×

ইতিহাস ও ঐতিহ্য

মিত্রবাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণে শত্রুমুক্ত হয় সৈয়দপুর

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২০, ১২:২২ পিএম

মিত্রবাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণে শত্রুমুক্ত হয় সৈয়দপুর

১৮ ডিসেম্বর সৈয়দপুর বিজয় দিবস পর্ব-২

রেল কারখানার গণহত্যা : বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলনের সমর্থনে কর্মস্থলে যোগদানে বিরত থাকা সৈয়দপুরের রেল কারখানার বাঙালি কর্মচারী ও শ্রমিকদের পাকিস্তানি সেনা সহায়তায় সংগঠিত অবাঙালি রেল কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কাজে যোগদানের জন্য ভীতি প্রদর্শন করেন। ২৬ মার্চ সৈয়দপুরের আতঙ্কিত বাঙালি শ্রমিক-কর্মচারীদের উদ্দেশে রেল কলোনিতে মাইকিং করে সর্বশেষ হুমকিসূচক ঘোষণায় বলা হয়- ২৭ মার্চ তারা কাজে যোগদান না করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ কারণে ২৭ মার্চ অনেকটা বাধ্য হয়ে কিছু কর্মচারী কাজে যোগদানের উদ্দেশ্যে কারখানায় যান। তাদের মধ্যে স্টোর ও অ্যাকাউন্টস অফিসার হোমিও ডা. এম এ আজিজ সেদিন কারখানা গেটের সামনেই শহীদ হন বিহারিদের অস্ত্রের আঘাতে। একই দিন তাদের হাতে শহীদ হন নাম না জানা আরো ৫ জন নিরীহ বাঙালি।

সৈয়দপুর রেল কারখানার সবচেয়ে বড় গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল ১৯৭১-এর ১৪, ১৫, ১৬ এপ্রিল। এই ৩ দিনে প্রায় ৪০০-৪৫০ বাঙালি রেল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বাধ্য করে কাজে যোগদানের উদ্দেশ্যে এনে ১২০০-২৫০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রার বিশাল আকারের বয়লার ও ফার্নেস চুলায় নিক্ষেপ করে পুড়িয়ে মারে। বয়লার/ফার্নেসগুলো লোহা গলানোর কাজে ব্যবহৃত হতো। এই নির্মম গণহত্যার নেতৃত্বে ছিলেন বিহারি মতিন হাশমী, মো. হব্বু, মো. জাহিদসহ আরো অনেক রেল কর্মকর্তা-কর্মচারী। এই গণহত্যার শিকার ১৭৭ জন শহীদের নাম জানা গেলেও অজানাই রয়ে গেছে বাকি শহীদদের ইতিহাস। বালারখাইল গণহত্যা : তৎকালীন সৈয়দপুর পৌর চেয়ারম্যান, কমিশনারসহ বিভিন্ন মৌজার অবাঙালি নেতৃস্থানীয়রা ও পাকিস্তানি সেনা সমন্বয়ে ২১ সদস্যবিশিষ্ট যৌথ শান্তি কমিটি গঠন করে মধ্য এপ্রিলে। বিহারি কাইয়ুম ছিলেন কমিটির চেয়ারম্যান ও কর্ণধার এবং প্রভাবশালী সদস্যরা হলেন- মাওলানা সালেহ অহমেদ, ইউসুফ বাট, ইসমাইল মাছুয়া, মতিন হাশমী, ইজহার আহমেদ, অধ্যাপক তসলিম প্রমুখ। শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানের নির্দেশে পাকিস্তানি সেনা সহযোগে রাজাকার ইজহার ও তার অনুসারীরা ৮ জন শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাসহ শহরের বহু বাঙালি হত্যা করেন। ২৫ মার্চ রাতে বিহারি নেতারা পাকিস্তানি সেনা সহায়তায় তৎকালীন এমপিএ ডা. জিকরুল হক, ডা. শামসুল হক, ডা. বদিউজ্জামান, ডা. আমিনুল হক, তুলসীরাম আগরওয়ালা, যমুনা প্রসাদ কেডিয়াসহ প্রায় ১০০ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিসহ প্রায় ৬০ জন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সদস্যকে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে বন্দি রেখে তিন সপ্তাহ ধরে নির্যাতন চালায়। ২৫ মার্চ থেকে নির্যাতনের পর ১২ এপ্রিল সেনাবাহিনীর ৩টি ট্রাকে করে রংপুর ক্যান্টনমেন্টের নিকটস্থ নিসবেতগঞ্জের ‘বালারখাইল’ এলাকায় নিয়ে পাকিস্তানি অফিসারদের করা প্রতিজ্ঞা (ÔWe will make this country a land of prostitute, a land of slaves, a land of beggers’)। পুরনো বন্দিদের চোখ-হাত বাঁধা অবস্থায় ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয়। সেদিনের হত্যাকাণ্ডে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া কমলা প্রসাদের বিবরণ থেকে জানা যায়, সেদিন বালারখাইলে নেতাসহ প্রায় ১৫০ জন মানুষকে হত্যা করা হয়।

গোলাহাট গণহত্যা : ট্রেন অপারেশন ‘খরচা খাতা’ ১৯৭১-এর ১৩ জুন সৈয়দপুরে সংঘটিত আর এক ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞের নাম ‘অপারেশন খরচা খাতা’। ১৯৭১-এর ৫ জুন থেকে সৈয়দপুর শহরে অবাঙালি নেতারা, পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাপ্টেন গুল ও তার সৈন্য বাহিনীর তত্ত্বাবধানে মাইকে ঘোষণা দেয় আটকে পড়া হিন্দু, মাড়োয়ারিদের নিরাপদে ভারতে পৌঁছে দেয়া হবে। এ জন্য চার বগির একটি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ট্রেনটি সৈয়দপুর থেকে চিলাহাটি সীমান্ত হয়ে ভারতের জলপাইগুড়ি হয়ে শিলিগুড়ির উদ্দেশে ছেড়ে যাবে। মাইকিংয়ের ঘোষণা শুনে অবরুদ্ধদশা থেকে মুক্তির আশায় শ্যামলাল আগরওয়ালার মতো অনেকে ১৩ জুন একত্রিত হয়ে গাদাগাদি করে ওঠে বসলেন ট্রেনে। তবে ট্রেনে ওঠার আগে সব যাত্রীকে একত্রিত করে ৩ ভাগে ভাগ করে আলাদা করা হয় বৃদ্ধ ও যুবকদের। তারপর ট্রেনে ওঠার অনুমতি দিলেও অবাঙালিরা ২০-২২ জন তরুণী/নববধূকে আলাদা করে পাকিস্তানি অফিসারদের নজরানাস্বরূপ গোলাহাটের ‘আস্তানা-ই-হক’ ও ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়। এদের মধ্যে ছিলেন রজনী সিংহানিয়া, কাঞ্চন দেবী সিংহানিয়াসহ অনেকে। ওই ট্রেনের অন্য এক যাত্রী তপন কুমার দাস কাল্টু জানান, সকাল ১০টার দিকে ট্রেনটি ছাড়ার পর ধপাধপ ট্রেনের সব জানালা-দরজা বন্ধ করা হচ্ছিল। বিনোদ আগরওয়ালা জানান শহর থেকে প্রায় ২ কি.মি. দূরে গোলাহাটের নিকট আসতেই ট্রেনটি থেমে যায়। এরপর কম্পার্টমেন্টের দরজা খুলে হাতে রামদাসহ ঢুকল কয়েকজন বিহারি। তিনি কম্পার্টমেন্টের বাইরে উঁকি দিয়ে দেখলেন পাকিস্তানি সেনারা গোটা এলাকা ঘিরে রেখেছে। এ সময় বিহারিদের চিৎকার করে বলে- ‘মালাউন কা বাচ্চা, তুম লোগকো মারণে কি লিয়ে সারকার কা কিমতি গোলি কিউ খারচ কারু?’ আর রামদা দিয়ে এক এক করে যাত্রীদের কোপাতে কোপাতে ট্রেন থেকে বের করে। এই নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ অবাঙালির কাছে পরিচিত ‘অপারেশন খরচা খাতা’ নামে, আর বাঙালিদের নিকট গোলাহাট গণহত্যা নামে। এ হত্যাকাণ্ডে শহীদ হন প্রায় ৪৪৮ জন হিন্দু মাড়োয়ারি। এই নিষ্ঠুরতা থেকে সেদিন কোনোক্রমে প্রাণে বেঁচে যান শ্যামলাল আগরওয়ালা, বিনোদ আগরওয়ালা, তপন কুমার দাস কাল্টু, শ্যাম সুন্দর দাস প্রমুখ। অবাঙালি ও পাকিস্তানি সেনার আক্রোশের স্বীকার সৈয়দপুরের শহীদের সংখ্যা প্রায় ১০,০০০।

মিত্র বাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণে সৈয়দপুরের পতন চূড়ান্ত আক্রমণের জন্য সৈয়দপুরে চালানো হয় দুই দিক থেকে অভিযান। মুক্তি বাহিনীর কমান্ডার সামসুল হক সরকার জানান, রংপুর, দিনাজপুর, নীলফামারী ও পার্বতীপুরে পরাজিত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসর অবাঙালিরা জড়ো হয়ে আশ্রয় নেয় সৈয়দপুর সেনানিবাসে। ডোমার থানার সীমান্তবর্তী হিমকুমারী ক্যাম্প থেকে মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনী যৌথভাবে নীলফামারীর নটখানায় ক্যাম্প স্থাপন করে এবং সেখান থেকে ট্যাংক বহর নিয়ে সৈয়দপুর আসে ১৮ ডিসেম্বর সকালে, অবস্থান নেয় শহরের ওয়াপদা এলাকায়। নেতৃত্বে ছিলেন মিত্র বাহিনীর কমান্ডার কর্নেল জোগল ও মেজর কান্ত পাল এবং মুক্তি বাহিনীর ৬নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন ইকবাল ও মুক্তি বাহিনীর কমান্ডার সামসুল হক সরকার। এদিন মিত্র বাহিনী সৈয়দপুরে প্রবেশ করে তার বার্তায় পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়ে তাদের নিরস্ত্র করলে সৈয়দপুর শত্রুমুক্ত হয়।

অন্যদিকে সৈয়দপুর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার জিকরুল হক সৈয়দপুরের বিজয় দিবসের স্মৃতিচারণে বলেন, ১৬ ডিসেম্বর দেশ শত্রুমুক্ত হলেও সৈয়দপুরকে মুক্ত করতে ১৮ ডিসেম্বর সকালে মুক্তি বাহিনীর একটি কনভয় দিনাজপুর রোড হয়ে শহরের কুন্দলে আসে। মুক্তিযোদ্ধারা শহরে ঢোকার মুহূর্তে সশস্ত্র অবাঙালি ও পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে শহীদ হন কামারপুকুর ইউনিয়নের ব্রহ্মোত্তর গ্রামের তরুণ মো. মমতাজ ও মুক্তি বাহিনীর সদস্য জয়নাল আবেদীন। গোটা শহর সশস্ত্র অবাঙালিদের দখলে থাকলেও ভারী অস্ত্রে সজ্জিত মিত্র বাহিনীর নিকট তাদের পতন ঘটে।

সৈয়দপুর সেনানিবাসের তৎকালীন বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ কর্মকর্তা মির্জা আকতারুল ইসলাম আরো জানান, ‘১৬ ডিসেম্বর রাতে চিলাহাটি সীমান্ত দিয়ে মিত্র বাহিনীর ও মুক্তি বাহিনীর যৌথ কমান্ড ব্রিগেডিয়ার জোশির নেতৃত্বে জিপ, ট্রাক, ট্যাংকসহ শ’খানেক যানবাহনের বিশাল কনভয় নিয়ে প্রবেশ করে সৈয়দপুরে। ‘হাতিয়ার ডাল দো’, অর্থাৎ ‘অস্ত্র ফেলে দাও’ বলে সেনানিবাস জুড়ে সারারাত মাইকিং চলে।’ সেনানিবাসের পশ্চিমে নির্মাণাধীন বিমানবন্দরে ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ আত্মসমর্পণ করে সৈয়দপুরে অবস্থানরত সৈন্যদের পাশাপাশি পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, জয়পুরহাট ও দিনাজপুর থেকে আগত প্রায় ৫ হাজার পাকিস্তানি সৈন্য।

শেষ কথা : দেশজুড়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দুদিন আগেই সৈয়দপুরে মুক্তির লড়াই শুরু হয় অবাঙালিদের হঠকারিতায়, আর তাদের প্রতিরোধের কারণে শত্রুমুক্ত হয় বিজয়ের দুদিন পর। সৈয়দপুরের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আলোচনা ও গবেষণা করতে আগ্রহীদের মধ্যে এখনো ‘ঝুঁকিপূর্ণ কাজ’ হিসেবে এক ধরনের ভীতি সঞ্চারিত হয়- যা স্বাধীন দেশে কাম্য নয়। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি ছাড়া জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে একত্রিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের মাধ্যমে জন্ম দিয়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। অথচ ৩০ লাখ শহীদের রক্তস্নাত স্বাধীনতা অর্জনের প্রায় ৫০ বছর পরেও মুক্তিযুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচিত হয়নি। আরেক দিকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-আদর্শ-চেতনা ও সুফলকে কাস্টমাইজড করে ব্যক্তি, পরিবার, সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীগতভাবে বিপণন করছে এক ধরনের মানুষ। বিজয়ের ৫০তম বছরে আপনজন হারানো পরিবারগুলোর ত্যাগের ইতিহাস প্রণীত হবে- এটাই প্রত্যাশা যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বহমান রাখবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে। সৈয়দপুরের স্থানীয় জনমানুষ, বিশেষত বর্তমান প্রজন্মের নিকট মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের আত্মত্যাগ গৌরব ও অনুপ্রেরণার হলেও সরকারিভাবে সৈয়দপুরের সব বধ্যভূমির স্বীকৃতি এখনো নেই। সেগুলো সংরক্ষণে অবহেলা সর্বদা দৃশ্যমান, এখনো দেয়া হয়নি শহীদ ও শহীদ পরিবারগুলোর স্বীকৃতি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App