×

অর্থনীতি

রপ্তানি বাণিজ্যে ফের হোঁচট

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২০, ০৯:১১ এএম

রপ্তানি বাণিজ্যে ফের হোঁচট

ফাইল ছবি।

ইউরোপ-আমেরিকায় করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাতে সব হিসাব পাল্টে গেছে।

অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের প্রচেষ্টায় দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বেশ গতি এসেছে। তৈরি পোশাক রপ্তানি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, রেমিট্যান্সে উন্নতি হয়েছে। তবে বর্তমানে করোনা মহামারি জনমনে ভীতি তৈরি করেছে। তাতে অর্থনীতিতেও বেশ প্রভাব পড়ে। এর মধ্যে দেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান খাত রপ্তানিতে ধস নেমেছে। করোনা ভাইরাস মহামারির শুরুতে গত এপ্রিলে রপ্তানি আয় তলানিতে পৌঁছলেও ধীরে ধীরে তা আবার বাড়ছিল। তবে অক্টোবরে এসে আবার ধাক্কা লাগে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইউরোপ-আমেরিকায় করোনা সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবেই রপ্তানি আয় হোঁচট খেয়েছে। সেকেন্ড ওয়েভ আমাদের সব হিসাব-নিকাশ ওলটপালট করে দিয়েছে।

সর্বশেষ তথ্যমতে, গত বছরের অক্টোবরের চেয়ে রপ্তানি আয় কমেছে ৪ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কমেছে ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। ঘুরে দাঁড়ানো অর্থনীতি করোনার দ্বিতীয় প্রাদুর্ভাবের কারণে আবারো থেমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। সরকারি প্রণোদনা প্যাকেজ নিয়ে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় সম্প্রতি তিনি এ শঙ্কা প্রকাশ করেন। এ সময় করোনার দ্বিতীয় প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় নীতি-নির্ধারণে আরো সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, অক্টোবর মাসে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ২৯৪ কোটি ৭৮ লাখ ডলার আয় করেছে। গত বছরের অক্টোবরে আয় ছিল ৩০৭ কোটি ৩২ লাখ ডলার। আর এবার লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৩১৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, কোভিড-১৯ এর প্রভাব শুরু হওয়ার আগে থেকেই আমাদের রপ্তানি আয়ে খারাপ পরিস্থিতি ছিল। প্রতি মাসেই প্রবৃদ্ধি কমছিল। এ মহামারির সময় প্রবৃদ্ধি থাকাই বড় বিষয়। তথাপি রপ্তানি আয় ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছিল। আমরা মনে করেছি, অর্থনীতিতে করোনার এ ধাক্কা কেটে যাবে। কিন্তু ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে করোনা ভাইরাসের ‘সেকেন্ড ওয়েভ’ শুরু হওয়ায় সেটা আর হচ্ছে না। বর্তমানে আমাদের দেশেও করোনার সংক্রমণের হার বেড়েছে যা আশঙ্কার বিষয়। রপ্তানি আয়ের অধিকাংশই আসে পোশাক খাত থেকে। তাই পোশাক শ্রমিকরা আক্রান্ত হচ্ছে কিনা সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত পোশাক শিল্প মালিকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, আমাদের ধারণা ছিল, বড় দিনকে সামনে রেখে আমরা পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারব। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় তা আর সম্ভব হবে না।

করোনা মহামারিতে গত এপ্রিলে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ৫২ কোটি ডলারে নেমে এসেছিল। পোশাক রপ্তানি থেকে আয় হয়েছিল মাত্র ৩৬ কোটি ডলার। কারখানা খোলার পর মে মাসে রপ্তানি আয় কিছুটা বাড়তে থাকে। জুনে তার পরিমাণ আরো অনেক বেড়ে যায়। এরপর চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসেও সেই ইতিবাচক ধারা অব্যাহত ছিল। জুলাইয়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছিল ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ। জুলাই মাসের ওই আয়ের মধ্যদিয়ে ৭ মাস পর রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধিতে ফিরে আসে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় মাস আগস্টে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৪ দশমিক ৩২ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে প্রবৃদ্ধি হয় ৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি এই ৩ মাসে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি আয় দেশে আসে। কিন্তু চতুর্থ মাস অক্টোবরে এসে ফের ধাক্কা লাগে এ খাতে।

পোশাক খাতে প্রভাব : ইপিবির সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, অক্টোবরে পোশাক খাত থেকে রপ্তানি আয় হয়েছে ২৩২ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। এর আগের মাসে এ আয় ছিল ২৪১ কোটি ৩৪ লাখ ডলার। সে হিসাবে অক্টোবরে পোশাক খাতের আয় কমেছে ৮ কোটি ৯৭ লাখ মার্কিন ডলার। আর গেল বছরের অক্টোবরের তুলনায় এ আয় ১৯ কোটি ৬১ লাখ ডলার কম। গেল বছরের অক্টোবরে দেশের তৈরি পোশাক খাতের আয় ছিল ২৫১ কোটি ৯৮ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসের হিসাবেও নেতিবাচক প্রবৃদ্ধিতে আটকে গেছে দেশের তৈরি পোশাক খাত। এ সময়ে এ খাতের মোট রপ্তানি আয় এসেছে ১০৪৫ কোটি ডলার। অথচ গেল অর্থবছরে একই সময়ে এই খাতের আয় ছিল ১ হাজার ৫৭ কোটি ৭৪ লাখ ডলার।

চামড়া রপ্তানিতে ধস : চামড়া খাতে রপ্তানি আয় ক্রমশ কমছে। গত ৩ অর্থবছর ধরেই এর হার নিম্নমুখী। করোনা মহামারিতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার বিক্রি কমায় এ শিল্পের অবস্থা আরো নাজুক হয়ে পড়েছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত ৪ বছরে এ খাতে রপ্তানি আয় কমেছে প্রায় ৫০ কোটি ডলার। এর মধ্যে করোনার কারণে ৬ মাসে কমেছে ২৮ কোটি ডলার।

২০২১ সালের মধ্যে চামড়া খাত থেকে বছরে ৫০০ কোটি ডলার রপ্তানি আয়ের লক্ষ্য নিয়ে ২০১৭ সালে চামড়াকে ‘প্রডাক্ট অব দ্য ইয়ার’ ঘোষণা করেছিল সরকার। কিন্তু এ ঘোষণার পর থেকে উল্টো এ খাতে রপ্তানি আয় কমছে।

জাহাজ রপ্তানিতে ধস : করোনাকালের ৮ মাসে জাহাজ রপ্তানিতে ধস নেমেছে। এ সময়ে একটি জাহাজও রপ্তানি হয়। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে জাহাজ রপ্তানি থেকে বাংলাদেশ ১ কোটি ১৩ লাখ ২০ হাজার ডলার আয় করেছিল। বিশ^ বাজারে সম্ভাবনা থাকায় চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে ১ কোটি ৮০ লাখ ডলার ধরা হয়। কিন্তু অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে অর্থাৎ জুলাই-অক্টোবর সময়ে কোনো জাহাজ রপ্তানি হয়নি। শুধু তাই নয়, মার্চে মহামারি শুরুর পর ৮ মাসেও কোনো রপ্তানি হয়নি।

দেশের সবচেয়ে বড় জাহাজ নির্মাতা ও রপ্তানিকারক ওয়েস্টার্ন মেরিন শিপইয়ার্ডের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম বলেন, সব শেষ। গত ৮ মাসে কোনো জাহাজ রপ্তানি করতে পারিনি আমরা। বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে নতুন সম্ভাবনার হাতছানি নিয়ে এসেছিল যে জাহাজ নির্মাণশিল্প, কোভিড-১৯ তা একেবারে তছনছ করে দিয়েছে। ইপিবির তথ্যে দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে (জুলাই-অক্টোবর) ৫ হাজার ডলারের জাহাজ রপ্তানি হয়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৭০ দশমিক ৫৯ শতাংশ এবং লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৯৯ দশমিক ১১ শতাংশ কম।

পাট রপ্তানিতে আশার আলো : করোনা সংকটকালে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানির বড় প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। জুলাই-অক্টোবর সময়ে ৪৩ কোটি ৮৮ লাখ ডলারের পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৩৯ দশমিক ৫২ শতাংশ বেশি। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় বেড়েছে ২০ দশমিক ৪৭ শতাংশ। গত ২০১৯-২০ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলার আয় করেছে, যা ছিল আগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের চেয়ে ৮ দশমিক ১০ শতাংশ বেশি।

অন্যান্য পণ্য রপ্তানি : রপ্তানির প্রধান খাতগুলো নেতিবাচক ধারায় থাকলেও করোনা মহামারিকালে ছোট ছোট পণ্য রপ্তানি কিছুটা বেড়েছে। যেমনÑ ওষুধ রপ্তানি বেড়েছে ২০ শতাংশ। কৃষিপণ্য রপ্তানি বেড়েছে দশমিক ৩৭ শতাংশ। হ্যান্ডিক্রাফট রপ্তানি বেড়েছে ৪৮ শতাংশের মতো। হিমায়িত মাছ রপ্তানি বেড়েছে ৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ। স্পেশালাইজড টেক্সটাইল রপ্তানি কমেছে ২ দশমিক ২ শতাংশ।

করোনা ভাইরাস মহামারির এই সময়ে চলতি অর্থবছরে ৪৮ বিলিয়ন (৪ হাজার ৮০০) মার্কিন ডলারের পণ্য ও সেবা রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে সরকার, যা গত অর্থবছরের রপ্তানি আয়ের চেয়ে ১৯ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেশি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App