×

সারাদেশ

হামলা মামলা অভিযোগে বিপর্যস্ত হেফাজতে ইসলাম

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৩ ডিসেম্বর ২০২০, ১০:২৮ পিএম

হামলা মামলা অভিযোগে বিপর্যস্ত হেফাজতে ইসলাম

মামুনুল হক

হামলা মামলা অভিযোগে বিপর্যস্ত হেফাজতে ইসলাম

একের পর এক অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ, মামলা-হুমকির বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে বিতর্কিত ও সমালোচিত সাম্প্রদায়িক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। সংগঠনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-বিরোধে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সাংগঠনিক কার্যক্রম। সম্প্রতি হেফাজতের ইসলামের প্রয়াত আমির শাহ আহমেদ শফীর মৃত্যুকে নিয়ে আবারো সংগঠনটির দেউলিয়াত্ব প্রকাশ পেয়েছে। আহমদ শফীকে পরিকল্পিতভাবে সন্ত্রাসী কায়দায় হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে- সম্প্রতি এমন অভিযোগ করেন নবগঠিত হেফাজতের পদবঞ্চিত শফীপন্থি সাবেক নেতারা। হেফাজতের নবনির্বাচিত কমিটির যুগ্ম-মহাসচিব মামুনুল হকের পরিকল্পনায় এবং আরেক যুগ্ম-মহাসচিব নাসির উদ্দিন মুনিরের নেতৃত্বে আহমদ শফীকে হত্যার অভিযোগ এনে গেল ১৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের আদালতে মামলা করেন শফীর শ্যালক মোহাম্মদ মঈন উদ্দিন। আদালত মামলাটি তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই’কে নির্দেশ দেন।

এদিকে শফী’র মৃত্যুকে ‘স্বাভাবিক’ উল্লেখ করে এ ঘটনায় দায়ের করা মামলাকে ‘রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের চক্রান্ত’ বলে দাবি করেছেন হেফাজত ইসলামের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী। বুধবার (২৩ ডিসেম্বর) হাটহাজারী মাদরাসা মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে হেফাজত নেতারা। মামলাটি প্রত্যাহার করা না হলে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবেন বলে হুমকি দিয়েছেন তারা। এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত প্রায় সবাই শফী হত্যার অভিযোগে দায়ের করা মামলার আসামি বলে জানা গেছে।

হেফাজত ইসলাম বাংলাদেশ এবং চট্টগ্রামের দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে হেফাজতের আমির জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুর অভিযোগ এনে যে মামলা করা হয়েছে তা ভিত্তিহীন। রাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ও মন্ত্রীর কাছ থেকে ফায়দা লুটতে মামলাটি করেছে। এটি হাটহাজারী মাদ্রাসার শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বিনষ্ট করা এবং হেফাজতের ইসলামের নেতাদের হয়রানি করার হীন চক্রান্ত ছাড়া আর কিছু নয়। সরকার বা কোনো মন্ত্রী-এমপি’র থেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধার করার জন্য এ মামলা করেছে। অবিলম্বে মামলাটি প্রত্যাহার করা না হলে দেশের ওলামায়ে কেরামের সঙ্গে আলাপ করে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে।

শফী হত্যা মামলা অভিযোগ করা হয়েছে, আহমেদ শফীর উপর তিলে তিলে নির্যাতন করা হয়েছে। মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে ক্রমাগতভাবে আহমদ শফীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়। খাবার, ওষুধ বন্ধ করে দিয়ে, নাকের অক্সিজেন খুলে ফেলে, তাকে বহনকারী অ্যাম্বুল্যান্স আটকে রেখে আহমেদ শফীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়।

এই প্রসঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে বাবুনগরী তা অস্বীকার করে বলেন, ‘আল্লামা শফীকে হত্যার অভিযোগ তুলে যারা মামলা করেছে, তারা একটি চিহ্নিত দালালগোষ্ঠী। তারা দেশের আলেম সমাজ ও সচেতন তৌহিদী জনতার কাছে প্রত্যাখ্যাত। মামলায় তথাকথিত হত্যার যেসব কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলো অতিরঞ্জিত ও মিথ্যাচারে পরিপূর্ণ এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে আমরা মনে করি। তিনি বলেন, হুজুরের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল। ওনার অক্সিজেন খোলা হয়নি। হুজুরকে মাদ্রাসা থেকে অক্সিজেন লাগানো অবস্থায় বের করা হয়েছিল। সম্পূর্ণ আল্লাহর ইচ্ছায় ওনার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল। আমরা সবাই হুজুর (আল্লামা শফি) আশেক, প্রেমিক। উনার উপর নির্যাতন করার প্রশ্নই আসে না। যে অভিযোগ করছে তা বানোয়াট, মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।’

এসময় সেই ‘দালালরা’ কারা জানতে চাইলে প্রশ্ন এড়িয়ে বাবুনগরী বলেন, ‘সবাই তাদের জানে, নাম বলার দরকার নেই। হুজুর (আল্লামা শফি) অসুস্থ থাকার সময়ও উনাকে পুঁজি করে অনেক ফায়দা লুটেছে। ছাত্র-শিক্ষকদের হয়রানি করেছে।

প্রসঙ্গত বিগত কয়েক দশক ধরে চট্টগ্রামের হাটহাজারীর আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার মুহতামিম বা মহাপরিচালকের পদে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন শাহ আহমদ শফী। এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে তিনি বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা বোর্ড বা বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশেরও (বেফাক) সভাপতির দায়িত্বও সামলাচ্ছিলেন। হেফাজতে ইসলামের আমিরের দায়িত্বও তিনি পালন করছিলেন কওমি মাদ্রাসার নেতৃত্বের ওপর ভর করেই। আহমদ শফীর উত্তরসূরি হওয়ার দ্ব›দ্ব চলছিল মাদ্রাসার নায়েবে মুহতামিম বা সহকারী পরিচালক জুনাইদ বাবুনগরী ও শফীর ছেলে আনাস মাদানীর মধ্যে। এর জেরে গত ১৭ জুন সহকারী পরিচালকের পদ হারান বাবুনগরী।

কিছুদিন পর মাদ্রাসার কার্যক্রম শুরু হলে ১৫ সেপ্টেম্বর আকস্মিকভাবে বাবুনগরীর অনুসারী কয়েক হাজার শিক্ষার্থী বিক্ষোভ শুরু করে মাদ্রাসার মধ্যেই। এ সময় প্রধান ফটক আটকে মাদ্রাসার মধ্যে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় বিক্ষোভকারীরা। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৭ সেপ্টেম্বর মাদ্রাসার শুরা কমিটির বৈঠকে আনাস মাদানীকে মাদ্রাসার সহকারী পরিচালকসহ সব পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। মুহতামিম আহমদ শফী নিজে ‘পদত্যাগ’ করেন। ওই দিনই গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় শফীকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়। পরদিন ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকায় মারা যান আহমদ শফী।

তার মৃত্যুর পর গত ১৫ নভেম্বর হেফাজতের সম্মেলন হয়। শফীপন্থীদের অংশগ্রহণ ছাড়া অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনে হেফাজতের আমির নির্বাচিত হন জুনায়েদ বাবুনগরী। মহাসচিব নির্বাচিত হন নূর হোসাইন কাসেমী। এই কমিটিরই যুগ্ম-মহাসচিব হন মাওলানা মামুনুল হক ও নাসির উদ্দিন মুনির। স¤প্রতি চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন নূর হোসাইন কাসেমী। গত ১৭ ডিসেম্বর আহমদ শফীকে হত্যার অভিযোগ এনে দায়ের করা মামলায় হেফাজতের ৩৬ জন নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। এর মধ্যে ভাস্কর্যের বিরোধিতা করে আলোচনায় আসায় হেফাজতের কেন্দ্রীয় যুগ্ম-মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হকও রয়েছেন।

সংবাদ সম্মেলনে হেফাজত ইসলামের আমির এবং হাটহাজারী মাদ্রাসার শিক্ষা পরিচালক জুনায়েদ বাবুনগরী পক্ষে লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান হেফাজতের কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক নুরুল আবছার আজহারী। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন হেফাজতের প্রধান উপদেষ্টা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী, যুগ্ম-মহাসচিব নাছির উদ্দীন মুনীর, সহকারী মহাসচিব মীর ইদরিস নদভী, সহকারী যুগ্ম মহাসচিব হাবিব উল্লাহ, প্রচার সম্পাদক নোমান ফয়জী, সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী প্রমুখ। এদের প্রায় সবাই শফী হত্যার অভিযোগে দায়ের করা মামলার আসামি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App