×

মুক্তচিন্তা

বিজয়ের মাসে আরেকটি বিজয়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর ২০২০, ১০:০১ পিএম

বিজয়ের মাসে আরেকটি বিজয়

ছবি: প্রতিনিধি

মুজিব জন্মশতবার্ষিকীতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী ঘটনা ও বিজয়ের মাসে আর একটি বিজয়। এটি বাঙালি জাতির জন্য যে কত গৌরব ও কত অহংকারের বিষয় তা বলে শেষ করা যাবে না। এ পুরস্কার প্রবর্তনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামী জীবনের ইতিহাস, তাঁর নীতি ও আদর্শ, মূল্যবোধ, কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্য তাঁর অঙ্গীকারের কথা পৃথিবীর মানুষ জানতে পারবে। শিক্ষার প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ, মাতৃভাষার প্রতি অসীম মমত্ববোধ এবং বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর আত্মিক সম্পর্কের কথাও অজানা থাকবে না বিশ্ববাসীর। বাংলা সাহিত্যের উপজীব্য কী হবে? এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্থহীন। তাই মাটি ও মানুষকে কেন্দ্র করে গণমানুষের সুখ, শান্তি ও স্বপ্ন, আশা-আকাক্সক্ষাকে অবলম্বন করে গড়ে উঠবে বাংলার নিজস্ব সাহিত্য-সংস্কৃতি। দেশের সাধারণ মানুষ, যারা আজো দুঃখী, যারা আজো নিরন্তর সংগ্রাম করে বেঁচে আছে, তাদের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখকে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির উপজীব্য করার জন্য তিনি শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীদের প্রতি আহ্বান জানান। তাঁর এ আহ্বানের সঙ্গে বাংলার লোকজ সাহিত্যের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। রয়েছে দরিদ্র ও দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর অঙ্গীকারের প্রতিধ্বনি। ধনী ও দরিদ্র্যের মধ্যকার পাহাড় সমান বৈষম্য অবসানের সুপ্ত ইঙ্গিত।

ইউনেস্কোর নির্বাহী পরিষদের শরৎকালীন অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর নামে পুরস্কার দেয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। ইউনেস্কোর এ সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে জাতিসংঘের কোনো সংস্থা এই প্রথম বঙ্গবন্ধুর নামে পুরস্কার প্রবর্তন করল। সৃজনশীল অর্থনীতিতে যুবসমাজের উন্নয়নে সংস্কৃতিকর্মী, প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা কর্তৃক গৃহীত ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যোগকে উৎসাহিত করতে দুই বছর পরপর ‘ইউনেস্কো-বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ ইন দ্য ফিল্ড অব ক্রিয়েটিভ ইকোনমি’ শীর্ষক পুরস্কার দেয়া হবে। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০২১ সাল থেকে এই পুরস্কারের আর্থিক পরিমাণ ৫০ হাজার ডলার বা প্রায় ৪২ লাখ টাকা। এই টাকা বাংলাদেশ সরকার প্রদান করবে। ইউনেস্কোর নির্বাচিত পাঁচজন বিচারক বিজয়ী নির্বাচিত করবেন। পুরস্কারটি ২০২১ সালের নভেম্বরে ইউনেস্কোর ৪১তম সাধারণ সভা চলাকালে প্রদান করা হবে। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর জীবনদর্শনের আন্তর্জাতিককরণ এবং তা বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়ার জন্য ইউনেস্কো পুরস্কার সবচেয়ে উপযোগী মাধ্যম বলে বাংলাদেশ সরকার মনে করে।

বিশ্ব ঐতিহ্য ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার আন্তর্জাতিক তালিকাই মূলত মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ডের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন অংশের ঘটনার সংরক্ষণ ও সবার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে ইউনেস্কো। এই তালিকায় ঠাঁই পেতে হলে পর্যাপ্ত গ্রহণযোগ্যতা ও ঐতিহাসিক প্রভাব থাকতে হয়। ইউনেস্কো অধিক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতিমান ব্যক্তির ও প্রতিষ্ঠানের নামে এখন পর্যন্ত ২৩টি ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রচলিত হয়েছে। ইউনেস্কোর অধিক্ষেত্র যেমন- শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, বাকস্বাধীনতা প্রভৃতি ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু অবদান ও বাংলাদেশ সরকারের ইউনেস্কোর প্রতি অঙ্গীকারের কথা বিবেচনায় নিয়ে ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর নামে এই গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রবর্তনের সম্মতি প্রদান করে।

এখন দেখা যাক এই মহান নেতা ব্রিটিশ সামাজ্যবাদ ও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক প্রায় ২০০ বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ নির্যাতিত-নিপীড়িত এবং শোষিত-বঞ্চিত একটি জাতির ভাগ্য উন্নয়নে শিক্ষা ক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন? শিক্ষা এমন একটি অস্ত্র, এমন এক জাদুমন্ত্র, যার মাধ্যমে একটি পরিবার, একটি সমাজ, একটি দেশ এমনকি সারা পৃথিবীকে পরিবর্তন করা যায়। দূর করা যায় দারিদ্র্য। আনা যায় অর্থনৈতিক মুক্তি। আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন মেন্ডেলার মতো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও এ কথা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করতেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনী জনসভায় তিনি শিক্ষায় বিনিয়োগকে সর্বশ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ বলে অভিহিত করেন। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদের গৃহীত আর ১৬ ডিসেম্বরে কার্যকর করা দেশের প্রথম সংবিধানে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয় শিক্ষার ভবিষ্যৎ। সংবিধানের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগের বিভিন্ন অনুচ্ছেদে তুলে ধরা হয় সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করাসহ শিক্ষা সম্পর্কিত সুস্পষ্ট নির্দেশনা। ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে গঠিত জাতীয় শিক্ষা কমিশনের মধ্যেও দেখতে পাওয়া বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শনের প্রতিফলন। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদার নেতৃত্বে ও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় প্রণীত জাতীয় শিক্ষা কমিশন রিপোর্টে নির্ধারণ করে দেয়া হয় সংবিধানের চার নীতির আলোকে শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যাবলি। এর মধ্য দিয়েই অপসারিত হয় ঔপনিবেশিক আমলের শিক্ষা বিস্তারের পথের সব বাধা-বিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা। সোনার বাংলা গড়ার জন্য যে সোনার মানুষ দরকার- এ কথাটি তিনি বারবার উচ্চারণ করেন। তাই তিনি নিরক্ষতার অভিশাপ থেকে জাতিকে মুক্ত করে সব মানুষকে শিক্ষিত করে একটি উন্নত দেশ গড়ার প্রত্যয়ে শিক্ষার ওপর সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেন। ১৯৭২ সালে দেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ ছিল নিরক্ষর। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ছিল শতকরা ৫০ ভাগ শিশু। তাহলে এসব শিক্ষাবঞ্চিত শিশুকে নিয়ে ভবিষ্যতে তিনি কীভাবে সোনার বাংলা গড়বেন? এটাই ছিল তার বড় ভাবনা। তাই তিনি নজর দিলেন চীনের মহান নেতা মাও সেতুংয়ের মতো শিক্ষার তৃণমূল প্রাথমিক পর্যায়ে। তিনি প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করেন। ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে করেন সরকারিকরণ। একই সঙ্গে স্থাপন করেন ১১ হাজার নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয়। আজ জাতি শিক্ষার যে সুফল ভোগ করছে তার ভিত্তিটা তৈরি করেছিলেন দূরদর্শী দরিদ্র দরদি নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। উচ্চশিক্ষায় বঙ্গবন্ধুর সুদূরপ্রসারী ও স্বাধীন চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন দেখা যায়। তিনি স্বাধীনতার পরই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিদ্যমান ১৯৬২ সালের আইয়ুব খানের কালাকানুন থেকে মুক্ত করার যুগান্তকারী ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ/আইন প্রণয়ন করেন। ওই সময় চারটি বিশ্ববিদ্যালয় স্বতন্ত্র আইন ও আদেশের কারণে পেয়েছিল স্বায়ত্তশাসনের অধিকার। সমৃদ্ধ দেশ গড়ার প্রত্যয়ে তিনি চেয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হোক মুক্ত জ্ঞান চর্চার সূতিকাগার, যেখান থেকে ভবিষ্যতে বেরিয়ে আসবে সোনার বাংলা গড়ার কারিগর। বাংলা, বাঙালি ও বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর জীবন, সংগ্রাম ও রাজনীতি ছিল ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে বাংলা কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক ও চলচ্চিত্রে গণমানুষের জীবন, সংগ্রাম ও দ্রোহ নিয়ে যে নতুন ধারার সৃষ্টি হয়, তার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ইউনেস্কো শিক্ষা, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি প্রভৃতি বিষয়সহ স্বীয় অধিক্ষেত্রে বিভিন্ন অঙ্গনে অবদান রাখার স্বীকৃতিস্বরূপ সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রবর্তন করে থাকে। এই প্রথম বাংলাদেশ তথা বাংলাদেশের কোনো প্রথিতযশা সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির নামে ইউনেস্কো একটি আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রবর্তন করল। বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু যে এক ও অভিন্ন তা পুরস্কারের শিরোনাম থেকেই বোঝা যায়। এ পুরস্কার বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিং ও ইমেজ বিল্ডিংয়ে বিশেষ ভ‚মিকা পালন করবে।

এর আগে ১৯৯৯ সালে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার মাধ্যমেও ইউনেস্কো বাংলাদেশকে সম্মানিত করে। এছাড়া ষাট গম্বুজ মসজিদ, পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার এবং সুন্দরবনকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে এবং বাউল গান, জামদানি, মঙ্গল শোভাযাত্রা ও শীতল পাটি বিশ্ব অপরিমেয় ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশকে সুপরিচিত করেছে ইউনেস্কো। তাই এই শুভ সময়ে আমাদের উচিত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ, ভাবনাও চিন্তা-চেতনাকে বুকে ধারণ করে তাঁর স্বপ্ন সোনার বাংলা নির্মাণের কাজে নিজেদের আত্মনিয়োগ করা।

নিতাই চন্দ্র রায় : কৃষিবিদ ও কলাম লেখক।

[email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App