×

অর্থনীতি

বিদেশে বেহাল দশা এক্সচেঞ্জ হাউসের

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২০, ১১:২০ এএম

বিদেশে বেহাল দশা এক্সচেঞ্জ হাউসের

ফাইল ছবি।

আইন থাকলেও নিয়মিত পরিদর্শন হয় না।

প্রবাসে বাংলাদেশিরা যেন সহজে তাদের টাকা দেশে পাঠাতে পারেন এজন্য এক সময় পৃথিবীর বড় বড় দেশগুলোতে এক্সচেঞ্জ হাউস খোলার প্রতি আগ্রহ ছিল ব্যাংকগুলোর মধ্যে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এখন এক্সচেঞ্জ হাউস গুটিয়ে ফেলছে অনেক ব্যাংক। প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে এক্সচেঞ্জ হাউস ও ব্যাংকের শাখার সংখ্যা। এদিকে মহামারি করোনার তাণ্ডবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বেশির ভাগ এক্সচেঞ্জ হাউস বন্ধ রয়েছে। যুক্তরাজ্যে সোনালী ব্যাংকের ৬টি শাখার ৪টিই বন্ধ হয়ে গেছে। লোকসানের মুখে বেসরকারি এবি ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, সাউথ ইস্ট ব্যাংক ও পূবালী ব্যাংক লন্ডনের এক্সচেঞ্জ হাউস বন্ধ করে দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা পরিদর্শন বিভাগ ২০১৭ সালে এক্সচেঞ্জ হাউস ও শাখাগুলো পরিদর্শন নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন ও বৈদেশিক মুদ্রা পরিদর্শন বিভাগের কার্যপরিধি অনুযায়ী বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউস ও শাখাগুলো পরিদর্শন হওয়ার কথা। তা না হওয়ায় এসব শাখা ও এক্সচেঞ্জ হাউস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে যাচ্ছে।

সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জনতা ব্যাংকের ‘জনতা এক্সচেঞ্জ কোম্পানি আইএনসি’ থেকে ৬ লাখ ৩ হাজার ৯৪৭ মার্কিন ডলার চুরির ঘটনা ঘটেছে। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫ কোটি ১৩ লাখ টাকা। যদিও অর্থ উদ্ধারে নিউইয়র্কে মামলা করেছে জনতা এক্সচেঞ্জ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অব্যাহত লোকসানে ২০১৭ সালে কানাডায় এক্সচেঞ্জ হাউসের কার্যক্রম গুটিয়ে নেয় অগ্রণী ব্যাংক। এর আগে একই কারণে ২০১৬ সালে ব্যাংকটির অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থিত এক্সচেঞ্জ হাউস বন্ধ করা হয়। যুক্তরাজ্যে সোনালী ব্যাংকের ৬টি শাখার ৪টিই বন্ধ হয়ে গেছে।

এছাড়া বেসরকারি এবি ব্যাংক, মার্কেন্টাইল, এনসিসি ব্যাংক, সাউথ ইস্ট ব্যাংক ও পূবালী ব্যাংক লন্ডনের এক্সচেঞ্জ হাউস বন্ধ করে দিয়েছে। যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়া থেকে এক্সচেঞ্জ হাউস গুটিয়ে নিয়েছে এক্সিম ব্যাংক। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক কানাডা ও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক যুক্তরাষ্ট্র থেকে এক্সচেঞ্জ হাউস গুটিয়ে ফেলেছে। এতে মুদ্রা পাচারসহ যে কোনো ধরনের আর্থিক অনিয়মের আশঙ্কা দেখা যাচ্ছে।

এ অবস্থায় বিদেশে অবস্থিত শাখা ও এক্সচেঞ্জ হাউসের কার্যক্রম পরিদর্শন করা প্রয়োজন। কিন্তু এরপর দীর্ঘ তিন বছর পার হলেও তেমন একটা পরিদর্শন হয়নি বিদেশে অবস্থিত এক্সচেঞ্জ হাউস ও শাখাগুলোতে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা পরিদর্শন বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডেপুটি গভর্নর আহমেদ জামাল বলেন, বৈদেশিক মুদ্রা পরিদর্শনের জন্য আলাদা বিভাগ সৃষ্টির সময় এর কার্যপরিধিতে বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউস ও শাখা পরিদর্শনের বিষয়টি উল্লেখ ছিল।

তবে বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো শুধু প্রবাসীদের থেকে টাকা নিয়ে নির্দিষ্ট কমিশনের বিপরীতে দেশে পাঠিয়ে থাকে। ফলে এসব এক্সচেঞ্জ হাউসের কার্যক্রম পরিদর্শনের কিছু নেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর ইব্রাহিম খালেদ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যে বেশ কয়েকটি বাংলাদেশি ব্যাংককে বিদেশে এক্সচেঞ্জ হাউস খোলার অনুমতি দিয়েছিল। সেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদারকি ও সময় উপযোগী সিদ্ধান্তের অভাবে একের পর এক মুখ থুবড়ে লোকসানের মুখে বন্ধ হয়ে গেছে এক্সচেঞ্জ হাউস ও শাখা। অনেকগুলো নানা অনিয়মে জড়িয়ে বন্ধ হয়ে গেছে, যা খুবই দুঃখজনক। বিদেশে এখনো যেগুলো অবশিষ্ট রয়েছে সেগুলোতে নিয়মিত পরিদর্শন ও খোঁজখবর নেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

নিউইয়র্কে জনতা এক্সচেঞ্জের ৬ লাখ ডলার চুরি : যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জনতা ব্যাংকের জনতা এক্সচেঞ্জ কোম্পানি আইএনসি (জেইসিআই) থেকে ৬ লাখ ৩ হাজার ৯৪৭ মার্কিন ডলার চুরি হয়ে গেছে। প্রতি ডলার ৮৫ টাকা দরে হিসাব করলে বাংলাদেশি মুদ্রায় তা দাঁড়ায় ৫ কোটি ১৩ লাখ টাকা। জনতা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়, জেইসিআই, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এবং বাংলাদেশ ব্যাংক ১০ মাস ধরে চিঠি চালাচালি করলেও কোনো সুরাহা হয়নি। তবে জেইসিআই অর্থ উদ্ধারে নিউইয়র্কে মামলা করেছে, আইনজীবীও নিয়োগ করেছে। জেইসিআই ধারণা করছে, সুস্মিতা তাবাসসুম নামের এক কর্মচারী (বর্তমানে পলাতক) এ অর্থ চুরি করেছে।

অর্থ চুরির এ ঘটনাটি উদঘাটিত হয়েছে জেইসিআই, ইউএসএর বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও সিইও মাহবুবুর রহমান যোগ দেয়ার পর। তিনি যোগ দিয়েছেন চলতি বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি। যোগ দেয়ার পরদিনই তিনি দেখতে পান জেইসিআইয়ের তহবিলে গরমিল। মাহবুবুর রহমান প্রথমদিনই দেখতে পান শুরু থেকেই জেইসিআই লোকসানি প্রতিষ্ঠান। ২০১৫ সালে এর আয় ছিল ৩ হাজার ৪৫ ডলার, ব্যয় ছিল ৫৪ হাজার ৯৫৭ ডলার। প্রতি বছর আয়ের তুলনায় ব্যয় হয়েছে ১০ থেকে ১৫ গুণ বেশি। এমনকি চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২০ জুন পর্যন্ত আয় ছিল ১০ হাজার ৫৪০ ডলার। আর ব্যয় ছিল ১ লাখ ২ হাজার ৪৪০ ডলার।

মাহবুবুর রহমান গত ১৫ ও ২০ ফেব্রুয়ারি আলাদা ই-মেইল বার্তায় জনতা ব্যাংককে পুরো ঘটনার বিবরণ উল্লেখসহ জানান, জেইসিআইয়ের তহবিল থেকে ৬ লাখ ৩ হাজার ৯৪৭ মার্কিন ডলার চুরি হয়ে গেছে। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহেই জনতা ব্যাংকের নিয়মিত পর্ষদে তহবিল চুরির ঘটনা নিয়ে আলোচনা হয়। এরপর গত ১ মার্চ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলামকে পুরো ঘটনা তুলে ধরে চিঠি দেয় জনতা ব্যাংক। পুরো বিষয়টি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে গত ১৯ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরকেও চিঠি পাঠিয়েছিল আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। ব্যবস্থা না নেয়ায় গত ১৩ অক্টোবর আবার তাগিদপত্র দেয়া হয় গভর্নরকে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো পদক্ষেপ নেয়নি বলে জানা গেছে।

১১ বছর লোকসানে ইতালির জনতা এক্সচেঞ্জ : ২০০২ সালের জানুয়ারিতে এই এক্সচেঞ্জ হাউস ইতালিতে নিবন্ধিত হয়। ওই বছরের জুন থেকে এর কার্যক্রম শুরু হয়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির রোম ও মিলানে দুটি শাখা রয়েছে। ইতালিতে অবস্থিত জনতা ব্যাংকের এক্সচেঞ্জ হাউস ‘জনতা এক্সচেঞ্জ কোম্পানি’ ধারাবাহিকভাবে লোকসান দিচ্ছে। ১১ বছর টানা লোকসানে চলেছে এই একচেঞ্জ হাউস। প্রতি বছরই বাড়ছে লোকসান। ২০০৯ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩৩ লাখ ইউরো লোকসান করেছে এ প্রতিষ্ঠান। গত কয়েক বছরের লোকসান বাবদ প্রায় ১২ লাখ ইউরোর সমপরিমাণ অর্থ ইতালিতে পাঠানোর অনুমোদন চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়েছিল জনতা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক এ ধরনের ক্ষতিপূরণের অর্থ পাঠানোর অনুমতি দেয়নি।

জরিমানা গুনতে হচ্ছে সোনালী ব্যাংক ইউকে শাখা : সরকার ও সোনালী ব্যাংকের যৌথ মালিকানায় ২০০১ সালে সোনালী ব্যাংক ইউকে যুক্তরাজ্যে ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করে। দেশটিতে ৬টি শাখা খোলা হলেও দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে লোকসানে পড়ে ইতোমধ্যে চারটি শাখা বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে ২০১৩ সালের ২ জুন সোনালী ব্যাংক ইউকের ওল্ডহ্যাম শাখা থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার আত্মসাৎ করেন তৎকালীন ব্যবস্থাপক ইকবাল আহমেদ। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের লোকসানে পড়ে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে এসে শাখাটি বন্ধ করে দেয়া হয়। বড় অঙ্কের লোকসানে থাকায় গত বছরের ৩০ জুন লুটন শাখা, ৩০ সেপ্টেম্বর কেমডেন শাখা এবং ৩০ ডিসেম্বর ব্র্যাডফোর্ড শাখা বন্ধ করা হয়। বর্তমানে চালু থাকা বার্মিংহাম ও লন্ডনের প্রধান শাখাও চলছে ধুঁকে ধুঁকে। লোকসান মেটানো ও দেশটির নিয়ন্ত্রক সংস্থার নিয়মানুযায়ী মূলধন জোগান দিতে এ বছরের শুরুর দিকে সাড়ে ৩০০ কোটি টাকা জোগান দেয়া হয়েছে। যার মধ্যে সরকার দিয়েছে ১৭৮ কোটি টাকা এবং সোনালী ব্যাংক ১৭১ কোটি টাকা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App