×

সাময়িকী

জল ঝর্নায় একজন থেলারাও

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০২০, ০৭:৪৫ পিএম

জল ঝর্নায় একজন থেলারাও
গত মাসের ২০ তারিখ খুউব তাড়াহুড়ো করেই ঢাকা থেকে ফেরা। রাস্তায় গাড়ি নেই। ঘণ্টা দুয়েক অপেক্ষা করে খুলনার বাস পেতে হলো। মাওয়া ঘাটে এসে আরেক বিপত্তি ফেরি বা লঞ্চ চলছে না। বসে থাকা সারা রাত। পর দিন সকালে ফিরতে ফিরতে সকাল ১১টা। এসে তুলির সাথে দেখা হলো না। অফিসে চলে গেছে। ওর দুশ্চিন্তা, ফোনে অস্থিরতার কারণেই এতো ঝুঁকি নিয়ে চলে আসা। আজ বুঝতে পারি ওর অনুমান আমার নিশ্চয়তার থেকে অধিক নিশ্চিত। তুলির অফিসও ২৫ মার্চ ছুটি হয়ে গেলো। প্রায় একমাস হয়ে গেলো আমরা এক রকম বন্দি। আমরা কেন সারা বিশ্বই এখন বন্দিী অদৃৃশ্য এক ভাইরাস যার নাম করোনা তার সাথেই মূলত এখন মানুষের যুদ্ধ। আর থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় সামাজিক দূরত্ব। মানুষ বের হচ্ছে না। গাড়ি চলছে না। কলকারখানা বন্ধ। প্রকৃতি নতুনরূপে ঢেলে নিজেকে সাজাচ্ছে। প্রতিদিন বাসায় খানিকটা একই রুটিন। তুলির নির্দেশে ভোরে ঘুম থেকে ওঠা, ত্রিফলের পাচন খাওয়া, ব্যায়াম করা, ঘড়ি ধরে নাশতার টেবিলে যাওয়া। এমনকি দুপুরে সিনেমা দেখা তাও ঘড়ি ধরে। কেমন এক কারাগারের বন্দিদশা। আমি আর আমার মেয়ে দুজনে মিলে এই কারাগারের নাম দিয়েছি ‘তুলির কারাগার’। সে খুবই কঠিন নারী। সপ্তাহে একদিন বাজারে পাঠাবে। বাজার থেকে এলে পারলে সে সোডা, গরম পানি দিয়ে আমাকে কাপড় কাচা কাচে। বারবার হাত ধোয়া তো আছেই। খাবারে কোনো তেল মসল্লা নেই। সবজি, ফল আর ভিটামিন সি খাও। আর কোনো আলসেমি তার ধাতে সয় না। সেই তুলি আজ সকালে বিছানা ছাড়েনি। নিয়মিত ব্যায়াম তো দূরের কথা কাউকে সকালে ঘুম থেকে ডাকেনি। মেয়েটি আজ সুখে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। ছোট শালি লকডাউন থেকে এখানে। সে প্রায় নটায় উঠে দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকছে যখন আমার হুঁশ হলো। তুলিকে ডাকতেই দেখলাম তুলি শক্ত হয়ে আছে। কি ব্যাপার! ওর কাছে গিয়ে ডাকলেই মনে হলো ও জেগে আছে। আর রাগে শক্ত হয়ে আছে। আমার হাত সরিয়ে দিলো বুঝতে পারলাম না। কি হলো? তবে এটা বুঝলাম মেঘ ভালো মতো জমেছে। বৃষ্টি হতে হবে, না হয় বাতাস। সে উঠলো না। সকালের নাশতা বানানো হয়নি অগত্যা শুকনো খাবার আর চা দিয়ে সেরে নিয়ে টেবিলে আলোচনায় বসা গেলো। কি করা যায়? ঠিক হলো মেয়ে দিবা মাকে ওঠাবে। মায়ের সাথে কথা বলে জানবে কি হলো? দিবা ঘরে ঢুকেছে। দরজা বন্ধ। রুদ্ধ দ্বারে কি ঘটছে কে জানে? দিবা দেখতে আমার মায়ের মতো হয়েছে। তাই ওকে মা বলেই ডাকি। সেই সুবাদে সে মাঝে মাঝে আমাকে নাম ধরে ডেকে শাসন করে। আজ সে মায়ের ভ‚মিকায় অবতীর্ণ হয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলো -জাফর, ‘থেলারাও তং চংগা কে’? প্রথমে আচমকা চমকে গেলাম। স্মৃতি হাতড়ে এই নাম আমি খুঁজে পেলাম না। আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম - কে? আর তখনই তুলি ফোঁস করে উঠলো। - এখন তো বলবেই কে? ন্যাকা! কিছু জানে না। কাল মধ্যরাতে ওই মেয়ে ফেসবুকে এসএমএস করেছে। ‘মনে পড়ে জাফর সেই জল, ঝর্নার, মেঘ বৃষ্টিতে আমাদের জলকেলি?’ সে এখন লেফটেন্যান্ট। করোনা ইউনিটে খুলনা জোনের দায়িত্বে আছে। মামুন তাদের দুজনেরই বন্ধু তার কাছ থেকে ফেসবুক আইডি নিয়েছে। নিজের ফোন নম্বরও দিয়েছে; দেখো.. মেয়েদের দেখিয়ে এক প্রকার কান্না গলায় বলে গেলো একনাগাড়ে। জরুরি যোগাযোগ করতেও বলেছে। এসব কি আমি কিছু বুঝি না। আমাকে কোনোদিন এর কথা বলেনি, তার নাকি তেমন কোনো অতীতই ছিল না। আমার কাছে লুকানো!!! বলেই আবার ফুঁপিয়ে উঠলো। তুলি আমার ব্যাপারে এমন করে যে আমি অবাক হই, এতো শক্ত একজন মানুষ এই ব্যপারে শিশুর মতো আচরণ করে। মনে পড়লো কাল রাতে নিউজ দেখে ফেসবুক স্ক্রল করে ল্যাপটপ খোলা রেখেই ঘুমিয়েছি। তুলি অফ করতে গিয়ে ভেসে ওঠা এসএমএস দেখেছে। আমি হেসে উঠলাম। তুলির কাছে গিয়ে বসলাম। বললাম -আমি তো ম্যাসেজটা এখনও দেখিনি। কই ল্যাপটপ, দেখি তো! -তুলি আবার ফোঁস করে উঠলো। কেয়া আমাকে ভর্ৎসনা করে উঠলো। -দুলাভাই, কি হচ্ছে এসব? আপনি বলেন এই মহিলা কে? তার প্রোফাইলে ঢুকেছে অলরেডি কেয়া। আর্মির পোশাক পরা একটি শুভ্র মুখ। থ্যাবড়ানো নাক, খানিকটা জাপানিজদের মতো। ছোট ছোট চোখ চাইনিজদের মতো। বাঙালির মেয়ের মতো মাথায় একহারা চুল। অবাক হয়ে ছবিটির দিকে তাকালাম। ভেসে উঠলো চোখের সামনে সব। মনে পড়ে গেলো একটি অসম্ভব সুন্দর দিন। বলতে শুরু করলাম ওদের, যেন ওখানে নেই আমি। ফিরে গেছি ২০০৫-এর মাঝামাঝি সময়। -সম্ভবত কুরবানি ঈদের পরে। গরম তখনও আছে। ঈদের ছুটিতে ঢাকা থেকে বাড়িতে আসছি। ঈদের দুদিন পরে হঠাৎ মামুনের ফোন। - দোস্ত তুই কই? মামুন জানতে চাইলো - শ্রীনগর বাড়িতে। তুই কই? -আর কইস না। আমি, মিল্টন ভাই, আর ভার্সিটির কতগুলান জুনিয়রা মিলে কক্সবাজার আসছিলাম। মিল্টন ভাই তার খাইসটা ব্যবহার এখানেও জাহির করলো। আর জুনিয়ররা খেইপ্যা হাঁটা দিলো। চারদিনের ট্যুর এখন দুদিনের মাথায় যার যার বাড়ি তার তার ফেরত যাওয়া লাগলো। তাও আবার মদ খাওয়া নিয়া ঝগড়া। কেমন লাগে বল? -কি করবি? সবাই যাচ্ছে যখন, তুইও বাড়ি যা। -না দোস্ত তুই চইলা আয়। আমি কক্সবাজার থেকে বান্দরবান যাইতে চাই। আমি ওতো ভালো কিছু চিনি না। তুই সব চিনিস। তুই থাকলে সেই রকম একটা ট্যুর হবে। -নারে! আমার হাতে টাকা নাই। যা ছিল ঈদে খরচ হয়ে গেছে। -তুই ওটা নিয়ে ভাবিস না। তুই শান্তিনগরে কালাম ভাইয়ের স্টুডিও চিনিস না, ওইখানে যাইয়া আমার নাম কবি, ওরা তোরে টাকা দিয়া দিবো। আমার হাতও প্রায় খালি; মদ কেনার চান্দা দিয়া। দুইজনের খরচ ওই টাকায় হয়ে যাবে। তুই আয় দোস্ত। আমি তো ট্রাভেলের ব্যাপারে এক পা, এগিয়ে থাকি। মা তখন বেঁচেছিলেন। মাকে বললাম সব খুলে। মা বললো, পুরোপুরি আরেকজনের ওপর নির্ভর করে যাওয়া ঠিক না। মা দুহাজার টাকা দিলেন। আমি ব্যাগ গুছিয়ে ওই সময়ই রওনা হয়ে ঢাকা আসলাম। মামুনের কথামতো কালাম ভাইয়ের স্টুডিও থেকে টাকা নিয়ে সোজা শ্যামলীতে উঠলাম। মামুন অস্থির। কক্সবাজার আর থাকতে চাইছে না। বান্দরবানের রয়েল হোটেলে ফোন করে মামুনকে থাকার ব্যবস্থা করে দিলাম। বান্দরবানের রয়েল হোটেল তখনকার রাজার ছিল। যার সাথে আমার ভালো বন্ধুত্ব ছিল। কথা হলো, আমি সরাসরি ওই হোটেলে গিয়েই উঠবো। যে কথা সেই কাজ। পৌঁছতে প্রায় মধ্য রাত হলো। মামুনকে বললাম কই কই যাবি, বল? মামুন বললো দোস্ত তুই যে রাস্তায় হাঁটবি আমি সেই রাস্তায় হাঁটবো। তখন মনে হলো বান্দরবান আমার প্রায় সব দেখা হলেও বিশেষ কিছু জায়গা যেখানে একা যাওয়া সম্ভব না আবার বড় গ্রুপেও যাওয়া যায় না। নীলাচল, নীলগিরি মাথায় রেখে একটা ছক আঁকলাম মাথায়। এমন সময় মনে পড়লো ওয়াই জংশনের কথা। ওয়াই জংশনে সূর্য উদয় আগে দেখবো। ওয়াই জংশন হলো ওয়াই এর মতো দেখতে একটি পয়েন্ট। শৈল প্রপাতের ঠিক পরেই। এর ডানদিকে নীলাচল, নীলগিরি। আর বামদিকে রোমা উপজেলার। সূর্যোদয় দেখে ঠিক করবো কোথায় যাবো? ঘণ্টা দুই বিশ্রাম নিলাম। ভোরে সূর্য ওঠার আগেই দুজনে বেরিয়ে পড়লাম। ওয়াই জংশনের দিকে। সূর্যোদয় দেখে চিম্বুক পাহাড় ঘুরে ফেরার সময় কোনো গাড়ি নেই। যা আছে তা চান্দের গাড়ি। আমরা তাতে উঠলে অর্থে কুলাবে না। আসার সময় নীলগিরি যাবে এমন এক পরিবারের সাথে আসছি। পথে তারা নামিয়ে দিয়েছিল। তখন প্রায় দুপুর। এগারো বা সাড়ে এগারোটা বাজে। আমাদের যেতে হবে বান্দরবান শহরে। মানে হোটেলে ফিরবো। হিসাব করে দেখলাম ১৫/১৬ কি.মি. হবে। মামুনকে বললাম চল হাঁটি। কারণ ৪/৫ কি.মি. দূরে শৈলপ্রপাত ওখানে নামতে হবে। ওটা একটা দর্শনীয় জায়গা। শৈলপ্রপাত হলো মানুষের আবিষ্কার করা প্রথম ঝর্না যেটা প্রথম মানুষের কাছে আসে। একসময় মানুষ মনে করতো বাংলাদেশে তিনটি ঝর্না। তার মধ্যে একটি শৈলপ্রপাত, একটি রিঝুক ঝর্না, একটি সিলেটের মাধবকুণ্ড। যাহোক মামুন প্রথমে গাঁইগুঁই করলেও হাঁটতে শুরু করলো। হাঁটতে হাঁটতে আমরা শৈলপ্রপাত পর্যন্ত চলে আসছি। ক্লান্ত লাগছে। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি আকাশ কালো হয়ে মেঘ করেছে। মামুন আর আমি একসাথে বলে উঠলাম বৃষ্টি হলে খুব ভালো হয়, বল। বৃষ্টি হলেই ঝর্নার পানি বাড়বে আর দেখতেও সুন্দর লাগবে। বলতে বলতেই ঝুপ করে বৃষ্টি নামলো। মনে হলো আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ছে। কি করি ভিজে তো যাবো! এর মধ্যে দেখি শৈলপ্রপাতের উল্টো পাশে জেলা প্রশাসকের বানানো পর্যটক ছাউনি দেখতে পেলাম, ওখানে দৌড়ে গিয়ে দুজনে দাঁড়ালাম। এমন বৃষ্টি আমি এর আগে এমনভাবে দেখিনি। চারদিক অন্ধকার হয়ে আসা বৃষ্টি। কোনো মানুষ নেই কোথাও। ঝর্নার ওপর বৃষ্টি জল যেন নতুন এক জলনৃৃত্য করছে। সবুজ পাহাড় বৃষ্টির তোড়ে মনে হচ্ছে এখনি লুটিয়ে পড়বে মাটিতে। জনশূন্য নির্জনতায় কেবল জলের শব্দ! চারদিকে সেগুন গাছেরা যেন বৃষ্টি পেয়ে নিজেদের মধ্যে হইচই শুরু করে দিয়েছে। ঝুম বৃষ্টির সময়ও প্রতিটি ফোঁটা আলাদা আলাদা করে চোখে পড়ছে যেন। যেন ঝরঝর করে আকাশ থেকে ঝুড়ি ঝুড়ি মণি-মুক্ত ঝরে পড়ছে। বৃষ্টির পড়ার প্রতিটি শব্দ অনুভ‚ত হচ্ছে আলাদা করে। মনে হবে, ফোঁটাগুলো ঠিক চড়াই-উৎরাই পাহাড়ি জমিনে নয়, নিজের হৃদয়ের গভীরে এসে অজানা এক তাল-লয়ে সুর তুলছে। কিছুক্ষণ মামুনের সাথে ট্যুর প্ল্যান নিয়ে কথা বলে, সিগারেট খেয়েও যেন সময় আর কাটে না। বৃষ্টিও থামে না। আমি উপরের প্যান্ট খুলে থ্রি কোয়ার্টার, আর টিশার্ট পরে নেমে গেলাম বৃষ্টিতে। কিন্তু ঝর্নায় নামার সাহস পেলাম না। উপরের অংশে দাঁড়িয়ে ভিজছি। এমন সময় হঠাৎ দেখি ঝর্নার পাশ দিয়ে একটি চিকন পায়ে হাঁটা পাহাড়ি পথ। ওই পথে একটি মানুষ ছায়া মনে হলো। বৃষ্টিতে ভিজে এদিকেই আসছে। ভালো করে তাকিয়ে দেখি একটি উনিশ বিশ বছরের একটি মেয়ে। মেয়েটি জিন্সের প্যান্ট পরা, লং ফতুয়ার মতো শার্ট, মাথায় ক্যাপ, পিঠে একটি বড় পাহাড়ি ঝুড়ি। কিছুটা থাই, চাইনিজ সিনেমার নায়িকাদের মতো দেখতে। আমি এতো বিস্মিত হলাম! যে মামুনকে বলতে ভুলে গেলাম। আমার পাশ দিয়ে মেয়েটি আরও এগিয়ে গেলো সামনের দিকে। শৈলপ্রপাতের ওপারে যাওয়ার জন্য একটা ব্রিজ আছে, তার কাছেই একটি খুমের মতো ক‚প। ঝর্নার পানি পড়তে পড়তে ওখানে গভীর ক‚পের মতো হয়েছে কিছুটা। যেখানে পাশের গ্রামের পাহাড়িরা ও ট্যুরিস্টরা সাধারণত গোসল করে। মেয়েটি পিঠ থেকে ঝুড়ি নামিয়ে রেখে দ্রæততার সাথে পানিতে নেমে গেলো। ওখানে যে আমি একজন পুরুষ দাঁড়িয়ে ভিজছি, মামুন বসে বসে সিগারেট ফুঁকছে ওর কোনো ভ্রæক্ষেপ নেই। আমি আরও অবাক হলাম যখন ডুব দিয়ে এসে ওর ঝুড়ি থেকে বিশাল সাইজের একটি হেড এন্ড শোল্ডার, কন্ডিশনার ও সোপ জেল বের করে মাখতে শুরু করেছে। যার গায়ে লেভেল ইউকের! কি আর্শ্চয কাণ্ড। তার পায়ের যে কেডস ছিল তা ওই সময়ে আমরা সমতলের লোকজনও কম দেখতে পাই। আমি বিস্মিত চোখ আর পা নিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেলাম, কেমন যেন মনে সাহস হলো এই খুমে নামার। মেয়েটা তখনও বেশ স্বাভাবিক। ওর স্বাভাবিকতা আমাদের সমতলদের জন্য অবাক করারই ব্যাপার। কারণ ওর সাহস। এমন সাহস আমাদের মেয়েদের হয়তো নেই। আমার নামা দেখে মামুনও এগিয়ে এসে আমার সাথেই নেমে পড়লো। আমরা কেউ কারও সাথে কথা বলছি না। মামুন মাঝে মাঝে আমার গায়ে পানি ছিটাচ্ছে। কিন্তু আমার খুউব মেয়েটার সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু শুরু করবো কীভাবে? আমি ওর রাখা শ্যাম্পু থেকে না বলেই খানিকটা শ্যাম্পু হাতে নিয়ে বলতে শুরু করলাম -আমি আপনার শ্যাম্পু থেকে না বলেই শ্যাম্পু নিলাম। ঝর্নার মতো রিনিক ঝিনিক একটা হাসি দিয়ে সাবলীল বাংলায় বলে উঠলো -এইতো বলেই নিলেন। অন্যগুলো এগিয়ে দিয়ে বললো এসবও নিতে পারেন। -মামুন এগিয়ে এসে নিলো। -আমি জানতে চাইলাম, এখানে কিভাবে? এতো বৃষ্টিতে কোথা থেকে -তখন সে তার ঝুড়ির কাছে গিয়ে দেখালো তার সঞ্চয়, এই পাহাড়ের পেছনেই তাদের জুম ক্ষেত। ওখান থেকে তোলা ছোট পাহাড়ি বেগুন, টমেটো। নানারকম পাহাড়ি শাক, কচু। সে এসব তুলে বাড়ি ফেরার পথে এখানেই গোসল করে যায়। -আমাদেরও পাল্টা প্রশ্ন করলো। -উত্তর দিলাম। -মামুনও কথার মাঝখানে ঢুকে মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করলো। -আমি জানতে চাইলাম জুম ক্ষেতে কি শুধু বেগুন ও টমেটো হয়? -বললো না তা হবে কেন, তবে ‘জুমের সময় ঝুম বৃষ্টি’ বলে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে। কারণ, বৃষ্টির সঙ্গে পাহাড়িদের রয়েছে আত্মিক যোগ। মার্চ-এপ্রিলের দিকে জুম চাষের জন্য পাহাড় প্রস্তুত করা হয়। চাষের জায়গার আগাছা ও লতাপাতা কেটে পুড়িয়ে ফেলেন পাহাড়িরা। এরপর বীজতলা তৈরি। শীতের পরপর পাহাড় এমনিই একটু রুক্ষ হয়ে ওঠে, সবুজাভ ভাবটা কমে যায়। মে-জুনের দিকে বৃষ্টি ঢোকার ১০-১৫ দিনের মধ্যেই বদলে যায় পাহাড়ের রূপ। গাছ, লতাপাতা জেগে ওঠে সতেজ-সবুজ রঙে। ঝুমবৃষ্টির স্পর্শ পেয়ে বীজের জঠর থেকে ধীরে ধীরে আকাশপানে চায় জুম ধানের চারা। এরপর অপেক্ষা বৃষ্টি আর মেঘের। তারপর সেই ধানেই মূলত চলে সারা বছরের আহার। -এতো ভালো বাংলা কি শিখলো জানতে চাইলে। বললো সে আসলে বান্দরবান ডিগ্রি কলেজে পড়ে। ওখানেই মহিলা হোস্টেলে থাকে। পার্বন উপলক্ষে এসেছে। ওদের পরপর দুটি পার্বন আছে। কিছুদিন বাড়িতেই থাকবে। ওরা জাতিতে বৌদ্ধ। বৌদ্ধদের একটি ধর্মীয় পার্বন কঠিন চীবর দান। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সুতা বোনা থেকে কাপড় তৈরি করে নেই কাপড় ভিখুদের দান করতে হবে এই পার্বনে। এরপর মাস দুয়েক পর হবে অন্নপূর্ণা পার্বন। এই পার্বনে ওদের রাজাদের ওরা খাজনা দেয়। তবে ওতোদিন থাকবে না। ক্লাস শুরু হয়ে যাবে। কথায় কথায় আফসোস করলো ওদের এখানে বৌদ্ধ মানে ওদের আদি ধর্মের লোকেরা ধর্ম স্থানান্তর করছে। তারা খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হচ্ছে। উইএনডিপির মাধ্যমে শিক্ষা ও চিকিৎসা নিশ্চিত হচ্ছে। এছাড়া জাপান ও ইউরোপে যাওয়ার সুবর্ণ সুযোগ হচ্ছে নানার ইউরোপিয়ান এনজিওর মাধ্যমে। এসবের ফলাফল পাহাড়ি নিজস্ব সংস্কৃতির জায়গায় অন্য সংস্কৃতি পাহাড়ে ঢুকে পড়ছে। এসব গল্পে উঠে আসলো ওর এসব বিদেশি প্রসাধনীর কথাও। ওর এক মামা আর্মিতে আছেন। যে ওকে বড় হয়ে অনেক বড় আর্মি অফিসার হবার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। সেই মামা মিশনে গেলে ওর জন্য এসব এনে দেন। ওর একটিই লক্ষ্য, অনেক বড় আর্মি অফিসার হবে। মেয়েটি গল্প করতে করতে বলে উঠলো আমি আজ যাই। কিন্তু বৃষ্টি তখনও থামেনি। হঠাৎ আমার মনে হলো আরে মেয়েটির নামই জানা হলো না। আমি আমার নাম বলে ওর নাম জানতেই ও বললো থেলারাও। কিন্তু বুঝলাম না ভালো করে! মামুন হেসে বললো ‘ঠেলাদাও’! মেয়েটি সাবলীল হেসে ইংরেজিতে বানান করে বললো ‘ঞঐঊখঅজঅঙঙ’ তং চংগা। তখন বুঝলাম থেলারাও। মামুন আবার হাসলো। ও হেসেই বললো তং চংগা এটা উপাধি। থেলারাও উঠে যেতে গিয়েও ফিরে বললো, -এই পাহাড়ি পথটা শেষ করে পেছনের পাহাড়ের ঢালে আমাদের পাড়া। যাবেন। যোগাযোগ ‘ বলেই থামলো—- এতো বৃষ্টিতে নম্বর দেই কী করে, কাগজ কলমও তো নেই! বলেই হঠাৎ ঝুড়ি হাত থেকে নামিয়ে রেখে খুমির পানিতে ডুব দিলো। মামুন আমার দিকে আমি মামুনের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছি তখন। ত্রিশ সেকেন্ড ডুবে উঠে সে হাতে একটি পরিষ্কার কালো পাথর তুলে আনলো। উঠে তার ঝুড়িতে নানরকম চাকু ভেতর থেকে একটি চাকু বের করলো। মামুন চাকুগুলো দেখে ভয়ে আমার হাত চেপে ধরলো। আমিও বুঝতে পারছি না। কি হবে এরপর? ভয়, বিস্ময়ে আমার ভাষা হারিয়েছে ততক্ষণে। মেয়েটি বেছে বেছে ছোট চাকুটি নিলো। তারপর কালো পাথরের ওপর চাকু দিয়ে তার টেলিটক নম্বরটি খোদাই করে লিখলো। লিখে বাড়িয়ে ধরতেই মামুন প্রায় ছোঁ দিয়েই পাথরটি নিলো। ততক্ষণে আমার ঘোর কাটতেই দেখলাম সে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, -আমি পাহাড়ে নেটওয়ার্ক পাই না। তবে হোস্টেলে থেকে ফোন ব্যবহার করি। মামা ফোন কিনে দিয়েছেন। আপনার নম্বর বলুন। আমি নম্বরটি বললাম। সে লিখলো না। দ্রæত ঝুড়িটি পিঠে করে ভেজা শরীরে ধীরে ধীরে আমাদের চোখের আড়াল হলো। আমি উঠে এসে আর ছায়া দেখা পর্যন্ত তাকিয়ে রইলাম। মামুনের ডাকে সম্বিত ফিরে পেতে দেখি বৃষ্টিও ধরে এসেছে। ছাউনিতে মামুন ফিরে ডাকছে। ভেজা কাপড় পলিথিনে ঢুকিয়ে শুকনো কাপড় পরে আবার আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। এরপর বান্দারবানে আরও সাতদিন থাকলেও ওই পাহাড়ের ঢালে যাওয়া হয়নি। ঢাকায় ফিরেও এলাম। ওই ক’দিন ঘোরের মধ্যে থাকলেও, মিলিয়ে যাওয়া ছায়া আর জলের মায়া মনে পড়লেও সমতলে ফিরে অন্য মানুষ হয়ে গেলাম। ফোন নম্বরের পাথরটিও মামুনের কাছেই। এরপর প্রায় মাস খানেক পরে আমার ফোনে একটি টেলিটক নম্বরের ফোন, আমি জাফর কিনা জানতে চাইলো। নিজের পরিচয় দিলো। বিস্ময়ে আমার ফোন হাত থেকে পরে যাবার জোগাড়। ওদিনের পর থেলারওয়ের বেশ জ্বর এসেছিল তারপর পার্বন সব মিলিয়ে হোস্টেলে ফিরতে দেরি হওয়ায় ফোন করতে পারেনি। আমার নম্বরটি মুখস্থই ছিল। বাড়ি ফিরে লিখে রেখেছিল কাগজে। আমরা ঠিকঠাক পৌঁছেছি কিনা, এবং অন্নপূর্ণা অনুষ্ঠানে যাবো কিনা এসব কথা। আমি ফোন রেখে মামুনকে জানালাম। -মামুন চিৎকার করে উঠলো, কি কস দোস্ত? আমি কয়েকবার ট্রাই করছি। পাই নাই নম্বরে। ও বললো আজই ফোন করবে। মেয়েটারে ভালো লাগছে। আমার সাথে আর দুবার পরে কথা হয়েছিল। শুনেছিলাম মামুন ওর প্রেমে পড়েছে। মামুন কয়েকবার ফোনও করেছে। পরে মামুনের সাথে প্রেম হয়েছিল কিনা তা জানি না। তার কিছুদিন পরে মামুন ব্যারিস্টারি পড়তে চলে যায় ইংল্যান্ডে। আমিও ব্যস্ত হয়ে পড়ি জীবনে। তুলির দেখাও পেয়ে গেলাম তার কয়েকদিনের পরেই। থেলারাও জলের মতো হারিয়ে গেলো। মামুনের সাথে প্রথম কথা হলেও আর কথা হয়নি। ও ইংল্যান্ডে বিয়ে করে সেটল। ফেসবুক আসার পর ফেসবুকে কালে-ভদ্রে যোগাযোগ হতো। তারপর তো আজকের সকাল। তুলি, কেয়া, দিবা অবাক হয়ে শুনছিল আমার কথা! আর আমি দেখছিলাম জল, ঝর্নায়, পাহাড়ের সবুজে হারিয়ে যাওয়া একজন থেলারাওকে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App