×

শিক্ষা

ঐতিহ্য রেখেই হোক সংস্কার

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২০, ১০:০১ এএম

ঐতিহ্য রেখেই হোক সংস্কার

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তন (টিএসসি) -ভোরের কাগজ

সবুজ চত্বরে লাল কংক্রিটের ভবন। গ্রামবাংলার ঐতিহ্য কুঁড়েঘরের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গ্রিক স্থপতির নকশায় তৈরি চিরযৌবনা ওই ভবন চত্বরটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্থাপত্যকলার রোল মডেল। নিজস্ব স্বকীয়তায় বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির ধারক-বাহক হিসেবেই পেরিয়ে এসেছে সুদীর্ঘ ৫৬ বছর। ষাটের দশকে নির্মিত আধুনিক স্থাপত্যের এই অনুপম নিদর্শন সংস্কৃতিপ্রেমীদের মিলনস্থল। তারুণ্যের এই উঠোনে থমকে যাওয়া সময় গল্প শোনায় সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, প্রগতি, সম্ভাবনা ও আশার। বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্যের এই সূতিকাগারকে রক্ষণাবেক্ষণের বদলে ভেঙে বহুতল ভবন নির্মাণের আয়োজনে ব্যথিত, হতাশ সংস্কৃতিপ্রেমীসহ সাধারণ মানুষ। সময়ের প্রয়োজনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ভেঙে ফেলার বিরোধিতায় সরব অনেকেই। এক্ষেত্রে ঐতিহ্য বজায় রেখে সংস্কারের দাবি উঠেছে সর্বত্র।

টিএসসির ভেতরের খোলা চত্বরে সবুজ ঘাসের পেলব ছোঁয়া। পূর্ব দেয়ালের গা ঘেঁষে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের স্মৃতি বয়ে চলা সমাধিসৌধ। অডিটোরিয়ামের সামনে ম্যুরাল শান্তির পায়রা। রোদ-হাওয়ার দোল খাওয়া অডিটোরিয়ামের খোলা উত্তর-দক্ষিণে পানিশূন্য সুইমিংপুল সাক্ষ্য দেয় অতীত গৌরবের। দক্ষিণের প্রান্তজুড়ে নাটকের মহড়াকক্ষ, ক্যাফেটেরিয়া আর বিশ্ববিদ্যালয় অতিথিশালা। তৃতীয় তলায় বাম পাশে ছাত্র নির্দেশনা কেন্দ্র, বিশ^বিদ্যালয় রোভার স্কাউটের প্রধান কার্যালয়, দোতলায় অফিস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির কার্যালয়, পশ্চিমে সেমিনার কক্ষ ও বিভিন্ন সংগঠনের কার্যালয়। নিচতলায় জনতা ব্যাংক ও বিশ^বিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থার বিপণন কেন্দ্র। ডিবেটিং সোসাইটি, নাট্য সংসদ, চলচ্চিত্র সংসদ, মাইম অ্যাকশন, ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, জয়ধ্বনি, প্রভাতফেরি, আইটি সোসাইটি, স্লোগান-৭১, সাইন্স সোসাইটি, আবৃত্তি সংসদসহ সাংস্কৃতিক-সামাজিক সংগঠনের কেন্দ্রবিন্দু টিএসসি।

বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে টিএসসি চত্বরকে আধুনিকায়ন করা হবে। এজন্য ভেঙে ফেলা হবে এর ভবন। টিএসসির ভারপ্রাপ্ত পরিচালক সৈয়দ আলী আকবর বিশ^বিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তরকে টিএসসির নতুন অবয়বে কী কী সুযোগ-সুবিধা থাকতে পারে, তার একটি তালিকা দিয়েছেন। সম্প্রতি তালিকাটি গণপূর্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের কাছে জমা দিয়েছে বিশ^বিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তর। তালিকা অনুযায়ী- নতুন ভবন চত্বরে থাকবে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মহড়াকক্ষ, ব্যায়ামাগার, টিএসসিভিত্তিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর জন্য আধুনিক সুবিধাসংবলিত কক্ষ, আন্তক্রীড়াকক্ষ, পৃথক ক্যাফেটেরিয়া, শিক্ষক মিলনায়তন, গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য ৩ তলাবিশিষ্ট স্থান, অতিথিকক্ষসহ বেশ কিছু আধুনিক সুবিধা। একটি দেড় হাজার ও ৩০০ জন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন দুটি মিলনায়তন থাকবে। থাকবে সুইমিংপুল।

তবে টিএসসি ভেঙে ফেলার ব্যাপারে কিছুই জানেন না উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান। জানতে চাইলে তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, টিএসসি ভবনটিকে আধুনিক ভবন হিসেবে দেখতে চান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টিএসসি ভবনকে যুগোপযোগী করার নির্দেশনা প্রধানমন্ত্রীর। উপাচার্য বলেন, টিএসসির নির্মাণের সময় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৮০০, শিক্ষকের সংখ্যা ছিল ২০০ থেকে কিছু বেশি। বর্তমানে বিশ^বিদ্যালয়ে ২ হাজারের বেশি শিক্ষক আর ৪০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী। কিন্তু টিএসসি আগের মতোই আছে। এজন্য প্রধানমন্ত্রী পুনর্বিন্যাসের নির্দেশনা দিয়েছেন। গণপূর্ত মন্ত্রণালয় আমাদের কাছে প্রস্তাবনা দেয়ার পর নকশা সম্পর্কে জানতে পারব।

প্রয়োজনে নকশা উন্মুক্ত করে দেয়া হবে মন্তব্য করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) ড. মুহাম্মদ সামাদ ভোরের কাগজকে বলেন, টিএসসিতে সুন্দরভাবে সাজানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ দিয়েছেন। দোয়েল চত্বর থেকে শাহবাগ পর্যন্ত যে সাংস্কৃতিক বলয় তৈরি হবে এর অংশ হিসেবে টিএসসিকে সুন্দর, আধুনিক ও নান্দনিকভাবে তৈরি করা হবে। ভেঙে ফেলার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তৈরি ওই নকশা হাতে পাওয়ার পর আলোচনা ও সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

ঐতিহ্য বজায় রেখে সংস্কার : বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু এখন টিএসসি। পক্ষে-বিপক্ষে আসছে নানা মত। তবে ইতিহাস-ঐতিহ্যকে সঙ্গে নিয়ে উন্নয়নের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ঐতিহ্য সংরক্ষণের বিষয় মন্তব্য করে টিএসসির উপদেষ্টা সৌমিত্র শেখর ভোরের কাগজকে বলেন, ভাঙা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত এখন পর্যন্ত আমি জানি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত বলে আমার মনে হয় না। তাহলে আমরা চিঠি পেতাম। টিএসসিকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করার জন্য দেশের জনগণ সিদ্ধান্ত ও মতামত দিতে পারেন। নানা জায়গা থেকে মতামত আসা উচিত। সব ঐতিহ্য রক্ষা করা প্রয়োজন। গ্রিক স্থপতির করা এই কুঁড়েঘর ডিজাইন আমাদের বাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য করে তৈরি।

জানা গেছে, অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক উপাচার্য থাকাকালীন মূল নকশা বজায় রেখে সুইমিংপুলের জায়গাটা বহুতল ভবন করে গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশ স্থাপত্য ইনস্টিটিউটের কয়েকজন স্থপতি উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করে টিএসসির নকশায় হাত না দেয়ার জন্য তাকে অনুরোধ করেন। ট্রপিক্যাল দেশে মডেল হিসেবে টিএসসির উদাহরণ দেয়া হয়- এমন যুক্তি শুনে ওই পরিকল্পনা বাদ দেন তৎকালীন উপাচার্য। পরে টিএসসির বাঁ-দিকে ডাস ও রোকেয়া হলের মাঝে বেশকিছু বসবাসের অনুপযোগী একতলা বাংলোকে ভেঙে টিএসসির জন্য একটি ভবন করার চিন্তা করেছিলেন তিনি। সময়ের কারণে তাও ভেস্তে যায়।

অন্যদিকে ঢাবির বেদখল হওয়া জায়গাগুলো পুনরুদ্ধার, ইতিহাসের অংশ অক্ষুণ্ন রাখার দাবি জানিয়েছেন অনেকেই। তারা বলছেন, ফ্রান্সে ১ হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্য রয়েছে। সংস্কার প্রয়োজন তবে কাঠামো ভেঙে ফেলা নয়। এ ব্যাপারে স্থপতি ইকবাল হাবিব ভোরের কাগজকে বলেন, রাষ্ট্র, সভ্যতা শিল্পকলার পিঠে চড়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। শিল্পকলা-ঐতিহ্য-সংস্কৃতি জাতির ধারক-বাহক, সভ্য সংস্কৃতির বিকাশে অগ্রগণ্য। টিএসসি আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু এখন সংস্কৃতিকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে টিএসসি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে মোটেই প্রত্যাশিত নয়। তিনি বলেন, উন্নত প্রযুক্তির সহায়তায় বিকল্প তৈরি হতে পারে। ঐতিহাসিক স্থাপনা একবার ভেঙে ফেললে আর তৈরি হবে না। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অনেক প্রকল্প রয়েছে। এসব জায়গায় নতুন ভবন তৈরি হতে পারে। পরিবেশবান্ধব কোনো পরিকল্পনায় হাত দেয়া হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।

সাবেক প্রক্টর সিন্ডিকেট ও সিনেট সদস্য অধ্যাপক ড. এ এস এম আতীকুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, টিএসসি সংস্কারে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি এসেছে এটি অত্যন্ত ইতিবাচক। তবে টিএসসিকে না ভেঙে ইতিহাস ও ঐতিহ্য বজায় রেখে সম্প্রসারণ ও সংস্কার জরুরি। ৩ তলা ভবনটিকে দশ তলা ও অডিটোরিয়ামকে ৩ তলা করা যায়। তিনি বলেন, দেশের খ্যাতনামা স্থপতিদের সঙ্গে পরামর্শ করে কিভাবে ঐতিহ্য বজায় রেখে সংস্কার করা যায় সেটি দেখা উচিত।

ডাকসুর সদ্য সাবেক সাংস্কৃতিক সম্পাদক আসিফ তালুকদার ভোরের কাগজকে বলেন, ভাঙা হচ্ছে বিষয়টা ঠিক না। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুনভাবে সাজানোর উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। ঐতিহ্য বজায় রেখে শিক্ষার্থীবান্ধব টিএসসি আমাদের চাওয়া। তবে কোনোভাবেই ঐতিহ্য যেন ক্ষুণ্ন না হয়। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী নাসিম সালমান বলেন, সংস্কার জরুরি কিন্তু ঐতিহ্য ভেঙে নয়। টিএসসি আমাদের গৌরব।

নগরীর মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে খুঁজে নেন টিএসসির পায়রা চত্বর, মিলন চত্বর কিংবা রাজু ভাস্কর্য। এখন সেসব স্থানে হবে বহুতল ভবন। আগে জাতীয় দিবস, বৈশাখী উৎসব কিংবা জাতীয় দলের ক্রিকেট ম্যাচের সময় সবার গন্তব্য ছিল টিএসসি। কিন্তু টিএসসির সেই স্বরূপ আগের মতো দেখা যাবে কিনা সে বিষয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন। এ ব্যাপারে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুস ভোরের কাগজকে বলেন, টিএসসির নতুন নকশা সম্পর্কে জানি না। তবে আমি ঐতিহ্য সংরক্ষণের পক্ষে।

এদিকে টিএসসির সংস্কার জরুরি বলে মনে করছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশল দপ্তর। দপ্তরের কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইসমাইল খান ভোরের কাগজকে বলেন, আরো সুন্দর, আধুনিক করার জন্য সংস্কার জরুরি। বাইরে থেকে অনেকেই টিএসসিতে ঘুরতে আসেন। তবে পুরনো জিনিস তার ঐতিহ্য ধরে রেখেই সংস্কার করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App