×

সাময়িকী

মানুষ ঘুমের চাইতে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২০, ১০:৫৯ পিএম

মানুষ ঘুমের চাইতে

তার কাছে আমার ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা অনেক। যদিও পরিচয়ের ঘনিষ্ঠতা ছিল না, তবু আমার লেখকজীবনে অনেক বড় আনন্দ হয়ে আছে। তিনি আমার একটি কবিতা নিয়ে দীর্ঘ একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ২০০৪ সালে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের ‘আবহমান’ পত্রিকায় আমার ‘ইলিশ’ নামে একটি কবিতা ছাপা হয়েছিল। প্রায় দশ বছর পরে জানলাম কুতুব হিলালীর কাছে- মঞ্জুরে মওলা স্যার আমার এই কবিতার উপরে অনেক বড় একটি লেখা লিখেছেনÑ আনিসুজ্জামান স্যার সম্পাদিত এক স্মারকগ্রন্থে। প্রথমে বিশ্বাস হয়নি, কিছুদিন পরে হিলালী প্রমাণ নিয়ে হাজির। কি আশ্চর্য! জানা নেই, পরিচয় নেই, কেবল কবিতা ভালো লাগার কারণে অপরিচিতের কবিতার উপরে এতবড় লেখা! এই হলো মঞ্জুরে মওলাÑ সারাজীবন নিজের ভালোলাগা ও আনন্দে সাহিত্যচর্চা করে গেছেন, অনেক বড় পÐিত, অনেক বড় আমলাÑ এক সময়ের বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক ছিলেন; সাহিত্যের বিনিময়ে পুরস্কার বা নাম কামানো তার ধাতে ছিল না। এলিয়টের কবিতা ভালো লাগায় জীবন-সায়াহ্নে এসে একটা অভিসন্দর্ভ লিখে ফেললেন, পিএইচডি ডিগ্রি করলেনÑ খেলাচ্ছলে- অপ্রয়োজনে, আনন্দে। কিছুদিন আগে বাংলা কবিতার বিশালায়তনের দুটি সংকলন করেছেনÑ ‘পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশের কবিতা’, ‘পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতা’। বললে অত্যুক্তি হবে নাÑ বুদ্ধদেব বসু, আবু সয়ীদ আইয়ুব ও হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের চেয়ে তার নির্বাচনের গুরুত্ব কম নয়। এত বড় ভ‚মিকাযুক্ত বাংলা কবিতার সংকলন দ্বিতীয়টি আছে বলে মনে হয় না। কোনো পাÐিত্য নেইÑ ব্যক্তিগত ভালোলাগার দোহাই, বলতে চেয়েছেনÑ এ সংকলন কেবল তার নিজের জন্যÑ নিজের ভালোলাগার কবিতাগুলো তিনি একত্রে করে রেখেছেন। কাব্য-রচনার বাইরেও তার জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছেÑ তার অন্যতম এদেশের পাঠকদের জন্য ভাষা-সাহিত্যের রুচি নির্মাণ। আশির দশকে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক থাকার সময়ে তিনি ‘বাংলা একাডেমির গ্রন্থমেলা’র নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা।’ সেই সময় তিনি বিভিন্ন লেখককে দিয়ে ‘ভাষা শহীদ গ্রন্থমালা’ শীর্ষক অতিপ্রয়োজনীয় ১০১টি রচনা সম্পাদন করেন। এটিকে বাঙালির জ্ঞানতত্তে¡র বিশ^কোষ বললে ভুল হয় না। রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষে তার বিচিত্র সৃষ্টিকর্ম নিয়ে ১৫১টি গ্রন্থ রচনার প্রকল্প প্রণয়ন ও সম্পাদনা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। ভাষা ও ভাষা আন্দোলন তার রচনার অন্যতম উৎস হয়ে আছে। ভাষা আন্দোলনের পটভ‚মিতে রচিত তার একটি কবিতার পর্যালোচনা ও পরিপ্রেক্ষিত এখানে তুলে ধরা হলো।

২. কবি বললেন, ‘জেগে উঠল বাংলা ভাষা রাত পোহাতেই’Ñ অর্থাৎ বাংলা ভাষা ছিল; কিন্তু ঘুমিয়ে ছিল। এ প্রশ্ন খুব স্বাভাবিকÑ ভাষা কীভাবে ঘুমিয়ে থাকে? ভাষার তো কোনো শরীর নেই, ভাষার তো কোনো চোখ নেই। তাই মনে জাগেÑ মানুষের মতো, সপ্রাণ বস্তুর মতো ভাষা কি ঘুমাতে পারে! তাহলে কি কবির এই পঙক্তি কেবল রূপকার্থে বাক্সময়। না কি মানুষ নিজেই একটি অপসৃমান রূপকল্প; ভাষাই আসলে সত্য, আর সত্য কিছু নয়। মানুষ প্রকৃতপক্ষে ভাষারই সচলরূপ। ভাষার জগতেই মানুষের বসবাস। মানুষ আছে, মানুষ ছিল এবং মানুষ থাকবেÑ এই তিন প্রকল্পের একটিও যথাযথ প্রমাণ করা সম্ভব হতো নাÑ যদি ভাষার অস্তিত্ব না থাকত। অতএব ভাষা না থাকলে মানুষ থাকে না, ভাষা না জাগলে মানুষ জাগতে পারে না। ভাষােেকন্দ্রিক বাঙালি জাতির একটি কালের যথাযথ উপলব্ধির প্রকাশ এই কবিতা।

রবীন্দ্রনাথ যেমন করে তার লাইব্রেরি প্রবন্ধে বলেছিলেনÑ ‘মহাসমুদ্রের শত বৎসরের কল্লোল কেহ যদি এমন করিয়া বাঁধিয়া রাখিতে পারিত যে, সে ঘুমাইয়া পড়া শিশুটির মতো চুপ করিয়া থাকিত, তবে সেই নীরব মহাশব্দের সহিত এই লাইব্রেরির তুলনা হইত। এখানে ভাষা চুপ করিয়া আছে, প্রবাহ স্থির হইয়া আছে, মানবাত্মার অমর আলোক কালো অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে বাঁধা পড়িয়া আছে। ইহারা সহসা যদি বিদ্রোহী হইয়া উঠে, নিস্তব্ধতা ভাঙিয়া ফেলে, অক্ষরের বেড়া দগ্ধ করিয়া একেবারে বাহির হইয়া আসে! হিমালয়ের মাথার উপরে কঠিন বরফের মধ্যে যেমন কত কত বন্যা বাঁধা আছে, তেমনি এই লাইব্রেরির মধ্যে মানবহৃদয়ের বন্যাকে বাঁধিয়া রাখিয়াছে!’ কবিগুরু যেমন লাইব্রেরিতে ভাষার ‘চুপ’ করে থাকা কিংবা ‘ঘুমিয়ে পাড়া শিশুটির চুপ করে থাকা’র সঙ্গে তুলনা করেছেন, কবি মনজুরে মওলাও তেমন ঘুমিয়ে পড়া ভাষার জেগে ওঠার কথা বলেছেন তার এই কবিতায়। তবে রবীন্দ্রনাথের লাইব্রেরি মূলত মানুষের ভাষা-অভিজ্ঞতা দ্বারা সৃজন-কর্মের কথা বলা হয়েছে; কিন্তু মনজুরে মওলা তার কবিতায় ভাষা অর্থে ভাষাজাতির কথা বলেছেন। বাঙালি জাতির কথা বলেছেন। এ জাতির সুখ-দুঃখ, সংগ্রাম ও স্বপ্ন যাত্রার কথা বলেছেন। রবীন্দ্রনাথও ভাষার ঘুমিয়ে থাকার কথা, ভাষার বিদ্রোহের কথা উপেক্ষা করেননি। প্রকৃতপক্ষে হাজার বছরের বাঙালির জাতির ভাষা ছাড়া তেমন কোনো অর্জন নেই। ১৯৭১ সালে স্বাধীন রাষ্ট্রগঠনের অভিজ্ঞতা বাদ দিলেÑ ইতিহাসে বাঙালির তেমন কোনো রাজনৈতিক মুক্তি ছিল না। না এই জাতি নিজেরা কোনো দেশ অধিকার করেছিলেন, না এই জাতি নিজেদের স্বশাসন অর্জন বা বজায় রাখতে পেরেছিলেন। যে জাতির স্বাধীনতা নেই সে জাতির বিকাশ ও বীরত্ব স্বীকৃত নয়। যে জাতি ঘুমন্ত জাতি। তবে বাঙালি ভাষা-জাতি পরাধীন থাকলেও এই জাতির ভাষা কখনো পরাধীন থাকতে চায়নি। কেন্দ্রের শাসন উপেক্ষা করে, ব্যাকারণের শাসন না মেনে, পৌরহিতের রৌরব নরকের ভয় না করেÑ এই ভাষা তার ধারণাগত অধিকৃতরাজ্য বিস্তার করেছে পরাক্রমে। সেদিক থেকে এর জন্মলগ্ন থেকেই ভাষা বিদ্রোহ প্রবল ছিল। ফলে বৈদিক যুগ থেকে, গৌড়ীয় অথবা মাগধী প্রাকৃত অবহ হয়ে এই ভাষা চর্যার কালে এসে নিজস্ব রূপ ধারণ করেছে; সেও প্রায় হাজার বছরের অর্জনের দ্বারা নিজেকে সমৃদ্ধ করেছে। আসলে ভাষার লড়াইটা শেষ করতেই বাঙালির বহুদিন লেগেছিল। এমনকি চর্যারকালেও বাঙালি কবিরা প্রথম টের পেয়েছিলেন যে, এই ভাষার অহঙ্কার যতদিন তারা হৃদয়ে ধারণ না করবেন, ততদিন তারা পরভাষা, পর-জাতির কাছে শোষিত হবেন, নিষ্পেষিত হবেন। এই ভাষায় তাদের পতিত করেছে, আবার এই ভাষাই তাদের পরিচয় ও শক্তি দান করেছে। উচ্চবর্গীরা ধর্মের ধ্বজাধারীরা ভাষার কারণে যতই বাঙালিকে খোঁচা দিক, যতই তাদের পতিত বলুকÑ তারা কখনো এই ভাষার অধিকার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি। এমনকি হাজার বছর আগে চর্যার বাঙালি কবি ভুসুকুপা ঘোষণা করেছিলেন- ‘আজ ভুসুকু বাঙ্গালী ভইলী/ নিঅ ঘরিণী চÐালে লেলী।’ ভুসুকুর অবস্থান নিয়ে ব্যাখ্যাকাররা যাই বলুন না কেন, নিম্নবর্গের অন্তজ তথাকথিত অচ্ছুত ভাষার মানুষই এ ভাষার দাবিদারÑ এই সত্যকে তিনি অস্বীকার করেননিÑ হাজার বছর আগেও। অথবা নিজের পতিত হওয়ার বিষয়টি তিনি লুকাতে চাননি। এই ভাষা কেবল বৈদিক ধর্মের বাধানিষেধের বেড়াজালে নিষ্পেষিত নয়, এ ভাষা মধ্যযুগে মুসলিম শাসনামলেও নিগৃহীত ছিল। সুলতানি আমলে এই ভাষার প্রধান বিকাশকালেও মুসলিম ধর্মবেত্তারা মনে করতেন, মুসলমানদের ভাষা হওয়া উচিত আরবি-ফারসি। ধর্মের ভিত্তিতে ভাষার অধিকার মূলত রাজনৈতিক প্রকল্প। মোল্লা-পুরুতের ফতোয়াবাজির বিরুদ্ধে মধ্যযুগের কবি আবদুল হাকিমসহ অনেকেই সোচ্চার হয়েছিলেন। তিনি তার নুরনামা কাব্যগ্রন্থে বলেছিলেন, যারা এ দেশে জন্মগ্রহণ করে নিজ ভাষা বাংলার বিরোধিতা করে তারা কেন দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে যায় না। এমনকি তাদের জন্ম নিয়েও কবি সন্দেহ পোষণ করেছেন। কেবল প্রাচীন মধ্যযুগে নয়, আধুনিককালেও বাঙালি কবিরা তার নিজ ভাষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছেনÑ মধুসূদন তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। কিংবা পরবর্তীকালে অতুল প্রসাদ সেন-এর ‘মোদের গরব মোদের আশা/ আ মরি বাংলা ভাষা।’ আসলে বাংলা ছাড়া বাঙালির কোনো আশা নেইÑ এ কথা এ ভাষার কবিরা ঠিক আবিষ্কার করেছিলেন। বাঙালিদের মধ্যে অনেক জাতপাত ধর্মাধর্ম আছে বটে, কিন্তু ভাষার কারণে তারা পাশাপাশি বাস করে আসছে শত শত বছর। এমনকি রাজনৈতিক কারণে বাংলা ভাগ হওয়ার পরেও বাঙালি ভাষাজাতি হিসেবে যেমন আলাদা হয়নি তেমন অন্য ভাষার আধিপত্যও তারা মেনে নেয়নি। ব্রিটিশরাজ্য অবসানের অনিবার্য ফল হিসেবে ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগে বাঙালিরাও বিভক্ত হয়ে পড়ে। মুসলিম অধ্যুষিত পূর্বাঞ্চল পাকিস্তানের সাথে এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ভারতের সাথে যুক্ত হয়। কিন্তু পাকিস্তান সরকার যখন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের ওপর বাংলা চাপিয়ে দিতে উদ্যত হয় তখনই বাঙালিরা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। যেন অনেক দিনের ঘুমন্ত সিংহকে অপরিণামদর্শী কেউ জাগিয়ে দিয়েছে। বাঙালি হয়তো এর আগে নিজের জাত্যাভিমান সম্বন্ধে এতটা সচেতন ছিলেন না; এতদিন হয়তো কেউ তার শ্রম নিয়েছে, বঞ্চনা করেছে, ধর্ম নিয়েছে, শোষণ করেছেÑ ততদিন সবকিছুই ছিল তার একার। কিন্তু যেই কেউ বা কোনো রাজন্য তার ভাষা ধরে টান দিয়েছে, আর তার রক্ষা নেই। এরই উৎকৃষ্ট প্রকাশÑ কবি মনজুরে মওলার কবিতা ‘মানুষ ঘুমের চাইতে’। কবি বাঙালির সেই উত্তাল তরঙ্গ স্রোতকে কবিতায় বেঁধে দিয়েছেন সহসাÑ

‘জেগে উঠল বাংলা ভাষা রাত পোহাতেই। কোথায় লুকিয়ে ছিল এতদিন বুকের ভেতর, রক্তে, হৃৎপিÐে, পাঁজরে, চোখের তারায়, মগজে, শিরায়, শরীরের জটিল গ্রন্থিতে। ক্যাম্পাসে ভীষণ ভিড়; কাঁপছে তরুণ-তরুণী; হঠাৎ বিদ্যুৎ যেন বয়ে যায় মরা কোনো তারে। বাংলাকে অমন করে বাসেনি কেউই ভালো আগে।’

দেশ ভাগের বছর না ঘুরতেই জিন্নাহ’র লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কার নামে বাংলা উচ্ছেদের ঘোষণার বিরুদ্ধে তখন রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশ যেভাবে কেঁপে উঠেছিল- ‘রক্তে, হৃৎপিণ্ডে, পাঁজরে, চোখের তারায়, মগজে, শিরায়, শরীরের জটিল গ্রন্থিতে।’ এ অদ্ভুত জাগরণ তখন সারাদেশ একটি শরীরে পরিণত হয়েছিল- আর সেই শরীরের নাম ছিল বাংলা। বাংলার অপমান তারা মেনে নেবেন না, মেনে নেননি। এই জনপদে যখন বাংলার বিকাশ ঘটছিল, তখন না ছিল হিন্দু না ছিল মুসলিম। এই বাঙালিরাই তাদের হিন্দু হয়েছে, মুসলিম হয়েছে কিংবা অন্য কোনো ধর্ম গ্রহণ করেছেন। এখানকার মানুষ কর্মের প্রয়োজনে ধর্ম নিয়েছে। এই বাংলা ভাষাই তাদের মা, আদি উৎস। কিন্তু যে পশ্চিম পাকিস্তানিরা এই জাতির উপরে অন্য ভাষা চাপিয়ে দিতে চাচ্ছিল সেই ভাষার সঙ্গে অতীতের কোনো কালের এ জাতির এ ভাষার কোনো পরিচয়ের সূত্র ছিল না। ফলে এই অঞ্চলের মানুষের ধর্মের নামে আঘাত হানলে তার প্রকাশ হবে খÐিত কিন্তু এই ভাষার উপরে কেউ আঘাত হানলে সব ধর্মমত পেশা লিঙ্গ বর্ণ একত্রে এর প্রতিবাদ করবে এটিই স্বাভাবিক। তার চ‚ড়ান্ত অবসান হয়েছিলÑ ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রæয়ারি পাক-বাহিনীর বর্বোরচিত হামলায়। কিন্তু বাঙালি জাতি থেমে থাকেনিÑ ভাষার পথ ধরেই চ‚ড়ান্ত স্বাধিকারের পথে এগিয়ে গেছে। কবি মনজুরে মাওলা তারই ইঙ্গিত দিয়েছেন কবিতার দ্বিতীয় স্তবকেÑ যে-নাচ লুকিয়ে ছিল পাথরের জেগে-থাকা বুকে, যে-গান লুকিয়ে ছিল মেঘে-মেঘে এবং নদীতে, যে-কথা মাথায় নিয়ে দণ্ড সারা জীবনের এড়িয়ে সবার চোখ বেড়িয়েছে পালিয়ে-পালিয়ে, তারা সব ভিড় করে চলে আসে এই বাংলাদেশে। ুপ্রতিবাদ ছাড়া, আন্দোলন ছাড়া, রক্তের বিনিময় ছাড়া কোনো জাতি স্বাধীনতা পায়নি, অধিকার আদায় করতে পেরেনি। বাঙালিরাও পারেনি। সাতচল্লিশে বাঙালি যে ধর্মভিত্তিক ইউটোপিয়ার স্বপ্ন দেখেছিল, তা রাত পোহাতেই পরিণত হয় দুঃস্বপ্নে। জেগে ওঠে বাস্তবতার বোধ। বাঙালি এই যেন প্রথম বুঝতে পারল বাঙালিকে বাস করতে হবে বাংলার সাথে; অভিন্ন ভ‚গোল ও ভাষায়। কবি অদ্ভুত রূপকল্প তুলে ধরেন, বাংলাদেশের ধারণায়। হাজার বছর দলে পাথরের বুকে ঘুমিয়ে থাকা জমাটবদ্ধ স্বপ্ন যেন বাংলাদেশ নামক ধারণাগত অথচ বাস্তব রাষ্ট্রচেতনায় পর্যবসিত হয়। কবি যখন বলেন- ‘যে কথা মাথায় নিয়ে দÐ সারা জীবনে’ তখন বৈদিক থেকে মোগল-ইংরেজ হয়ে উর্দু পর্যন্ত বাঙালির যে অভিযাত্রা; ভাষার কারণে তার নিষ্পেষণ অবজ্ঞা তারই প্রকাশ বাক্সময় হয়ে ওঠে। কবিতাটি মনজুরে মওলা পাঁচটি স্তবকে রচনা করেছেন। প্রতিটি স্তবকে আলাদা আলাদা ভাবের সঞ্চার করেছেন। অনেকটা ক্ষুদ্রায়তনে পঞ্চমাঙ্কের একটি নাটক। যদিও এই নাটক ট্র্যাজেডির তবু এর পরিণামে মধুর পরিণয় ও প্রাপ্তিও আমাদের তৃপ্ত করে। কারণ বাঙালির এই ভাষার আন্দোলনে বীরের মৃত্যু ঘটলেও রাজ্য জয়ের আনন্দ, স্বাধীনতা মুক্তি- তারা ছিনিয়ে এনেছেন। ফলশ্রুতিতে এই জাতি সমস্বরে গাইতে পারছে- ‘আ মরি বাংলা ভাষা।’ রক্তদানের মাধ্যমে যেন ঐতিহাসিক পাপমোচন হয়ে বাংলা ভাষা ও জাতি এক পরম শুদ্ধতা লাভ করেছে। পাঁচজন-পাঁচজন করে উন্মুখ মিছিলে বেরিয়ে এসেছে তারা; দাঁড়িয়ে রয়েছে ট্রাক পুলিশের; উঠে পড়ছে তাতে; হাসছে; হো-হো শব্দ শোনা যাচ্ছে চারদিক থেকে; উত্তাল স্লোগানে আকাশ এক্ষুনি হবে খান-খান, ভেঙে পড়বে গুঁড়ো-গুঁড়ো হয়ে। হঠাৎ ফোয়ারা ছোটে রক্তের। আ মরি বাংলা ভাষা- এতদিন পরে শুদ্ধ হলে তুমি, জেগে উঠলে এতদিন পরে। মানুষ ঘুমের চাইতে জেগে থাকতে আজ বেশি ভালোবাসে। কারণ আজ আর বাংলা ভাষা ঘুমিয়ে নেই। বাংলা ভাষা জেগে আছে; অর্থাৎ বাঙালিরা জেগে উঠেছে। পৃথিবীর বুকে নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। এখন পরজাতি, পরভাষা আর তার প্রভু নন। কেউ তাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে পারবে না। এখন সে আর ঘুমাতে চায় না। বাঙালি এখন সদা জাগ্রত। এখন বাংলা ঘুমের চাইতে জেগে থাকতেই বেশি ভালোবাসে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App