×

সাময়িকী

সৈয়দ হকের রাজনৈতিক ছড়ায় নতুন মাত্রিকতা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২০, ১০:৫৫ পিএম

সৈয়দ হকের রাজনৈতিক ছড়ায় নতুন মাত্রিকতা

সৈয়দ শামসুল হকের ‘তোরাপের ভাই’ (সময় প্রকাশন, ঢাকা, অমর একুশে গ্রন্থমেলা ১৯৯০) ছড়াকবিতার গ্রন্থ নিয়ে প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ৩১ মার্চ ১৯৯০ এই প্রবন্ধ রচনা করেন। গ্রন্থটি প্রকাশের অব্যবহিত পর লেখা এই বিশদ প্রবন্ধ অদ্যাবধি প্রকাশিত হয়নি। সম্প্রতি সৈয়দ শামসুল হকের ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে লেখাটির সন্ধান পাওয়া যায়। এই রচনায় গুণী সমালোচকের কলমে সৈয়দ হকের ছড়াকবিতার নিপুণ মূল্যায়ন ফুটে উঠেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত সৈয়দ শামসুল হকের ‘তোরাপের ভাই’ বই হাতে পাবার পর আমি এক নিঃশ্বাসে তা পড়ে শেষ করছি। ছড়ার বই, আয়তনে ছোট, কিন্তু আবেদনে-অভিঘাতে বিপুল, হৃদয়কে প্রচণ্ডভাবে আলোড়িত করে, কখনো দুঃখ বেদনা, কখনো ক্ষোভে ক্রোধে, কখনো আশা উদ্দীপনায়। দশটি ছড়া নিয়ে বইটি গড়ে উঠেছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবশ্য ছড়া নয়, কবিতাই মুখ্য, আবার অনেক ক্ষেত্রে সচেতনভাবে ছড়ার ঢংকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, ব্যবহার করা হয়েছে বাংলাদেশের বহুল পরিচিত ছোটদের অতি আদরের কতিপয় ছাড়ার পঙ্ক্তি, কিন্তু সেখানে নিয়ে আসা হয়েছে ভিন্ন প্রেক্ষিত, আর ইতিহাসের চেতনা এবং প্রগতিশীল প্রতিবাদী রাজনৈতিক বক্তব্য। প্রথম কবিতার নাম ‘তোরাপের ভাই’, সর্বশেষ ছড়াটির নাম ‘হারাধনের দশটি ছেলে’। সৈয়দ শামসুল হক সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই তার প্রতিভাদীপ্ত সৃজনশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন, গল্প-উপন্যাসে, কবিতায়, নাটকে এর বেলে-লেৎর জাতীয় রচনায়। তার কিছু কিছু লেখাতে আমি লক্ষ করেছি যে তিনি সচেতনভাবে বাংলাদেশের মানুষের বিদ্রোহী-বিপ্লবী সত্তাকে, বিশেষ করে তার দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য সম্পৃক্ত ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতাকে তুলে ধরতে সচেষ্ট। এ প্রসঙ্গে সহজেই মনে পড়ে তার অনবদ্য কাব্যনাটক নূরলদীনের সারাজীবন-এর কথা। আলোচ্য ছড়াগ্রন্থ তোরাপের ভাইতেও এ ব্যাপারটা লক্ষণীয়, তবে এখানে সমকালীন রাজনৈতিক ইতিহাসই লেখকের মৌল উপজীব্য। একেবারে শুরুতেই অবশ্য সৈয়দ হক আমাদের নিয়ে যান অতীতের কোলে, নীলদর্পণ-এর সেই দুঃসাহসী চাষী যুবক তোরাপের কাছে, যে শোষিত ও নির্যাতিত বাংলায় আজও যার উত্তরসূরি ভিটেমাটিহীন, যার শাসক-শোষক আজ আর রোগ সাহেব বা সাদা চামড়ার কেউ নয়, তারা এখন এই স্বদেশেরই মানুষ। কিন্তু, কবি সুস্পষ্টভাবে লক্ষ করছেন : এখনো তোমার পিঠে দেখি ভাই চাবুকের কড়া দাগ। এখনো এ দেশে সেই অরণ্য, বড় মানুষেরা বাঘ; মজ্জা ও মাস খেয়েছে তোমার, আগামী তোমার নাই- আজো বাংলার বিরানায় হাঁটো তুমি তোরাপের ভাই। সাধারণ মানুষের অপরিবর্তিত দুঃখী জীবনের ছবি কবিকে ব্যথাহত করেছে, একটু হতাশার সুরও ফুটে উঠেছে এই কবিতায়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দীপ্ত সাহস ও আশাবাদেই কবি স্থিতধী। তাই গ্রন্থের শেষ ছড়ায় আমরা দেখি যে হারাধনের একটি ছাড়া সব ছেলেই হারিয়ে গেছে, কেউ গেছে দীপান্তরে, কেউ বুলেটের আঘাতে, কেউ কাঠগড়ায়, কেউ দানবের পেটে, তবু তারা দমে যায়নি, নতুন দিন আনার জন্য বারবার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তারা, এখন বাকি আছে মাত্র একটি ছেলে, কিন্তু সেও একাই লড়াই চালিয়ে যাবে, কারণ সে জানে যে আসলে সে একা নয় : লক্ষ কোটি ভাই আছে তার আলোক-জ্বালা ঘরে। সৈয়দ হক গ্রন্থভুক্ত একাধিক রচনায় পুরনো দিনের ছড়ার কথা ও সুর ব্যবহার করেছেন, যেমন, ‘চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে’, ‘আইকম বাইকম তাড়াতুড়ি’, ‘আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা’ ইত্যাদি। কিন্তু সমস্ত অনুষঙ্গটা তিনি পাল্টে দিয়েছেন। দু’একটা দৃষ্টান্ত দিই : আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা টুংগী পাড়ায় যাই টুংগী পাড়ার মাটির মতো মাটি যে আর নাই। সেই মাটিতে শুয়ে আছেন স্বপ্নের সন্তান বাংলা নামে দেশের পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। উক্ত ছড়াটিতে এইরকম আরো দুটি চমৎকার স্তবক আছে। ‘চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে’ শীর্ষক ছড়ায় কবি নিয়ে এসেছেন ভিন্ন সুর, সামরিক শাসনের নৃশংসতাকে তুলে ধরেছেন তীব্র ব্যঙ্গ সহকারে, সেই সঙ্গে সঙ্গে রেখেছেন, ছন্দ নির্মাণ ও শব্দ প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিরল নৈপুণ্যের স্বাক্ষর: চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে পাইকপাড়ায় কে? গুলি ছুড়ছে খুলি উড়ছে কু করছে যে। তোরাই মারিস তোরাই ধরিস দোষের ভাগী আমরা; সব কিছুতে টান দে বলিস ‘ইয়ে তো হ্যয় হামরা।’ বাত তো সহি, কেন্তু কহি রাতের শেষে ফজরে ইতিহাসের লিখনটা কি পড়বে তোদের নজরে? পুরনো পরিচিত ছড়ার কদমতলা এখানে হয়েয়ে পাইকপাড়া, যেখানে গুলি চলে আর ক্যু হয়, তবে ছড়াটির শেষার্ধে লেখক কদমতলাকেও নিয়ে এসেছেন, তবে এই কদমতলায় এখন শুধু লাশ, চাঁদ মরে গেছে, ফুল সরে পড়েছে। অন্য একটি ছড়ায় কবি স্মরণে এনেছেন সমকালের, নিকট অতীতের ও কিছুটা দূর অতীতের কয়েকজন অসামান্য সাহসী বিদ্রোহী মুক্তিকামী বীর বাঙালিকে, মতিউর, আসাদ, নূর হোসেন, শেখ মুজিব ও নূরলদীনকে। বাংলাদেশে ধান ছিল, সোনার তরীও ছিল, কিন্তু এখন তা আটকে গেছে নদীর চরে। ধান বোঝাই সোনার তরী উদ্ধার করার জন্য ধর্মঘট, মিছিল ইত্যাদি হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সুফল পাওয়া যাচ্ছে না তাতে। কবি এ অবস্থায় স্মরণ করছেন ওইসব বীর বাঙালিদের, যারা প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও শোষণমুক্তির জন্য এবং দুঃখ বেদনা হতাশার জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসার উদগ্র আকাক্সক্ষায় বলেছেন তিনি : চোখে আমার ঘুম আসে না দুঃস্বপ্নের ছড়ি; মিছিল তো আর ভাত দেবে না, আয় যুদ্ধ করি।

আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা রণাঙ্গনে যাই, আসাদ-মতিউরকে তোরা সঙ্গে নিবি ভাই। একটু আগে বলেছি যে গ্রন্থভুক্ত কোনো কোনো লেখা ছড়া নয়, কবিতা। অবশ্য ছড়াও কবিতা হয়ে উঠতে পারে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথেই তার দৃষ্টান্ত আছে। তবে সৈয়দ হকের ‘রাজনীতির পাঠ’ রচনাটি স্পষ্টতরই কবিতা, সেখানে ব্যঙ্গ আছে, সমকালের কথা আছে, মিল ও ধুয়া ব্যবহারের ক্ষেত্রে উন্নত শৈলীর পরিচয় আছে, বর্তমান বাংলাদেশের স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর তাবৎ বজ্জাতির মুখোশ ও দল নির্বিশেষে সুবিধাবাদী রাজনীতির ভণ্ডামি উন্মোচনের প্রয়াস রয়েছে। কবিতাটি নির্মিত হয়েছে তিন চরণের সাতটি স্তবক দিয়ে, প্রতি স্তবকের শেষে উচ্চারিত হয়েছে একটি শব্দ, রাজনীতি। মাঝখান থেকে তিনটি তাৎপর্যময় স্তবক, যদিও সবগুলোই তাৎপর্যময়, দৃষ্টান্ত হিসেবে উদ্ধৃত করছি : জাতির পিতা গরিব গোরে, এদিক চাচা-মামুতে। খালকাটাকে কবর দিলেন পার্লামেন্টের ছামুতে- এমনি করেই মুছতে হবে একাত্তরের সব স্মৃতি। -রাজনীতি

সামনে সদর দরজা তোমার পরিত্যাজ্য বিষবৎ, খিড়কি পথেই ঢুকবে তুমি, এই হলোগে তোমার পথ। গোড়ার দিকে ভান করবে যেন ক্ষণিক অতিথি। -রাজনীতি। তারপরে এক সকাল বেলা নাশতা খাবার টেবিলে সংবিধানের কয়েক ধারা ফেলবে কপাৎ কৎ গিলে। পুলিশ দিয়ে প্রতিবাদীর বদলে দেবে আকৃতি। -রাজনীতি। এই রকম রচনার কথা মনে রেখেই আমার বলতে ইচ্ছে করে যে তোরাপের ভাই গ্রন্থটি একই সঙ্গে সৃজনশীল কাজ ও ডকুমেন্টারি, ইতিহাস ও রাজনৈতিক ভাষ্য। এই বই-এ আমার অন্যতম প্রিয় রচনা অবশ্য ছ’লাইনের একটি ছোট্ট ছড়া, আকারে সবচাইতে ছোট, কিন্তু এর ক্ষুরধার ব্যঙ্গ, বিদ্রুপের বিদ্যুৎছটা, অন্তর্নিহিত প্রচণ্ড বিস্ফোরক শক্তি একে অসামান্য করে তুলেছে। গোটাটাই উদ্ধৃত করছি : আইকম বাইকম তাড়াতুড়ি জেনারেলের ফাঁসলো ভুঁড়ি এগেন কাম ঝমাঝম জেনারেলের একটু কম বাচ্চা মতন কর্নেল দুদিন বাদেই জেনারেল। ছড়াটির নাম ‘লাতিন আমেরিকার ছড়া’। অবশ্যই লাতিন আমেরিকার ক্ষেত্রে, প্রায় তার সর্বত্র সর্বাংশে, প্রয়োজ্য। কিন্তু শুধুই কি সেখানে, আর কোথাও নয়? পাঠকের উপরই জবাব দেবার ভার ছেড়ে দিলাম।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App