×

বিশেষ সংখ্যা

হার না মানার এক বিস্ময়কর উপাখ্যান

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২০, ১১:৩৫ পিএম

হার না মানার এক বিস্ময়কর উপাখ্যান
রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন “আমাদের দেশে সকলের চেয়ে দরকার হাতে ভিক্ষা তুলিয়া দেওয়া নয়, মনে ভরসা দেওয়া।” (রবীন্দ্রনাথ, ‘সমবায় ১’, সমবায় নীতি)। বঙ্গবন্ধুও আমাদের এমন করে আত্মনির্ভরতার ভরসার বাণী শুনিয়েছেন বারে বারে। অজেয় প্রাণশক্তির কথা বলতেন। লড়াকু এক মন উপহার দিয়ে গেছেন তিনি বাঙালি জাতিকে আর তাই শত বাধা ডিঙিয়ে এগুচ্ছে দেশ। বঙ্গবন্ধু কন্যার বিচক্ষণ নেতৃত্বে আমরা এমন ভয়াবহ সংকট বেশ ভালোভাবেই সামলে নিতে পেরেছি। চ্যালেঞ্জিং সময়কে প্রতিরোধ করেই বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রা অব্যাহত রেখেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। মানুষের জীবন ও জীবিকা সচল রাখতে তিনি রাতদিন পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই বছরে বাংলাদেশের দারিদ্র্য নিরসন, প্রবৃদ্ধির অর্জন এবং স্বাস্থ্য-শিক্ষাসহ সামাজিক সূচকে বিশ^সেরার মর্যাদা অর্জনের গল্প বিশ্ববাসীকে আমাদের শোনানোর কথা ছিল। করোনার কারণে সেভাবে তা করা যাচ্ছে না। তবুও সামষ্টিক উন্নয়নে যে অগ্রগতি আমরা বিগত যুগ ধরে অর্জন করছি তাও কিন্তু কম নয়। মনে রাখতে হবে মুক্তিযুদ্ধের সময় যে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী তার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছেন। জনমানুষের প্রতিভা ও পরিশ্রমকে কাজে লাগিয়ে সৃষ্টিশীল অগ্রযাত্রার মহানায়ক ছিলেন বঙ্গবন্ধু। সাধারণ মানুষের কল্যাণে ব্রতী বঙ্গবন্ধু তাঁর উন্নয়ন কৌশল বিদেশ থেকে ধার করে আনেননি। তিনি তাই এমন এক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা চালু করার অঙ্গীকার করেছিলেন যাতে ‘কৃষক, শ্রমিক ও জ্ঞানী মানুষের’ আধিপত্য থাকবে। তিনি বিশ্বাস করতেন জনগণের ঐক্যবদ্ধ ও সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আমরা উন্নততর ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে সক্ষম হবো। এই বিশ্বাস, বিচক্ষণতা ও প্রান্তিক মানুষের প্রতি দরদ থেকেই বঙ্গবন্ধু তাঁর তৈরি সংবিধান ও প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় এমন সব কৌশলের কথা বলেছেন যে সব বাস্তবায়ন করে আজ বাংলাদেশ এই সংকটকালেও মানবিক উন্নয়নের এক মডেলে পরিণত হয়েছে। তাঁর কাক্সিক্ষত এই উন্নয়ন অভিযাত্রাকে যে মুন্সিয়ানার সাথে বঙ্গবন্ধু কন্যা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তা সত্যি দেখার মতো। সুবর্ণজয়ন্তীর বছরে আমরা বঙ্গবন্ধুর চিন্তার আলোকে বঙ্গবন্ধু কন্যার হাত ধরে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের গর্বিত এক ভঙ্গি বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার স্বপ্ন দেখছি। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, গত পাঁচ দশকে আমাদের উন্নয়ন অভিযাত্রা নানা বিচারেই বিস্ময়কর। অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে আমাদের উন্নয়নের কৌশল একই সঙ্গে প্রবৃদ্ধি সহায়ক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক। তাই সমাজের পিরামিডের পাটাতনে থাকা মানুষগুলোও এই উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত হননি। অর্থনৈতিক বৈষম্য আরেকটু কমাতে পারলে নিশ্চয় আরও বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে উন্নয়নের সুযোগ-সুবিধে পৌঁছে দেয়া সম্ভব হতো। তা সত্তে¡ও বলা যায়, অন্য অনেক দেশের চেয়ে আমাদের উন্নয়ন ছিল অনেকটাই অংশগ্রহণমূলক। আয়ের বৈষম্য খানিকটা বাড়লেও মানুষের ভোগের বৈষম্যের সূচক অনেকটাই স্থিতিশীল থেকে গেছে। বিশেষ করে সরকারের নীতিমালা যেমন অন্তর্ভুক্তিমূলক ছিল, আমাদের সরকারের বাইরের ব্যক্তি ও সামাজিক উদ্যোক্তাদের অবদানও কম ছিল না। সবাই মিলেই আমরা এই সর্বজনের কল্যাণে নিবেদিত আর্থ-সামাজিক রূপান্তরের পাটাতনটি শক্তভাবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছি। এমডিজি ও এসডিজি বাস্তবায়নে ফলাফল নির্ভর যে কৌশল আমরা গ্রহণ করেছি তার সুফল পেয়েছি। এখনও পাচ্ছি নেতৃত্বের বিচক্ষণতায়। এই মহামারি ছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা আমাদের সামলাতে হচ্ছে। এক্ষেত্রেও ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ। আগামী বছর স্কটল্যান্ডে কপ-২৬ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আশা করা যায় জলবায়ু বিষয়ক এই বিশ্ব সম্মেলনেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশসমূহের ন্যায্য দাবি বলিষ্ঠভাবেই তুলে ধরবেন। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বের পরিবর্তন একটি শুভ পরিবেশ তৈরি করতে সাহায্য করবে। যুক্তরাজ্যের সাথে একযোগে কাজ করে বাংলাদেশ সুবর্ণজয়ন্তীর এই বছরে সবুজ বিশ্ব গড়ার অঙ্গীকারকে সামনে আনতে পারবে বলে আমাদের প্রত্যাশা। গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলমান আমাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়নের অভিযাত্রার সুফল আরও ভালোভাবে ধরা পড়বে কিছু দিন পর। তবে এর মধ্যেই আমাদের সাফল্যের সবুজ চারাগুলো দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। তবে আমাদের এই সাফল্যের সবচেয়ে বড় দৃশ্য ধরা পড়বে গ্রামবাংলার বিস্ময়কর রূপান্তরের দিকে তাকালে। আজকাল গ্রাম আর শহরের জীবনযাত্রা ও সুযোগ-সুবিধের তফাৎ খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। বিশেষ করে আমাদের অর্থনীতির মূল রক্ষাকবচ কৃষির উন্নতি সত্যি অসাধারণ। হেক্টরে এক টন ফসল উৎপাদন করতে পারতাম স্বাধীনতার ঊষালগ্নে। এখন আমরা উৎপাদন করি চার টনেরও ওপরে। আর কৃষিতে যে বহুমুখীকরণের জোয়ার লেগেছে তা তো বলাই বাহুল্য। সবজি, মাছ, পোল্ট্রি ও লাইভস্টক উৎপাদনে বাংলাদেশের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। আর কৃষি ভালো করছে বলে ভোগ বাড়ছে। বাড়ছে মানুষের আয়-রোজগার। তাই চাহিদাও বাড়ছে। ফলে শিল্পেরও প্রসার ঘটেছে। গ্রামীণ অর্থনীতির এই চাঙ্গাভাবের কারণে এই করোনাকালেও আমাদের প্রবৃদ্ধির হার পৃথিবীর ষষ্ঠতম সেরা বলে স্বীকৃতি পেয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় প্রবৃদ্ধির দৌড়ে আমরাই প্রথম। আমাদের এই স্বপ্নীল যাত্রার শুরুটা বঙ্গবন্ধুকে দিয়েই। তিনি ‘সোনার বাংলার’ স্বপ্ন দেখা শুরু করেন সেই ছাত্রজীবন থেকেই। পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষের সময় মানুষের বুভুক্ষা ও দুর্দশা দেখে তিনি দারুণ বিপর্যস্ত ছিলেন। ঔপনিবেশিক হস্তক্ষেপে কি করে সমৃদ্ধ বাংলায় এমন একটি দুর্ভিক্ষ হতে পারলো সে সব কথা তিনি তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লিখেছেন। একই সঙ্গে তিনি স্বপ্ন দেখেছেন সমৃদ্ধ স্বদেশ গড়ার। এর প্রমাণ মেলে মাত্র ৩২ বছর বয়সে তাঁর চীন সফরের অভিজ্ঞতা নির্ভর ‘আমার দেখা নয়াচীন’ বইতে। কি করে চীনের সরকার ও মানুষ কৃষি, শিল্প ও শিক্ষায় সংস্কার এনে এমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছেন তার সূত্র খুঁজেছেন। মনে হয় তিনি তৈরি করছিলেন নিজেকে। তাই স্বাধীন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েই তিনি কৃষি, শিল্প ও শিক্ষার ওপর সমান গুরুত্ব দিয়ে তাঁর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গড়তে নেমে পড়েন। ভালোই চলছিল সেই উন্নয়ন অভিযাত্রা। মাত্র আট বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি নিয়ে তাঁর যাত্রা শুরু। ১৯৭২-এ মাথাপিছু আয় ছিল ৯৩ ডলার। ১৯৭৪-এ তা ২৭৩ ডলারে উন্নীত করেছিলেন। পঁচাত্তরে শারীরিকভাবে তাঁকে স্বদেশবাসীর কাছে থেকে বিচ্ছিন্ন না করে ফেলা হলে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা কোথায় গিয়ে পৌঁছতে পারতো তা শুধু আমরা অনুমানই করতে পারি। তারপর বহু সংগ্রাম ও বহু ত্যাগের বিনিময়ে স্বদেশ ফিরতে পেরেছে সঠিক পথে, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যার হাত ধরে। বাংলাদেশ এখন এগিয়ে চলেছে জোর কদমে, আবাক বিস্ময়ে এই অগ্রযাত্রা দেখছে সারা বিশ্ব। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর সেই ২০০৯ সাল থেকেই প্রতি বছর কৃষিতে অন্তত ৯ হাজার কোটি টাকার ভর্ভুকি দেয়ার পাশাপাশি কৃষি যন্ত্র ক্রয়, বীজ ক্রয়, প্রযুক্তিনির্ভর সহায়তা সম্প্রসারণ এবং কৃষি উন্নয়নে ব্যক্তি খাতকে যুক্ত করতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন বলেই করোনা মহামারি ও বন্যার প্রকোপের পরও কৃষির রয়েছে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে রক্ষাকবচ হওয়ার সম্ভাবনা। এই দুর্দিনেও কৃষক খুশি। কেননা আমন ধানের ভালো ফলন পাচ্ছেন তারা। কৃষি শ্রমিকরাও খুশি। কেননা তারাও ভালো হারে মজুরি পাচ্ছেন। গ্রামীণ মানুষের আয়-রোজগার ভালো। এর সাথে যোগ হচ্ছে বাড়তি প্রবাস আয়। সরকারের প্রণোদনা দেয়ায় প্রবাসীরা বেশি করে ব্যাংকের হিসেবে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন এখন। গেল মাসেও দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি প্রবাস আয় এসেছে। ফলে গ্রামে ভোগ ও চাহিদা দুই-ই বাড়ন্ত। তাই শিল্প পণ্যের চাহিদাও যথেষ্ট। বাংলাদেশ ব্যাংক এই ডলারের বড় অংশ ব্যাংক থেকে কিনে নেয় বলে অর্থ বাজারে তারল্য ভারসাম্য বজায় রয়েছে। সরকার বেশি করে ব্যাংক ঋণ নিতে পারছে। ব্যাংকগুলো কমসুদে ভালো উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে পারছে। বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ মেগাপ্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখতে সরকার নজর রেখেছে। তাই আমাদের স্বপ্নের মিনার পদ্মাসেতু এখন দৃশ্যমান। এই সেতু এখন আমাদের জাতীয় সক্ষমতার প্রতীক। আমাদের অহঙ্কারের স্মারক। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট চালু রয়েছে। তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবলের কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। ডিজিটাল অবকাঠামো জোরদার হচ্ছে। সবমিলে আস্থার পরিবেশ বজায় রয়েছে। গ্রামীণ কর্মসংস্থান বজায় থাকায় শহরের অনানুষ্ঠানিক বেকার কর্মীদেরও নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিচ্ছে। মহামারিজনিত অর্থনৈতিক মন্দায় বিশ^ব্যাপী ৫.২ শতাংশ অর্থনৈতিক সঙ্কোচনের আশঙ্কার মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি ব্যতিক্রম। গত এক দশকে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ননীতি গ্রহণ ও সেগুলোর বাস্তবায়ন করা গেছে বলেই এমন অর্জন সম্ভব হয়েছে। এই দুর্যোগের বছরেও এডিবি বলছে ৬.৮ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হবে। আশা করা যাচ্ছে এ প্রবৃদ্ধি আরও বেশি হবে। জাতির পিতা যে প্রাণবন্ত আর সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে কাজ শুরু করেছিলেন তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশকে এগিয়ে নিচ্ছেন তাঁর কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি গড়ে তুলতে পেরেছেন শত প্রতিক‚লতা পেরিয়ে সফল হওয়ার সংস্কৃতি। তাই আমরা জাতীয় উন্নয়নের স্বপ্ন পূরণের লড়াইয়ে সাহস পাচ্ছি। আমরা কষ্ট স্বীকার করে তিলে তিলে গড়ে তুলছি আমাদের সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ। আমরা ভয় পাই না। আমরা ধ্বংসস্তূপ থেকে জেগে ওঠা এক বিরল জাতি। বঙ্গবন্ধুর আশীর্বাদপুষ্ট বাঙালি জাতি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App