×

বিশেষ সংখ্যা

যুদ্ধযাত্রা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২০, ১১:২০ পিএম

যুদ্ধযাত্রা
সেদিন ছিল শুক্রবার। অন্যান্য দিনের মতোই প্রভাত পাখির কাকলিতে সূচনা হয় এই দিনের। মুয়াজ্জিনের সুরেলা কণ্ঠের আজান ভোরের বাতাস চিরে ছড়িয়ে পড়ে বহুদূর, ঘোষণা করে নতুন দিনের আগমনবার্তা। সূর্যের হাসিতে কেটে যায় কুয়াশা ঢাকা ভোরের বিষণ্ণতা। নবীগঞ্জ জেগে ওঠে দশ দিগেরের আর দশটা গ্রামের মতোই। জেগে ওঠে আব্দুল জলিল ফারাজি। এই তার অভ্যাস। ফজরের আজান পড়তে না পড়তেই আপনাআপনি ঘুম ভেঙে যায়। কী শীত কী গ্রীষ্মে, তখন তার শয্যাকণ্টকি হয়। চোখ রগড়ে বিছানা ত্যাগ করে। প্রাতঃক্রিয়া শেষে কুয়োতলায় বসে অজু বানায়। পাঁচিলের ওপাশে ছোট চাচা আব্দুল জব্বার ফারাজির গলা খ্যাকারি শোনা যায়। অতপর মসজিদে গিয়ে দেখা হয় ছোট চাচার সঙ্গে। তিনি বসেন ইমাম সাহেবের ঠিক পেছনে। মসজিদে এলে ওইটিই তার নির্ধারিত জায়গা। নড়চড় হবার জো নেই, সবাই তা জানে। কিন্তু সেই শুক্রবার সকলে ফজরের নামাজে আব্দুল জব্বার ফরাজিকে তার নির্দিষ্ট আসনে দেখা যায়নি। কিছুদিন আগেও তার এই আকস্মিক অনুপস্থিতি নিয়ে কেউ বিশেষ একটা চিন্তা বা দুশ্চিন্তা করেনি, এখন করে। মুরব্বি মানুষ, বয়স হয়েছে, প্রতিদিন যথাসময়ে মসজিদে হাজির হতে পারেন না শারীরিক কারণেই সবাই এই রকমই মনে করত। কিন্তু সম্প্রতি দেশের অবস্থা উত্তপ্ত হয়ে ওঠার পর তার জইফ শরীরে কোত্থেকে যেন হারানো তাকত ফিরে আসে, সর্পিল ভঙ্গিমার বাঁকা লাঠিতে ভর দিয়ে মহকুমা শহরে চলে যান, মিটিং মজলিশ সেরে সন্ধ্যার আগে আগে বাড়ি ফিরে আসেন। কোনো কোনোদিন আবার ফেরাও হয় না তার। সেইদিন নবীগঞ্জের সবার দুশ্চিন্তা হয়। ভেতরে ভেতরে দুর্বোধ্য এক আশঙ্কা ছোবলায় আব্দুল জলিলের অন্তরে। ইতোমধ্যে এক জুমার নামাজের পর মসজিদে বসেই আব্দুল জব্বার ফারাজি সদর্পে ঘোষণা করেছেন তিনি শান্তি কমিটির মেম্বার হয়েছেন, থানা এবং মহকুমা কমিটি দুই জায়গাতেই তার নাম আছে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে নাকি সবাইকেই এ রকম দায়িত্ব নিতে হবে। গ্রামের শান্তিশৃঙ্খলার স্বার্থে এই নবীগঞ্জেও শান্তি কমিটি তৈরি করার পরামর্শ দিলে তৎক্ষণাৎ উপস্থিত মুসল্লিরা মিলে তাকেই চেয়ারম্যান করে তেত্রিশ সদস্যের গ্রাম কমিটি গঠন করে ফেলে। জব্বার ফারাজির পরামর্শ মানে যে সেটা আদেশ, এটা তখন সবাই বুঝলেও সে আদেশ মানতে চায়নি তারই ভাইপো আব্দুল জলিল ফারাজি। শান্তি কমিটি গঠনের সোচ্চার বিরোধিতা সে করেনি বটে, কিন্তু ওই কমিটির তেত্রিশ নম্বর সদস্য হিসেবে তার নাম উত্থাপিত হলে সে কোনো সম্মতি না জানিয়ে ঘাড় গোঁজ করে মসজিদের বারান্দা থেকে উঠে চলে এসেছে। চারপাশের সবাই ক্যাটকেটে চোখে চেয়ে চেয়ে দেখেছে সেই চলে যাওয়া। তারপর দু’একজন ঘাড় ঘুরিয়ে জব্বার ফারাজির মুখের দিকে তাকালে সহসা তিনি পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে আনেন। আহা, থাক না জলিলের নামটা বাদই থাক। আমার নাম থাকা মানে তো ওর নামও থাকা। ওর বদলে দক্ষিণপাড়ার বদরুদ্দির নামটা লিখে নাও, একটা মেম্বর বাড়–ক। উপস্থিত মজলিশ তাই মেনে নিয়েছে। বদরুদ্দির অনুপস্থিতিতেই তার নাম তেত্রিশ নম্বরে যুক্ত হয়েছে। মজলিশের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করার মানুষ বদরুদ্দিন নয় এ আস্থা সবার আছে। জব্বার ফারাজি সেদিন মসজিদ থেকে বেরিয়ে তার বাঁকা লাঠিতে ভর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এসে নিজের বাড়িতে না ঢুকে পাশের দরজা দিয়ে ভাইপো আব্দুল জলিল ফারাজির বাড়িতে ঢুকে পড়েন। সামনে পড়ে জমিলা। সে চমকে যায়, দাদা, আপনি! এমন ঘটনা সত্যি বিরল। পাশাপাশি বাড়ি হলেও শরিকানা জমি-জিরেত নিয়ে বিরোধের সূত্রে প্রায় বছর দশেক এ বাড়িতে তার পা পড়েনি। এমনিতে বাইরে থেকে এতটা ফাটল বোঝার উপায় নেই। চাচা ভাইপো দুজনেই সে ফাটল ঢাকার বিষয়ে তৎপর। এতদিন পর ছোট দাদাকে নিজেদের বাড়িতে দেখে জমিলার বিস্মিত হবারই কথা। সে খুশিতে আটখানা হয়ে মাকে ডেকে ওঠে, মা, আ মা... জব্বার ফারাজি বাধা দেন মাকে ডাকতে হবে না, তোর বাপকে ডাক। আপনি ঘরে উঠে বসেন, আমি ডাকছি। চড়–ই পাখির মতো ফুড়ুৎ ফুড়–ৎ নাচতে থাকে জমিলা। নাচবারই বয়স তার। পটলডাঙ্গা হাইস্কুলে ক্লাস টেনে পড়ে। জব্বার ফারাজির নাতনি, তবু এত কাছ থেকে কতদিন যেন দেখা হয়নি তার। ও বাড়িতেও যায় যখন তখন, চোখে পড়েছে বটে, কিন্তু এমন চড়–ই চড়–ই স্বভাবটা যেন নজরে পড়েনি কখনো। মন্ত্রমুগ্ধের মত জমিলার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আব্দুল জব্বার ফারাজির পেছন দিক থেকে এগিয়ে এসে দাঁড়ায় জলিল ফারাজি। তখনো মাথায় টুপি। মসজিদ থেকে বেরিয়েছে অনেকক্ষণ, কিন্তু বাড়ি ফিরছে এতক্ষণে। কোথায় গিয়ে যে দল পাকাচ্ছিল কে জানে! এ বাড়িতে ছোট চাচাকে দেখে সেও খানিক বিস্মিত হয়; তবু নিজেকে সামলে নিয়ে আহ্বান জানায়, এখানে দাঁড়িয়ে কেন? ঘরে এসে বসেন। জমিলা... না, না, ঘরে আর বসবো কী করে! মজলিশের মধ্যে তুমি যেভাবে অপমান করলে তাতে তো পরিচয় রক্ষা করাই কঠিন কাজ। এভাবে উঠে না এলেও পারতে! মসজিদ হচ্ছে ধর্মকর্মের জায়গা, রাজনীতির জায়গা নয়। কিন্তু সে যা-ই হোক, আমি তো আপনাকে অপমান করিনি ছোট চাচা! না অপমান করোনি, জুতো মেরেছো। এ কী বলছেন আপনি! আমার নামে একটা কমিটি হচ্ছে, সেখানে তোমার নামটা থাকলে কী ক্ষতি হতো?’ আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন ছোট চাচা। মসজিদে বসেই সব রাজনৈতিক কমিটি হবে কেন? আর তা ছাড়া কে কোন কমিটিতে থাকবে না থাকবে সেটা তার নিজের ব্যাপার হওয়াই উচিত। তা বটে। ঘরের মধ্যে মুক্তির চ্যালা বসিয়ে রাখলে ওই রকম বুদ্ধিই আসে। তা তুমিও কি মুক্তি হয়ে গেছো? এসব আপনি কী বলছেন ছোট চাচা! শান্তি কমিটির মেম্বার না হলেই মুক্তি হয়ে যায় নাকি? কেন তোমার শালা সাইফুল আসেনি রাইফেল নিয়ে? সে মুক্তি হয়নি? খবর কিছুই চাপা থাকে না আব্দুল জলিল। আব্দুল জলিলের চক্ষু চড়কগাছ। তলে তলে এসব কী অনুসন্ধান করে বেড়াচ্ছে তার ছোট চাচা! এ কোন জাল ছড়িয়ে চলেছে! সপ্তাহখানেক আগে সাইফুল এসেছিল বটে, সে চলেও গেছে গত পরশু। কিন্তু তার কাঁধে আবার রাইফেল দেখল কে! শহরে থেকে সে কলেজে পড়ে। তার পক্ষে মুক্তিযোদ্ধা হওয়া অসম্ভব নয়। কিন্তু ওদের গোটা পরিবারই পাকিস্তানপন্থি, তার মধ্যে সাইফুল একটু বেয়াড়া বটে, মাদ্রাসা থেকে পালিয়ে এসে কলেজে ভর্তি হয়েছে, তাই বলে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে এমন তো কই শোনেনি সে! অথচ সেটাই নজরে পড়ল জব্বার ফারাজির। শোনো আব্দুল জলিল, ছোট চাচা বলেন, আমাদের ফারাজি ফ্যামিলির একটা ইসলামী ঐতিহ্য আছে। আমরা পাকিস্তান ভাঙার আন্দোলনে নামতে পারি না। আমি সেই আন্দোলনে নেমেছি আপনার এ ধারণা হলো কী করে ছোট চাচা? ধারণার কথা নয়, এটা বাস্তবে দেখার বিষয়। তোমার ভালো তোমাকেই দেখতে হবে, সামনে বিপদ-আপদ এলে সেটাও তোমাকেই দেখতে হবে, এটুকু মনে রেখো। এরপর আর আব্দুল জব্বার ফারাজি ভাইপোর বাড়িতে একদণ্ডও দাঁড়াননি। পেছন থেকে জমিলা ডেকে ওঠে দাদা, ভাত খেয়ে যান, কিন্তু তিনি দাঁড়াননি। এমনকি জমিলার চড়–ই চড়ুই চেহারার দিকেও তাকাননি। সোজা এক টানে বেরিয়ে গেছেন। আব্দুল জলিল আপন চাচার এ হুমকি নীরবে হজম করেছে। মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলেনি। তবে ভেতরে ভেতরে দুর্বোধ্য এক আশঙ্কা কাজ করেছে আঘাতটা কোন দিক থেকে আসে তাই দেখার জন্য। সেই সম্ভাব্য আঘাত প্রতিরোধের উপায় খুঁজে খুঁজে হদ্দ হয়েছে, কিনারা ঠাহর করতে পারেনি। প্রায় প্রতি ওয়াক্তে মসজিদে নামাজ পড়তে যায়, পেছনের সারিতে বসলেও ছোট চাচা আব্দুল জব্বার ফারাজির ওপর নজর রাখে। শুক্রবার সকালে ফজরের নামাজে তাকে না দেখে চমকে ওঠে, তবে কি গত রাতে বাড়ি ফেরেনি! না, গতকাল সারাদিনই তাকে দেখা যায়নি মসজিদে। দেখা গেল জুমার নামাজে। আজান পড়ার সাথে সাথে সবার আগে মসজিদে হাজির। জায়নামাজ বিছিয়ে নীরবে ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে আছেন। যেনবা বাহ্যজ্ঞানশূন্য। কিন্তু আধা ঘণ্টাখানেক পরে নামাজ শুরু হলে দেখা গেল তিনি জাগতিক চেতনাতেই আছেন, নামাজের জন্য পালনীয় রীতি কর্তব্যে ঠিকমতোই সাড়া দিয়ে যাচ্ছেন। এভাবেই হয়তো যথাসময়ে নামাজ শেষ হতো, যে যার মতো বাড়ি যেত, সব কিছু যথানিয়মে চলত। কিন্তু সেদিনই প্রথম নবীগঞ্জে মিলিটারি ঢুকল বীরবিক্রমে সেই বেলা দ্বিপ্রহরে। মসজিদে নামাজ তখনো শেষ হয়নি। বাইরে গ্রাম্য রাস্তায় মিলিটারি ট্রাকের গর্জনে নামাজের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। মসজিদের বারান্দা থেকে লাফিয়ে বেশ ক’জন মুসল্লি পালাতে যায়। তখনি গুলির শব্দ ছুটে আসে ঠা ঠা...ঠা ঠা...। আব্দুল জব্বার ফারাজি আকুল কণ্ঠে নছিহত করেন, ‘অই মিয়ারা, খোদার ওপর তোয়াক্কাল রাখো। বালা মুছিবত কেটে যাবে।’ এ পরামর্শ মাঠে মারা যায়। তবু এই নছিহতের ওপর ভরসা করে মুসল্লিরা বসে থাকে না। গ্রামে মিলিটারি আসা মানে যে কী ধরনের বালা মুছিবত, তা অনেকেই ইতোমধ্যে জেনে ফেলেছে আশপাশের গ্রামের অভিজ্ঞতা থেকে। কাজেই নামাজ অসমাপ্ত রেখেই অনেকে পথে নেমে পড়ে। মল্লিকপাড়ায় আগুন জ্বলছে, বাতাস বয়ে আনে সেই হলকা। বাঁশের ঝাড় পুড়ছে ফটফট শব্দে। নারী-পুরুষের আহাজারির শব্দ গুলিবিদ্ধ হচ্ছে মুহুর্মুহু। মসজিদ প্রায় ফাঁকা তখন। জলিল ফারাজি পেছনের সারি থেকে এগিয়ে আসে সামনে, তার ছোট চাচার কাছাকাছি। জব্বার ফারাজির দু’চোখ তখন বিস্ফোরিত প্রায়, যেনবা পাছা ঘেঁষটে দু’হাত পিছিয়েও যান। একেবারে মুখোমুখি এসে আব্দুল জলিল আঙুল উঁচিয়ে ঘোষণা করে, আমার বাড়িঘর, পরিবার-পরিজনের কিছু হলে আমি আপনাকে দেখে নেব ছোট চাচা। এই মসজিদে দাঁড়িয়ে বলছি, আপনাকে আমি ছাড়ব না। তখন অকস্মাৎ জব্বার ফারাজির চোখমুখ ভাবলেশহীন হয়ে পড়ে, ভয়-ভীতি, শাস্তি-পুরস্কার কিছুই সেখানে ছায়া ফেলে না। আব্দুল জলিল ধীর পায়ে মসজিদ থেকে নেমে আসে। ততক্ষণে নবীগঞ্জের তাণ্ডবলীলা শেষ হয়েছে। পড়ে আছে ধ্বংসাবশেষ। মসজিদ থেকে গজ দশেক তফাতে পড়ে আছে রহিম মোল্লার মৃতদেহ, রক্তে ভেজা তার সাদা পাঞ্জাবি, মাথার টুপি খসে পড়েছে মাথার পাশে। আর একটু এগোতেই চোখে পড়ে পুব আকাশে ধোঁয়ার রেখা। জলিল ফারাজির বুকের মধ্যে ছ্যাঁক করে ওঠে ওটা যে তাদের পাড়া! পুবপাড়ায় ঢুকতেই প্রথমে পড়ে মোল্লাবাড়ি। ওরা বিশ ঘর মানুষ গুছিয়ে এক ভিটেয় বাস করে। কিন্তু এ কী হাল ওদের বাড়িঘরের! আগুনে পুড়ে ভস্ম হয়ে গেছে ঘরের পর ঘর। দগ্ধ খুঁটি নির্বিকার দাঁড়িয়ে ধোঁয়া ছড়াচ্ছে ধিকিধিকি। সেই খুঁটির গোড়ায় দুটি ছাগল পুড়ে কয়লা হয়ে পরস্পর গলাগলি করে শুয়ে আছে। আব্দুল জলিল চোখ মেলে তাকাতে পারে না। দু’চোখ বন্ধ করে এক দৌড়ে মোল্লাবাড়ি পেরোতে চায়। আগুনের আগ্রাসী জিহ্বা মোল্লাবাড়ির বাইরে প্রসারিত হয়নি দেখে একটুখানি আশ্বস্ত হয়। এ গ্রামের পাঁচটা ছেলে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে, পাঁচটাই এই মোল্লাবাড়ির ছেলে। মোল্লাদের কোন জামাই যেন আর্মি ছিল, সে-ই পালিয়ে এসে শ্বশুরবাড়িতে দল পাকিয়ে সবাইকে নিয়ে ভারতে ভেগেছে। ওদের ঘর পোড়ানোর জন্য এই কারণই যথেষ্ট। ভগ্নস্ত‚পের মধ্যে নারী-পুরুষের আহাজারি তাড়িয়ে ফেরে আব্দুল জলিলকে। কিন্তু এ কী তার বাড়িতে লোকজন কই? ঘরের জিনিসপত্র তছনছ করে ছিটানো, যেন এখানে খানিক আগে যুদ্ধ হয়েছে। নাম ধরে ডাকতে ভুলে যায় সে। এ ঘরে ও ঘরে খুঁজে ফেরে স্ত্রী-কন্যা-পুত্র। অবশেষে ভাঁড়ার ঘরে মাটির কুঠির আড়ালে আবিষ্কার করে ধাঁধা লাগা পুত্রকে। যেন সে অনুভ‚তিহীন কাঠের ঘোড়া। শেষ পর্যন্ত পুত্রকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে সে কেঁদে ওঠে, কথা বল বাপ জিন্নাহ, তোর মা কোথায়? তোর বু কোথায়? জিন্নাহ নিরুত্তর। বাপের কান্না তাকে এতটুকু সংক্রমিত করে না। পাথর হয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকে বাপের কোল ঘেঁষে। আব্দুল জলিল পুত্রের কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে কথা বলাতে চেষ্টা করে। কথা বলতে যদি ইচ্ছে না-ই করে, সে চায়, অন্তত একবার কেঁদে উঠুক জিন্নাহ। কাঁদলেও বুক থেকে পাথর নেমে যায়। অনেক চেষ্টার পর জিন্নাহ কেঁদে ওঠে বটে, সে কান্নার পরপর তার সংজ্ঞা হারায়। জিন্নাহর সংজ্ঞাহীন দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগেই তার বাপ বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে পরম মমতা ও উৎকণ্ঠায়। আর তখনি নজরে পড়ে পায়ের নিচে ছড়িয়ে থাকা কাঁচের চুড়ির ভাঙা টুকরো। লাল টুকটুকে। স্কুলে পড়া মেয়েদের চুড়ি পরা তার মোটেই পছন্দ নয়। জমিলার বহু আবদার নির্বিবাদে মেনে নিয়েছে, কেন এই একটি বায়না সে পূরণ করেনি ইচ্ছে করেই। তাতে অবশ্য জমিলার সাধ অপূর্ণ থাকেনি, পাড়ার ফেরিওয়ালার কাছ থেকে ওর মা ডজনখানেক বেলোয়াড়ি চুড়ি কিনে দিয়েছে ঠিকই। ফর্সা ধবধবে হাতে লাল টুকটুকে চুড়ির সারি তার নজরে পড়েছে, খিলখিলানো হাসির মতো ঝনঝনাৎ শব্দ এসে কানে বেজেছে; তারপরও সে মেয়ে অথবা তার মাকে কিছুই বলেনি। জমিলা এবং তার মায়ের খবর শোনার পর আব্দুুল জলিলের সংজ্ঞা হারানোর দশা হয়। হাত-পা অবশ হয়ে আসে। মা-মেয়ের খোঁজ করার উদ্যম পায় না ভেতরে। কথা বলারও রুচি নষ্ট হয়ে আসে। দম ধরে বসে থাকে সারাদিন এক ঠায়। খবর পেয়ে নন্দনগর থেকে ছুটে আসে সাইফুল। আব্দুল জলিল চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে থাকে শ্যালকের দিকে, যেন তাকে চিনতে কষ্ট হচ্ছে তার। সাইফুল নানাভাবে চেষ্টা করে তার দুলাভাইকে স্বাভাবিক করে তুলতে। কিন্তু জলিল ফারাজি কিছুতেই মুখ খোলে না, যেন বা প্রতিজ্ঞার ধনুকে তীর বেঁধেছে টানটান। সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে সে একটু রেগে ওঠে, জমিলাকে না হয় ওরা ধরে নিয়ে গেছে, ওর মাকে তো নিয়ে যায়নি, তাকে তো খুঁজে বের করতে হবে? নাকি গুম ধরে বসে থাকলেই চলবে? আব্দুল জলিল পূর্বাপর প্রতিক্রিয়াহীন। সেও এ রকম শুনেছে বটে, জমিলাকে টেনেহিঁচড়ে মিলিটারি জিপে তোলার সময় ওর মা ছুটে এসে আছড়ে পড়েছিল। জিপের পিছে পিছে সে নাকি উন্মাদের মতো দৌড়েছিল অনেক দূর। পেছনের ট্রাক থেমে তাকেও তুলে নিয়েছে এ দৃশ্য নাকি দেখেছে কেউ কেউ। জলিল ফারাজি কোথায় খুঁজবে তার স্ত্রী-কন্যাকে। সে হঠাৎ মুখ খোলে এবং এতক্ষণে যেন তার শ্যালককে চিনতে পারে, তুই কি মুক্তি হয়েছিস সাইফুল? মুক্তি হসনি? এ সময়ে এ প্রশ্ন খুব প্রাসঙ্গিক মনে হয় না সাইফুলের। সে ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক তাকায়। জলিল ফারাজি বিরক্ত হয়, আমার কাছে লুকাসনে, সত্যি তুই মুক্তি হসনি সাইফুল? সাইফুল এতক্ষণে ঘাড় নেড়ে জানায়, এখনো হইনি। দু’একদিনের মধ্যেই ইন্ডিয়ায় যাব, মুক্তি হব। আমাকেও সঙ্গে নে সাইফুল। হঠাৎ শ্যালকের হাত চেপে ধরে জলিল ফারাজি। তার কণ্ঠে দারুণ আকুলতা। ভীতবিহ্বল জিন্নাহর মুখটা সহসা বুকে জাপটে ধরে সে বলে, এই দ্যাখ, আমার ছেলের মাথায় হাত দিয়ে বলছি, আমিও মুক্তি হব।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App