদেশের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট পারস্পরিক তথ্য বিনিময় করবে। কিন্তু এসব গোপন তথ্য আদালতে দেয়া যায় না। তাই মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসটেন্সের অনুরোধ করতে হয়। ওই অনুরোধের পর পাওয়া তথ্য আদালতে উপস্থাপন করে পাচার হওয়া অর্থ বা সম্পদ জব্দ করাতে হয়। এরপর রয়েছে দুদেশের মধ্যে সমঝোতা ও কিছু ক্ষেত্রে চুক্তির বিষয়। সেই পর্যায় পর্যন্ত যেতে পারলে পাচার করা অর্থ আনার একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়। এই বাস্তবতায় পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনা সম্ভব কিনা? প্যাঁচযুক্ত এ প্রশ্নের মধ্যেও এখন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য, হাইকোর্টের নির্দেশনা এবং দুদকের চেষ্টা ও বিভিন্ন মাধ্যমে কিছু তথ্য-প্রমাণ সামনে আসা অবশ্যই ভারি খবর।

মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App