×

সাময়িকী

অনন্তযাত্রায় স্থিতপ্রজ্ঞ কবি মনজুরে মওলা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২০, ১১:০২ পিএম

অনন্তযাত্রায় স্থিতপ্রজ্ঞ কবি মনজুরে মওলা

আমাদের সাহিত্যের ইতিহাসে মনজুরে মওলা একজন প্রতিভাধর কবি। ছিলেন সরকারের উচচপদস্থ আমলা, সাহিত্যবোদ্ধা ও তীক্ষ্ম সমালোচক। কিন্তু কবি হিসেবে তার পরিচয়টি আমাদের কাছে বড়। সম্প্রতি তিনি আমাদের ছেড়ে পাড়ি দিয়েছেন অনন্তলোকে। মনজুরে মওলার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নিমগ্ন, কি করে পারো’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে ১৯৭৭ সালে কবি হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ। এই গ্রন্থ-নামটি যেন নিজের কাছে ছুড়ে-দেয়া কবির প্রশ্ন- যার আড়ালে বারবার উঁকি দিয়েছেন তিনি। কবির অন্য কাব্যের নামগুলোতেও আত্মচেতনার বহিঃপ্রকাশ লক্ষণীয়। তার ‘পুড়ে পুড়ে’ কাব্যনামটি উচ্চারণ করলে মনে হয়, কবি-চৈতন্য যেন পুড়ে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। এই অন্তর্দর্শন একজন সত্যনিষ্ঠ কবির আকুতি। পরের কাব্যনাম- ‘এই দিন মিথ্যে’। এটি কবির আত্মানুসন্ধান। এরপরে বৃষ্টির মঙ্গলধারায় কবি মনজুরে মওলার কাব্যবোধের পরিবর্তন এসেছে। পরের কাব্যগুলোর নাম থেকে তা অনুমেয়- ‘বন্দনা বৃষ্টির’, কিংবা ‘আকাশ যেমনই হোক’ প্রভৃতি। সেসময় তিনি একটি উঁচুমানের সাহিত্যপত্রিকা সম্পাদনা করতেন, তার নামও ‘শ্রাবণ’। শ্রাবণের বৃষ্টিধারায় অবগাহন করে কবি একসময় দ্বারস্থ হয়েছেন ক্লাসিক সাহিত্যের। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য কিংবা টিএস এলিয়টের রচনা তার অন্বিষ্ট হয়ে ওঠে।

মনজুরে মওলার সর্বশেষ কাব্যের নাম ‘জোরে শ্বাস নাও’ প্রকাশিত হয়েছে ২০২০-এর বইমেলায়। বর্তমান করোনাকালে এই কাব্যনামটি অধিক প্রাসঙ্গিক; যদিও এর প্রকাশ করোনাকালের পূর্বমুহূর্তে। যেন কবি আগামবার্তা শোনাচ্ছেন আমাদের- এই বলে যে, সামনে আসছে জোরে জোরে শ্বাস নেয়ার কাল! কাব্যের প্রথম কবিতায় মৃত্যুচিন্তার আভাস লক্ষ করা যায়- ‘জন্ম নিলো যে-মুহূর্তে বিশ্বলোক/ ছিঁড়েখুঁড়ে শূন্যতা আশ্চর্য আলোর ঝলক/ দেখা দিয়েছিল কিনা/ তা আমি জানি না।/ অথচ সেখানে আমি তো ছিলাম।’ কবিচেতনায় ধরা পড়ুক বা না-পড়ুক প্রকৃতি নিজের নিয়মেই চলে। এই চলমান সময়স্রোতে কবিও সহগামী, চিরায়ত পথের যাত্রী। বিশ্বলোকের আশ্চর্য আলোর ঝিলিক হয়ত কবির চোখে চমক দিয়েছিল সেদিন। তাই কবিতার আলোয় বিশ্বলোকের অনুসন্ধানী হয়েছিলেন তিনি। এই কাব্যের ‘কত-কত দিনে’ শিরোনামের কবিতায় যখন বলেন, ‘মানুষের ইতিহাস মানুষ তো নিজেও জানে না।/ কখন যে জন্ম তার, কখন যে আলো দেখা দিলো/ তারায় তারায়, চোখের পাতায়, মানুষ জানে না।’ তখন ভাবি- বিজ্ঞানীরা সত্যিকার অর্থে কি পৃথিবীর সব রহস্য জানেন? না, বিজ্ঞানীরা জানেন না; কিছুটা বেশি জানেন কবিরা। কারণ এই চেতনা কবিসত্তার পরিপূরক। কবিরা লক্ষকোটি বছরের পৃথিবীকেও চেতনায় অবলোকন করতে সক্ষম। তাই কবি সদর্পে বলতে পারেন- কখন যে আলো দেখা দিলো তারায় তারায়, চোখের পাতায়, মানুষ জানে না। বিজ্ঞান বলেছে- বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছে ‘বিগ ব্যাং’ বা মহাবিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে- হাজার কোটি বছর আগে। যেন মুহূর্তে সৃষ্টিখণ্ড ছড়িয়ে পড়েছিল চতুর্দিকে। বিজ্ঞান বলে- এই মহাবিস্ফোরণের পর অন্তত দশ লক্ষ বছর বিশ্বলোক অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। কবি মনজুরে মওলা বিজ্ঞানের সত্যকে চেতনায় ধারণ করে একই কবিতায় বলছেন, ‘তোমাকে দেখিনি আমি ক কোটি বছর’। তখন তো আলোই সৃষ্টি হয়নি। বিজ্ঞানের সূত্রানুযায়ী পদার্থের অণু-পরমাণুর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় যখন ফোটনকণা মুক্তি পেলো মহাবিস্ফোরণের দশ লক্ষ বছর পর- তখন আলোকিত হলো এই ব্রহ্মাণ্ড; অর্থাৎ প্রাণীর চোখে জ্যোতি এলো, দৃষ্টির গোচরে এলো সবকিছু। তা তো পৃথিবী-নামক-গ্রহ সৃষ্টির হাজার-কোটি বছর আগের ঘটনা। তারই ধারাবাহিকতায় আমরা এলাম, তৈরি হলো আমাদের চিন্তার জগৎ!

বিজ্ঞানের এই তত্ত¡ ও তথ্যভিত্তিক জ্ঞান এবং দর্শন-ভাবনা কবিদের চৈতন্যে স্থান পেয়েছে কালক্রমে। পূর্বেই বলা হয়েছে- কবি মনজুরে মওলার ‘জোরে শ্বাস নাও’ কাব্যে এই দর্শন প্রতিভাত। গ্রন্থের প্রথম কবিতা- ‘টের পাই, বা, না-পাই’ শিরোনামের কবিতায় কবি বলছেন- ‘শূন্যতা/ আমার ভেতর থেকে জন্ম নিয়ে যায়।/ কোনও শব্দ না-করে শূন্যতা জন্ম নিয়ে যায়।/ সমস্ত আকাশ জুড়ে জন্ম নিয়ে যায়।’ এই কবিতাংশে মহাবিস্ফোরণ-পরবর্তী বিশ্বব্রহ্মাণ্ডেরর রূপ ধরা পড়েছে। হ্যাঁ, মহাবিস্ফোরণের পর শূন্যতা থেকেই জন্ম নিয়েছে সবকিছু। সৃষ্টি হয়েছে আলো। কবির দৃষ্টি তো আলোর সীমায় স্থির হয়ে থাকে না, দূর-অভ্যন্তরে কল্পলোকে প্রবেশ করে ছবির মতন ধরে রাখে প্রকৃতির রূপকে। একই কবিতায় কবি বলছেন, ‘আমারই ভেতর থেকে জন্ম নিয়েছে পৃথিবী;/ ধুলো; বরফ; আগুন। কখন নিয়েছে?/ কই, আমি তো পেলাম না টের একটুও।/ চলেছি তারার জন্ম দিয়ে আজও,/ একটুও টের না-পেয়ে।’ কবির অনুভব বিজ্ঞানের সত্যের অনুগামী। সৃষ্টির যে কাল-পরিসর আমরা জানতে পারি- তাতে মানুষের কিছু টের পাবার ফুরসত কই! বিজ্ঞান বলেছে, বিশ্বে বয়স যখন এক-সেকেন্ড, তখন বিশ্ব প্রসারিত হয়েছে দ্রুতগতিতে এবং সেই হারে উষ্ণতাও কমতে শুরু করেছে। তাই মানব-চৈতন্যের দ্রষ্টা কবির মধ্যে সেই অনুভব খুঁজে নিতে পারি সহজেই- ধুলো-বরফ কিংবা আগুনের প্রতিরূপের মধ্যে। কবি এখানেই শূন্যতার রহস্য খুঁজতে যান তার অমোঘ কাব্যোচ্চারণে।

মনজুরে মওলার চেতনলোক বিজ্ঞানের যুক্তির সমগামী। ‘যাননি’ শিরোনামের একটি কবিতায় তিনি উচ্চারণ করেছেন- ‘কেবল মানুষই পারে যুদ্ধ করতে বাতাসের সাথে’। এখানে কবি ব্যক্তিদর্শনের আশ্রয়ে অদৃশ্য বস্তুকে দৃষ্টিগ্রাহ্য করে তুলেছেন, যদিও বিজ্ঞানের সত্য তা বলে না। বিজ্ঞানের তত্ত্ব এখানেই মার খায় কবিচৈতন্যের কাছে। কে জানে- মানুষ যদি কোনোদিন বাতাসকে দৃষ্টির আয়ত্তে আনতে পারে! তবে এর বিপদও অনেক বড়; কারণ, বাতাস দৃষ্টিগ্রাহ্য হলে পৃথিবীব অন্য বস্তু দৃষ্টির আড়ালে ঢেকে পড়বে! তবে কবির সত্য যে কখনও কখনও বিজ্ঞানের সত্যকেও ছাপিয়ে যায়! পরিণত বয়সে এসে কবি যেসত্যে উপনীত হয়েছেন- তা আগামী পৃথিবীর জন্য প্রশ্ন হয়ে থেকে যায়! সেরকম করোনাকালের প্রারম্ভে প্রকাশিত ‘জোরে শ্বাস নাও’ গ্রন্থেও তার আগামবাণী সত্যরূপে প্রতিভাত হয়েছে। আবার ‘ঝড়’ শিরোনামের কবিতায় কবি বিজ্ঞানের বিদিত শক্তিকে প্রকাশ করেছেন- ‘নিজেকে ঝড়ের কাছে তুলে দিতে চাই।/ ঝড়ই শুধু সৃষ্টিশীল/ আর কিছু নয়,/ আর কিছু নয়।’ আমরা জানি- ঝড় হচ্ছে বাতাসের পারস্পরিক সংঘর্ষে রূপান্তরিত শক্তি। এই শক্তির আধার বাতাস। শক্তির ধ্বংস নেই, আছে পরিবর্তিত রূপ। ঝড়ের শক্তির কাছে, অর্থাৎ প্রকৃতির উদ্দামতার কাছে মানুষও অসহায়। অন্যত্র কবি বলছেনÑ ‘মানুষের ইচ্ছে দিয়ে চলতে/ রাজি নই আমি আর’। শক্তির আধার যদি প্রকৃতি হয়- মানুষের ইচ্ছেকেও তা দমন করতে পারে। তাই কবি নিজেকে প্রকৃতির কাছে সমর্পণ করতে চেয়েছেন। এই চাওয়ার মধ্যেও মৃত্যুচেতনা প্রবলভাবে কাজ করেছে।

বিজ্ঞানের ভাষায় সৃষ্টিজগতে কিছুই নিঃশেষ হয়ে যায় না- কেবলমাত্র রূপান্তর হয়। শক্তির বেলায়ও তাই। এই শক্তির তারতম্য হতে পারে- পদার্থের ভরের তারতম্যের কারণে। মৃত্যুপূর্বে কবি মনজুরে মওলার চৈতন্য প্রকৃতির নিগূঢ় তত্তে¡র রহস্য উদঘাটনের অভিমুখী হয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক যুগের ডাইনোসোরাস প্রসঙ্গে কবি বলছেন, ‘আমি কি ডাইনোসোরাস ছিলাম একদিন?’ কিংবা অন্য চরণে- ‘আকাশ থেকে কে কবে হাজার-হাজার পাথর/ ছুড়ে মারবে, তার জন্য দরকার নেই আমাদের/ বসে থাকার। বৃহস্পতির গায়ে ১৯৯৪-এ/ সুমেকার-লেভি আছড়ে পড়েছে যেমন’। অর্থাৎ এক গ্রহ অন্য গ্রহে গিয়ে আছড়ে পড়বে কোনো একদিন এই তত্ত্ব দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তারা বলেছেন, ‘বিগ ব্যাং’ অর্থাৎ মহাবিস্ফোরণের ফলে যেমন ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছে; তেমনি কোনোদিন হয়ত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংস-এর ব্ল্যাক-হোল তত্ত্বানুযায়ী ‘বিগ ক্রাঞ্চ’ অর্থাৎ মহাসংকোচনে এই ব্রহ্মাণ্ড পূর্বের বিন্দুতে গিয়ে মিলবে। কবির চেতনলোক তো তারও আগে চলে! সেই মহাশক্তির অংশ এখন কবি মনজুরে মওলা; মৃত্যুর পর যিনি মিশে গেছেন আদিশক্তির মধ্যে। এই করোনাকালে স্থিতপ্রজ্ঞ কবি মনজুরে মওলার অন্তর্ধান আমাদের সাহিত্যভুবন অনুভব করবে দীর্ঘদিন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App