×

সাময়িকী

পারমিতার জগৎ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২০, ১০:৩৯ পিএম

পারমিতার জগৎ

প্রতিদিন বারেবারে সবুজের কথাগুলো, সবুজের স্পর্শগুলো ফিরে ফিরে আসে! একবারও কি সবুজ বলেছে, সে আমায় ভালোবাসে? ইশারাতেও কি কখনো নিবেদন করেছে প্রেম? তবু কেনো প্রতিদিন অস্থির হয়ে উঠছিলাম সবুজের জন্য? সবুজ কেনো আমাকে ঘুমাতে দিচ্ছে না, খাদ্যে কেনো এতো অরুচি? সবকিছু অসহ্য ঠেকছে। বন্ধুদের-সহপাঠী-স্বজনদের মুখ আর সান্নিধ্য অসহনীয় মনে হচ্ছে প্রতিদিন। কেনো সবুজ নিরুদ্দেশ? হারিয়ে গেলো কোথায়? ও-কি পালিয়ে গেলো? তার বুকে কি কোনো অভিমান জমেছিলো? আমার কি কোনো ভুল ছিলো? জীবনের এ পর্যায়ে এসে সবকিছু এলোমেলো ঠেকছিলো আমার। সবুজের স্মৃতির যন্ত্রণা থেকে আমি মুক্তি চাইছিলাম মনে মনে; কিন্তু যতবার মুক্তি চাই, ততবার প্রার্থনা হয়ে কান্না আসে; আর মন নিজের অজান্তে উচ্চারণ করে, “সবুজ ফিরে এসো তুমি! কী অন্যায় আমার? কোন ভুলের সাজা পাচ্ছি আমি?” কাপুরুষ ভেবে ভুলে যেতে চাই সবুজের সব স্মৃতি। এমনিতেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমি ভর্তি হয়েছিলাম মেডিকেলে, তার উপর সবুজ-স্মৃতির অত্যাচার; ক্লাসে মন বসতেই চায় না। শিক্ষকরা কী-সব মানুষের হাড়গোড় নিয়ে পড়ান! সেদিন কলেজে সড়কদ্বীপের কৃষ্ণচূড়ার নিচে চুপচাপ বসে ভাবছিলাম সবুজের কথাই, একজন যুবক পাশে এসে বসে। ছেলেটি আমার সহপাঠী জানি, কিন্তু নাম-পরিচয় জানি না। পাশে বসে কোন ভূমিকা না করেই বলে- : কিরে দোস্ত, মুড অফ কেনো? কী হয়েছে? : কিছু না, ক্লাস নেই তাই। যার সাথে আমার পরিচয় নেই, তার এমন গায়ে পড়ে কথা বলাটা ভালো লাগছিলো না আমার। তবুও সহপাঠী বলে সৌজন্য বজায় রাখলাম। হয়তো ছেলেটি আমার মনোভাব বুঝতে পারলো এবং নতুন করে কথা শুরু করলো- : তোর সাথে আমার আলাপ হয়নি আগে। আমি রেজা, আসাদুল হক চৌধুরী রেজা। তোর সহপাঠী, আমার বাড়ি জামালপুরে, হোস্টেলে থাকি। সবসময় তোকে বিষাদময় দেখি, তাই বন্ধু হিসেবে ভাবলাম, তোর একটু খোঁজ নিই। অবশ্য আমার ধারনা ভুলও হতে পারে। রেজার কথা শুনে আমি হাসলাম, তারপর বললাম- : বিষাদ কিছু নয়, আসলে আমার ডাক্তারিবিদ্যা পড়ার আগ্রহ ছিলো না একেবারে, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চেয়েছিলাম, সুযোগ পেলাম না, তাই হয়তো বা মনটা একটু খারাপ। আমি পারমিতা। : তোর নাম আমি জানি। কে না জানে তোর নাম; কারো সাথে তুই কথা না বললেও তোকে সবাই জানে। : ছেলেদের এটা একটা গুণ; আলাপ-পরিচয় না থাকলেও মেয়েদের ঠিকুজি ঠিকই জেনে নেয় তারা। : যেমন সুন্দরী মেয়েরা সহজে কিছু মনেই রাখতে চায় না? : প্লিজ রেজা আমাকে সুন্দরী বলে অপদস্ত করলে ভালো লাগে না! স্তাবকতা আমি মোটেই পছন্দ করি না! রেজা কিছুটা বিব্রত হলো। কী বলবে তাই খুঁজছিলো সে। তাকে পরিত্রাণ দিতেই যেনো একটা রিক্সা এগিয়ে আসে। রিক্সায় মাসুম বসা। দূর থেকেই মাসুম আমাকে ডাকে, “পারু!” মাসুমের রিক্সা থামে আমাদের সামনে। আমি রেজাকে মাসুমের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। মাসুম সরাসরি প্রশ্ন করে, “তোমার কি এখন ক্লাস নেই? জরুরি একটা কথা আছে।” হঠাৎ সপ্রতিভ একটা বাতাস যেনো আমার বুকে দুলে ওঠে, “না, একঘণ্টা বিশ মিনিট অফ। এসময় তুমি এলে, ভালোই হলো। খুব বোর ছিলাম। চলো ক্যান্টিনে যাই, একটু চা-টা খাই। রেজা, চা চলবে না-কি?” রেজা নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, “না ভাই! তোমরা যাও। আমার একটু কাজ আছে। তোমাদের জরুরি কথায় আমার না থাকাই ভালো।” কথাগুলো বলে রেজা অপেক্ষা করে না, সোজা কলেজ বিল্ডিংয়ে ঢুকে যায়। অষুধে মনে হয় কাজ হলো, রেজা আমাকে ‘তুই’ থেকে ‘তুমি’তে সরিয়ে আনলো। মাসুমের হাত ধরে আমি ক্যান্টিনের দিকে এগিয়ে যাই। মাসুমের চেহারা দেখেই আন্দাজ করছিলাম, আমার কথা এবং আচরণে ও কিছুটা অপ্রস্তুত। এতো দিনের চলাফেরায় কখনো তো আমি নিজে থেকে ওর হাত ধরিনি; আজ কেনো ধরলাম, হঠাৎ কেনো ওকে ঘনিষ্ঠতায় জড়ালাম, এসব হয়তো ওকে ভাবনায় ফেললো। ক্যান্টিনে জানালার পাশে দু’জন বসে সিঙ্গারা-চায়ের অর্ডার করলাম। সিঙ্গারা-চা খেতে খেতে আমরা কথা বলছিলাম। : কী যেনো জরুরি কথা আছে বলেছিলে? মাসুমকে একটু অন্যমনস্ক লাগছিলো। : কী হলো, বললে না, কী কথা ছিলো জরুরি? : হুম? না-না সেরকম কিছু না। : কী মুশকিল, তুমিই তো বললে, জরুরি কথা আছে? : হুÑহ্যাঁ, তা বলেছিলাম বটে, কিন্তু সেটা তোমার বন্ধুকে বোঝানোর জন্যে। : ও-কে বোঝানোর কী আছে? ও-কে তো আমি চিনিও না! আজ এই একটু আগেই প্রথম কথা হলো। ও-কে তো অতটা আমলে আনার প্রয়োজন নেই? : ও আচ্ছা। আসলে তেমন কিছুই না, তোমাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করলো, তাই চলে আসলাম। : আনন্দ সংবাদ! আমার জন্য সুখেরও। বলতো এবার, কেনো তুমি সুযোগ পেলেই আমার কাছাকাছি আসতে চাও? কী চাও আমার কাছে, আর কী-ই বা পাও? : এইসব কী ধরনের কথা কও? তুমি বোঝো না, কী চাই, আর কী পাই? : তুমি সব প্রশ্নের খুব সরল উত্তর দাও। : আমি তো আর কবি নই; কবি হলে আমিও জটিল করে উত্তর দিতে পারতাম। : সবুজ ভাইকে আমার পছন্দ ব্যঞ্জনাময় কথার জন্য, আর তোমাকে পছন্দ তোমার সারল্যের জন্য। : সবুজের কথা কেনো উঠলো? : কেনো উঠলো মানে? তুমিই তো ওঠালে। : ও তো সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলে। : তা বলে, কিন্তু সবুজ ভাই কাপুরুষ, তাই পালিয়েছে। কাপুরুষের কথা স্মরণ না করাই ভালো। আমার কথায় মাসুম খুশি হলো কি-না বুঝতে পারলাম না। ইতোমধ্যেই ক্যান্টিনের অন্য টেবিলে আমার ক্লাসের বেশ ক’জন ছেলে এসে বসেছে, ওদের আচরণে বেশ বুঝতে পারি, ওরা আমাকে আর মাসুমকে দেখতেই ভিড় করেছে। আমরা দু’জন চায়ে মনোযোগী হলাম। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। ক্লাসের সময় না হওয়া পর্যন্ত মাসুম আমার সাথেই থাকলো।

আমরা যখন ক্যান্টিন থেকে বেরুলাম, মাসুমের চোখে-মুখে আমি আনন্দের পাশাপাশি অপরাধের একটা ছায়া দেখতে পেয়েছিলাম; কিন্তু কেনো মাসুমের চোখে-মুখে অপরাধবোধ দেখেছিলাম, সে ভাবনা কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারছিলাম না। ক্লাসে সেদিন স্যার কী পড়ালেন, কিছুই মাথায় ঢুকলো না আমার। মাসুমের চেহারায় অপরাধ দেখেছিলাম, সে ভাবনা যতটা না আমায় চিন্তিত করলো, তারচেয়ে বেশি ভাবনায় ফেললো নিজেকে নিয়ে। কেনো আমার চরিত্রে এ পরিবর্তন ঘটলো, তা নিয়ে আমি দুঃশ্চিন্তায় পড়লাম। কোনো দুঃশ্চিন্তাই তো আমি বেশিক্ষণ ধারণ করতে পারি না; তাহলে এখন কেনো দুঃশ্চিন্তাগুলো মন থেকে সরাতে পারছি না? কেনো সবুজের নিরুদ্দেশ হওয়াটা মন থেকে মুছে ফেলতে পারছি না, কেনো মাসুমের অপরাধবোধ ভুলে যেতে পারছি না? মাসুম আর সবুজের চিন্তা আমায় কেনো সারাক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখছে? ওদের দু’জনকে আমি কি আকূল হয়ে ভাবছি? সবুজের কথায়, ওর দৃষ্টিতে কী যেনো এক সম্মোহন ছিলো, মুখে কিছু না বলেও ওর চোখ যেনো কত কথা বলে দিতো; ওর কথাগুলো কেনো আমার ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা হতো, ওর কথার অনুরণন সারাক্ষণ যেনো সুর হয়ে কোথায় ডেকে নিতে চাইতো আমায়; বারবার মনে হতো, যদি সবুজের হাত ধরে নিরুদ্দেশের পথে বেরিয়ে যেতে পারতাম, হয়তো আমরা দু’জনে মিলে আবিষ্কার করে নিতে পারতাম নতুন এক পৃথিবী, যে পৃথিবী হতো ভালোবাসাময়; হয়তো সে পৃথিবীতে সারাক্ষণ গান গাইতো পাখিরা; সে পৃথিবীর নদীগুলো কল্লোলিত হতো, জোয়ার-ভাটায় নদীগুলো নতুন নতুন রূপে আমাদের চোখে ধরা দিতো; সবুজের হাত ধরে ঘুরতে ঘুরতে কতো সহজেই আমি চিনে নিতে পারতাম প্রকৃতির প্রতিটি ফুলের স্বতন্ত্র সুগন্ধ, বৃক্ষের শাখায় শাখায় লিখে রাখতাম আমাদের যুগল নাম। সবুজের মধ্যে আবিষ্কার করা যেতো বিশ্বের নানান বৈচিত্র্য; আর মাসুম সাদামাটা, সরল; কিন্তু ওর মধ্যে প্রবল বিষয়মুখী বৈচিত্র্যহীনতা। ওর জীবনে উদ্বেগ বা কষ্টের ছায়া নেই। অজ¯্র বৈপরিত্যের মধ্যেও দু’জনের প্রতি অনুভব করতাম পক্ষপাতিত্ব। দু’দিন পর ডা. কামাল স্যারের সাথে আমরা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুরছি, স্যার রুগীদের বেডে বেডে গিয়ে তাদের পরীক্ষা করছিলেন, আর আমাদেরকে প্রত্যেক রুগীর সমস্যা ব্যাখ্যা করছিলেন; আর আমরা স্যারের কথা থেকে নোট নিচ্ছিলাম। হঠাৎ কয়েক বেড দূরে একজন রুগীর দিকে আমার দৃষ্টি পড়লো। কেমন যেনো চেনা চেনা লাগলো তাকে। আমি সবাইকে ফাঁকি দিয়ে এগিয়ে গেলাম সেদিকে। রুগীর মুখটা দেখে বুকের ভেতরটা আমার মোচড় দিয়ে উঠলো, সবুজ! সবুজ তখন তন্দ্রায় আচ্ছন্ন, আমার উপস্থিতি ও টের পেলো না। যন্ত্রচালিতের মতো আমি সবুজের কপালে হাত রাখলাম। সবুজ তন্দ্রার মধ্যেই আমার ডান হাতের পিঠে ওর বাঁ হাতটা রাখলো। সমস্ত শরীরে আমার যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। সবুজের চেহারায় মিশেছিলো দীর্ঘ ক্লান্তির ছায়া, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখের নিচে কালি জমে আছে, ওর লম্বা চুলগুলো উসকো-খুসকো- এলোমেলো। আমার করতলস্পর্শে তন্দ্রা ছুটে গেলো সবুজের। ক্লিষ্ট কণ্ঠে সবুজ কথা বললো, “পারমিতা, তুমি? আমি যেনো কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেললাম। সবকিছু ভুলে আমি সবুজের ডান হাতটা নিজের দু’হাতে চেপে ধরলাম, তারপর ওর হাতটা নিজের গালে চেপে ধরে প্রশ্ন করলাম, “কী হয়েছে তোমার? তুমি হাসপাতালে কেনো? কবে ভর্তি হয়েছো এখানে?” আমার কণ্ঠ ধরে আসছিলো; চোখ দু’টি ছলছল করছিলো। সবুজ অস্পষ্ট কণ্ঠে বললো, “আজ তিনদিন। পরশু অপারেশন হবে।” বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে উঠলো আমার, “কীসের অপারেশন?” সবুজের মাথার চুলে আমি ডান হাতের আঙুল দিয়ে বিলি কেটে দিচ্ছিলাম, আর বাঁহাতে অশ্রু আড়াল করছিলাম। দলবলসহ কামাল স্যার চলে আসলেন সবুজের বেডের কাছে। সস্নেহে আমায় বললেন, “এই মেয়ে, কী যেনো নাম তোমার?” পাশ থেকে পারভিন বললো, “ও স্যার পারমিতা, আমাদের সাথেই পড়ে।” “হুম, চিনি তো।” বলে স্যার আমায় প্রশ্ন করলেন, “কে হয় তোমার?” আমি স্যারের একটু কাছে সরে গিয়ে বললাম, “আমার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্যার, উনি একজন কবি। খুবই ভালো মানুষ।” স্যার মৃদু হেসে সবুজের কাছে চলে আসলেন, বাঁ হাতে সবুজের কব্জি ধরে প্রশ্ন করলেন, “কী কবি সাহেব, সমস্যা কী? ব্যথা কী আছে এখনো?” সবুজ জিভ দিয়ে নিজের ঠোঁট দু’টি ভিজিয়ে নিয়ে মৃদু মাথা নেড়ে অস্পষ্ট স্বরে বললো, “না”। স্যার সবুজের কাগজপত্রে চোখ বুলিয়ে বললেন, “চিন্তার কিছু নেই, শিগগিরই সেরে উঠবেন। নিজের উপর টর্চারটা কি বেশি হয়ে যায়? একটু সাবধানে থাকতে হবে ইয়াংম্যান। আপনি কবি মানুষ আপনাকে তো এ সমাজের মানুষের বেশি প্রয়োজন। এতো যে অনাচার-দুর্বৃত্তায়ন চলছে, এসবের বিরুদ্ধে কথা বলবে কে? কবিকেই তো বলতে হবে! সুতরাং কবিকে ভালো থাকতেই হবে। ওকে টেক রেস্ট।” স্যার এগিয়ে গেলেন অন্য বেডের দিকে; যাবার সময় আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন, “টেনশনের কিছু নেই, জলদি ভালো হয়ে যাবে।” আমি আর একবার সবুজের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বললাম, “বিশ্রাম নাও। আমি আবার বিকেলে আসবো। একদম টেনশন করবে না।” স্যারের পিছনে আমি আবার যোগ দিলাম বন্ধুদের সাথে। সারাটা দুপুর আমার সবুজময় হয়ে গেলো। ক্লাস শেষে হোস্টেলে ফিরতেই পারভিন যেনো আমায় ছাই দিয়ে ধরলো, “সত্যি করে বলতো পারমিতা ঐ রুগী তোর কে হয়?”

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App