×

সাময়িকী

পারমিতার জগৎ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০২০, ০৯:০০ পিএম

পারমিতার জগৎ

তিন.

হাত দেখে আমি অতীত-ভবিষ্যৎ বলে দিতে পারি, এ খবরটি রাতারাতি ছড়িয়ে পড়লো মহল্লার মেয়েদের কাছে; এবং অনেকের কাছেই তখন বাড়তি খাতির-যত্ন পেতে থাকলাম; কিন্তু যার হাত দেখে আমার এ খ্যাতি ছড়ালো সেই পারমিতা যেনো হারিয়ে গেল আমার জীবন থেকে। পারমিতা ছাড়া জীবন আমার অর্থহীন হয়ে গেলো। জীবনের নতুন দিশা খুঁজে পেতে আমি প্রকৃতির বুকে আশ্রয় নিতে একদিন হারিয়ে গেলাম অরণ্যের আলো খুঁজতে। পথহারা পাখি উড়ে বেড়াক পথে পথে পথের সন্ধানে। একদিন পরিযায়ী হয়ে চেনা পৃথিবীর সীমানা পেরিয়ে ভিন্ন কোন পৃথিবীতে ভিন্ন আলোর অন্বেষণে ছুটে যাক। আমার বিশ্ব খোঁজার ফাঁকে পারমিতার দিন চলমান ছিলো তার ঘনিষ্ঠজনের সাথে। আমি বরং আমার নিরুদ্দেশ জীবনের একাকীত্বে ব্যস্ত হয়ে থাকি; আপনারা ততক্ষণ পারমিতার বয়নে শুনে নিন কাহিনির অন্য গল্প; হয়তো সেখানে আমি নাও থাকতে পারি। সুতরাং পাঠক, আপাতত আমার বিদায়।

পারমিতার কথা আমি পারমিতা, যার সাথে আপনার সাক্ষাৎ হয়েছে একজন সবুজের জবানীতে। খুব সাধারণ নিরাভরণ একজন মেয়ে আমি। বাবার চতুর্থ সন্তান হলেও মায়ের তৃতীয় সন্তান। আমার বাবা প্রথম যাকে বিয়ে করেন তিনি সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। কন্যাসন্তানের পিতা হয়েছিলেন আমার বাবা। মাতৃহারা একমাত্র কন্যাকে নিয়ে কাটছিলো বাবার জীবন; কিন্তু পরিবারের অন্যান্য সদস্যের চাপে বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন, মাকে। আমার মায়ের গর্ভে জন্মেছিলাম আমরা চার ভাই-বোন। মেজ’পা, ভাইয়া, আমি আর দীপ্ত। বড়আপা যে আমাদের সৎবোন, তা আমরা কোনোদিন বুঝতেও পারিনি। মা কখনো তা বোঝার সুযোগই দেননি। আর আমার তো জন্মই হয়েছিলো বড়আপার বিয়ের দেড়বছর পর। জামালপুর নামের এক-সড়কের মহকুমা শহরে আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। এক অর্থে আমাকে গ্রামের মেয়েও বলা যায়। গ্রামের মেয়ে হলেও খুব শৈশবেই লম্বা সময়ের জন্য আমার একাধিকবার চট্টগ্রামে বড় আপার বাসায় সময় কাটাবার সুযোগ হয়। বড় আপার বড় মেয়ে নিশা আর আমি প্রায় সমবয়সী; সুতরাং শৈশবে বড় আপার বাড়িতে বেড়ানোটা ছিল আমার জন্য পরমানন্দের। বড় আপার বাসায় যাবার আগ্রহ থাকতো সবসময়, যে কোনো ছুটি-ছাটায় ছুটতে চাইতাম চট্টগ্রাম। বড় দুলাভাই ছিলেন শহরের নামকরা উকিল, তাঁর কিছু লেখালেখিরও বাতিক ছিলো; কিন্তু লেখালেখিতে তেমন খ্যাতি না থাকলেও, জ্ঞান-মেধা আর মনীষার জন্য তিনি ছিলেন সর্বমহলে আলোচিত মানুষ। না বুঝেই আমি তাঁর অনুরক্ত ছিলাম। জামালপুরের মেয়ে হয়েও আমি জামালপুরের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে পারতাম না, এ নিয়ে বন্ধুমহলে বেশ হাসি-ঠাট্টা হতো আমাকে নিয়ে। আমি যে দেখতে অনেকটাই সুশ্রী তা আমি কখনো বুঝতাম না, তবে বন্ধুরা কেউ কেউ বলতো আমার হাসিটা না-কি সুচিত্রা সেন-এর মতো, চেহারাটাও না-কি সুচিত্রা সেন-এরই মতো। তখন আমি ক্লাস সিক্সে। স্কুল থেকে বাসায় ফেরার পথে যেদিন তিন-চারজন ছেলে আমার পথ আগলে দাঁড়ালো, আর একটি ছেলে সরাসরি আমার হাতে ভাঁজ করা একটা কাগজ দিয়ে বললো, “আগামীকাল এর জবাব চাই ইন্দ্রাণী।” আমি কিছুটা হতচকিত হয়ে পড়লাম। কে ইন্দ্রাণী? আমি তো ইন্দ্রাণী নই! তাহলে ছেলেটি কেন আমায় ইন্দ্রাণী নামে ডাকলো? সেদিন কোন রকম পালিয়ে এসেছিলাম বন্ধুদের সাথে। বাসায় ফিরে কাউকে কিছু বলিনি। একবার ভেবেছিলাম আম্মাকে খুলে বলি সব, বলা হলো না। বড় ভাইকে বলতে গিয়েও লজ্জা লাগলো। পরদিন ‘পেটে ব্যথা হচ্ছে’ বলে স্কুলে যাওয়া থেকে বিরত থাকলাম। বিকেলে বাসায় এলো জ্যোৎস্না। জ্যোৎস্না আমার ভালো বন্ধু। ও আমায় গোপনে জানালো, ছেলেটা না-কি আজও রাস্তায় আমার অপেক্ষায় ছিলো। জ্যোৎস্নাকে জিজ্ঞাসাও করেছিলো আমার কথা, “কিরে জ্যোৎস্না, তোর বান্ধবী সুচিত্রা সেন কোথায়? স্কুলে এলো না কেনো?” জ্যোৎস্না ওকে মিথ্যে করে বলেছিলো, “কেন আপনি ওকে চিঠি দিতে গেলেন? ওকে তো ওর বড় ভাই স্কুলে আসতে দেয়নি।” জ্যোৎস্নার কাছেই জেনেছিলাম ছেলেটির বাড়ি শহরতলী পাথালিয়ায়। পরদিন যখন স্কুলে যাই, পথে ছেলেটিকে দেখিনি। কয়েকদিন পর পরীক্ষা শুরু হলো, আমি নির্বিঘেœই পরীক্ষা দিলাম। ছেলেটি আর কখনো আমায় বিরক্ত করেনি; কেন ছেলেটি লাপাত্তা হলো, জানি না। পরবর্তীতে আমার পিছনে অনেক ছেলেই লাইন দিয়েছে, কিন্তু আমি কখনো পাত্তা দিইনি; পাত্তা দিইনি মানে, আমার আসলে পাত্তা দেবার সাহসই হয়নি। পাথালিয়ার যে ছেলেটি আমায় চিঠি দিয়েছিলো, মনে মনে আমি কিন্তু তাকে পছন্দই করেছিলাম। তার দেয়া চিঠিটা বেশ ক’বছর আমি সযতেœ লুকিয়েও রেখেছিলাম। আমার বারবার কেবল মনে হতো, কেনো সে আমায় ইন্দ্রাণী নামে ডেকেছিলো? অনেক বছর পরে জেনেছিলাম, আসলে ‘ইন্দ্রাণী’ নামে একটা ছবি তৈরি হয়েছিলো, যার নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন সুচিত্রা সেন। কিশোর বয়সে আমায় সুচিত্রা সেন ডেকে ছেলেটি আমার মনে একটা স্বপ্ন এঁকে দিয়েছিলো, নিজেকে আমি সুচিত্রা সেন ভাবতে থাকলাম। যা হোক, সেবার পরীক্ষা শেষ হবার পরই আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। ডাক্তার পরীক্ষা করে বললেন, “টায়ফয়েড মনে হচ্ছে! রক্তের এই পরীক্ষাটা করান।” কাগজে কিছু লিখে দিলেন ডাক্তার। রক্ত পরীক্ষার পর জানা গেল, আমার টায়ফয়েড হয়েছে। অনেকদিন আমি অসুস্থ ছিলাম। আব্বা-আম্মা-ভাই-বোন সবাই উদ্বিগ্ন। এ-সময় মেজ’পার বিয়ের কথা চলছে, আমার অসুস্থতার জন্য বিয়ের তারিখ পিছিয়ে যাচ্ছিলো। আমি সুস্থ হয়ে ওঠার পর মেজ’পার বিয়ে হয়ে গেল ময়মনসিংহ শহরে। আমার আরও একটা বেড়াবার ঠিকানা হলো। জামালপুর থেকে চট্টগ্রাম যাওয়া যতটাই কঠিন, ময়মনসিংহে যাওয়াটা ততটাই সহজ, তাই সুযোগ পেলেই মেজ’পার শ্বশুড়বাড়ি চলে যেতাম। বড় দুলাভাইয়ের বাসায় যখন গেছি, তখন আমাকে নিয়ে কারো তেমন আগ্রহ লক্ষ করিনি, তবে আদর পেতাম যথেষ্টই; কিন্তু মেজ’পার ওখানে অন্য পরিবেশ। আমাকে নিয়ে মেজ’পার দুই দেবর করিম ভাই আর মাসুম ভাইয়ের উৎসাহ দেখে আমি আনন্দ পেতাম; আনন্দ পেতাম মহল্লার অন্যসব যুবকের আগ্রহেও। মেজ’পার দুই দেবর ছাড়াও ওদের পড়শি সবুজ ভাইয়ের আচরণ মাঝে মাঝে একান্তে আমায় ভাবনায় ফেলতো। সবুজ ভাইয়ের সাথে কথা বলতে আমার মন আকুপাকু করতো; কিন্তু করিম ভাই আর মাসুম ভাইয়ের কারণে সবুজ ভাইয়ের সাথে মিশবার কোন সুযোগই হতো না। সেবার নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলাম। হোস্টেলে থাকি, কখনো স্বল্প সময়ের জন্য মেজ’পার বাসায় যাই; করিম ভাই আর মাসুম ভাইয়ের সান্নিধ্য পেলেও সবুজ ভাইয়ের দেখা পাই না কখনো। ওদের বাসায় সবাই সবুজ ভাইয়ের প্রতি আমার দুর্বলতা নিয়ে সন্দেহ করতো; বিশেষ করে মাসুম ভাই। ওরা কেউ চাইতো না, আমি সবুজ ভাইয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ হই। সবুজ ভাই যেদিন মেজ’পার ঘরে বসে আমার হাত দেখেছিলেন, তার পর থেকে ও বাসার সবাই সবুজ ভাইকে বাঁকা চোখে দেখতো। আমি মেডিকেলের ছাত্রী, ততদিনে নিজের মতো করে সব বুঝতে চেষ্টা করি। একটা সময় আমি উপলব্ধি করি, করিম ভাই আমাকে কিছুটা এড়িয়ে চলেন, মাসুম ভাই একাই আমার খোঁজ-খবর করছেন; আর আমি আমার ভেতর থেকে খুঁজছি সবুজ ভাইকে। যতবার জীবনে অনভিপ্রেত কিছু ঘটেছে, ততবার সবকিছু সহজভাবে নিয়ে সহজেই ভুলে গেছি। বিস্মৃত হবার এ কৌশল কোথা থেকে রপ্ত করেছিলাম, তা জানি না, হয়তো স্বভাবগতভাবেই রয়ে গেছে বিষয়টি আমার মধ্যে। কষ্ট বুকে ধরে রেখে আমি কোনদিন যন্ত্রণা পুষতে চাইনি। কষ্টকে লালন করতেও পারি না। জীবনের বাঁকে বাঁকে যত আনন্দ-বেদনার স্মৃতি সব পলকে মুছে ফেলতে পেরছি; কিশোরকাল থেকে প্রতিদিনের পথচলায় কতো যে ইশারা, কত যে পরোক্ষ প্রলোভন, কত অশুভ বাতাস নাড়িয়ে দিতে চেয়েছে অবুঝ এ পারমিতার মন, অগ্রাহ্য করেছি সব; কিন্তু সবুজকে কেনো যেনো ভুলতে পারছিলাম না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App