×

স্বাস্থ্য

করোনায় স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে দেশের নারীরা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২০, ০৪:৩১ পিএম

করোনায় স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে দেশের নারীরা

ফাইল ছবি

নাসরিন আক্তার করোনাকালে সহকারী নার্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন সরকারি একটি হাসপাতালে। করোনার শুরুর থেকেই এই নারী সম্মুখভাগে থেকে দায়িত্ব পালন করলেও পর্যাপ্ত ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রী (পিপিই), মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার পাননি। এক পর্যায়ে করোনা আক্রান্ত হয়ে পড়েন তিনি। চিকিৎসার জন্য যান মুগদা জেনারেল হাসপাতালে। কিন্তু সেখানে চরম অবহেলার শিকার হন। তার চিকিৎসায় ছিলোনা কারোও নজরদারি। নিজেকে স্বাস্থ্যকর্মী পরিচয় দিয়েও পাননি একটি কেবিন। এক পর্যায়ে চিকিৎসা সেবায় আস্থা ফেরাতে না পেরে হাসপাতাল ছেড়ে চলে যান বাসায়। তার মতো এমন অনেক নারী অবহেলার শিকার হয়েছেন।

করোনা কালীন সময়ে নাসরিন আক্তারের মতো অনেক নারী স্বাস্থ্যসেবা পাননি। এমনকি এ সময়ে বাল্য বিয়ে, অল্প বয়সে গর্ভধারণ, গর্ভপাতসহ বিভিন্ন প্রকার ঘটনা ঘটছে প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে। গর্ভকালীন সেবা, নিরাপদ প্রসব ও পরবর্তী সেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে নারী ও কিশোরীরা। করোনাকালে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো সীমিত আকারে স্বাস্থ্য পরিসেবা চালু রাখার কারনে অধিকাংশ মানুষকে ঘরে বন্দী থাকতে হয়েছে। এতে হাতের কাছে পরিবার পরিকল্পনার সেবা পাননি। ফলে ঘরে থাকা অনেক নারী অনাকাঙ্খিত গর্ভধারণ করতে বাধ্য হচ্ছেন বলে মনে করা হচ্ছে।

করোনা প্রার্দুভাবের আগে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরসহ বিভিন্ন সংস্থা নানা কর্মসূচি গ্রহণ করলেও বর্তমানে এ ধরনের কর্মকাণ্ড অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে। এমনকি জেলা-উপজেলা পর্যায়ে যাতায়াতসহ বিভিন্ন প্রতিকূলতা পার হয়ে নারীরা সেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। রয়েছে জনবল সঙ্কটও। দেশের হাসপাতালগুলোতে কর্মরত অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চরম ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করলেও তাদের ব্যক্তিগত সুরক্ষায় নজর নেই দায়িত্বশীলদের। দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় অনেকেই নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেকেই। চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেট-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের কারণে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে আগামী দিনগলোতে শিশু ও মাতৃমুত্যু বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ এই দেশগুলোতে পরিবার পরিকল্পনা সেবার প্রায় ১০ শতাংশ কমে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার কমবে এবং অনিরাপদ গর্ভপাত বাড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন মহানগর জেনারেল হাসপাতাল পরিদর্শন করে দেখা গেছে এ হাসপাতালে করোনা চিকিৎসা সেবায় নিয়েজিত কর্মীদের জন্য আলাদা কোনও যানবাহনের ব্যবস্থা রাখা হয়নি রোগী বহনের একই অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালটির পরিচালকসহ অন্যরা যাতায়াত করছেন। শুরুর দিকে তাদের জন্য পর্যাপ্ত পিপিই, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও মাস্ক ছিলো না। ফলে চরম ঝুঁকির মধ্যে থেকে তারা দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালটিতে স্ত্রী রোগ, গাইনি, সার্জারি, মেডিসিন, প্রসূতি, চর্ম, যৌন, আল্ট্রাসনোগ্রাফি, রেডিওলোজী, প্যাথলজি ও গর্ভবতী নারীদের টিকাদানসহ নানা রোগের চিকিৎসা সেবা দেয়া হতো। এছাড়া সংস্থাাটির আওতাধীন আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস ডেলিভারী প্রকল্পের আওতায় ২৮টি নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও ৫টি নগর মাতৃসদন কেন্দ্র রয়েছে। সেগুলো মাধ্যমে নারী ও শিশুদের প্রজননগত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা হতো। কিন্তু করোনাকালীন সময়ে এই সেবাগুলো বন্ধ রাখা হয়। বিশেষ করে মহানগর জেনারেল হাসপাতালে সবধরণের সেবা বন্ধ করে সেখানে করোনা পরীক্ষা কেন্দ্র চালু করা হয়।

জানতে চাইলে মহানগর জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক ডা. প্রকাশ চন্দ্র রায় বলেন, করোনার কারণে আমাদের অ্যান্য সব ধরণের সেবা বন্ধ রয়েছে। আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। যারা দায়িত্ব পালন করছেন তারাও নানা প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে কাজ করছেন। এছাড়াও নারী মৈত্রী করোনাকালীন সময়ে নারীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিভিন্ন সেবামূলক কাজ করেছে। হাসপাতাল গুলোতে করোনা সামগ্রী পৌছে দেয়া সহ সংস্থাাটির কর্মীরা সেচ্ছাসেবীমূলক কাজে নিজেদের নিয়োজিত রেখেছেন।

মহামারি করোনাভাইরাস একদিকে মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে , অন্যদিকে আক্রান্ত করছে মনকেও। জাতিসংঘের এক জরিপে উঠে এসেছে, করোনার সময়ে বিশ্বের অর্ধেক তরুণ-তরুণী উদ্বেগ ও হতাশায় আক্রান্ত। করোনা পরিস্থিতিতে অনেকেই ভুগছেন মানসিক সমস্যায়। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন অথবা ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে। কর্মক্ষেত্র কমে যাওয়ায় বাড়েছে বেকারত্ব। ফলে হতাশাগ্রস্ত তরুণদের অনেকে হচ্ছে বিপথগামী। জড়িয়ে পড়ছে নেশা, ধর্ষণ, নারী নির্যাতনসহ নানা সন্ত্রাসী কমর্কান্ডে। অন্যদিকে ঘরবন্দি থাকার কারণে বাড়ছে পারিবারিক কলহ-বিবাদ, এতে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন অনেকে। এ অবস্থায় তাদের যে মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজন তা পাচ্ছেন না। হাসপাতালগুলো যুবকদের কাউন্সিলিংয়ের জন্য আলাদা কোনও কর্ণার বা ব্যবস্থা নেই।

বাংলাদেশে নারী, যুব সম্প্রদায় ও বয়স্ক কর্মীরা করোনা মহামারির কারণে অন্যদের থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে মনে করে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। সংস্থাটি বলছে, অন্য কোনও আযয়ের উপায় না থাকলে তাদের পক্ষে জীবিকা নির্বাহ করা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার। আইএলও থেকে করোনা নিয়ে যে সিরিজ প্রকাশিত হয়েছে তার সর্বশেষ প্রতিবেদনে এ মন্তব্য করেছেন সংস্থাটির বাংলাদেশ প্রধান টুমো পুতিয়াইনেন। তিনি বলেন, যুব সম্প্রদায় ইতোমধ্যে বেকারত্বের শিকার অথবা নিজেদের যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাচ্ছে না। করোনার কারণে তাদের চাহিদা আরও কমবে এবং জীবিকা নির্বাহ করতে সমস্যা হবে।

এবারের ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে পরিবার পরিকল্পনা সেবা খাতে ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। মেরিস্টোপস বাংলাদেশের অ্যাডভান্স ফ্যামিলি প্ল্যানিং কার্যক্রমের সমন্বয়কারী মনজুন নাহার বলেন, করোনাকালীন এবং করোনা পরবর্তী সেবা নিশ্চিত করতে হলে এই বাজেট কতটা সহায়ক হবে তা এখনই ভেবে দেখা দরকার। পাশাপাশি বাজেটের সাঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে পরিবার পরিকল্পনা খাতে বাজেট বৃদ্ধি প্রয়োজন। গবেষকেরা বলছেন, স্বাস্থ্য খাতের বিরাজমান দুর্বলতার পাশাপাশি করোনাকালে কিছু ত্রুটি দেখা দেয়। এখাতে দুর্নীতিও মাথা ছাড়া দিয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে আছে প্র¯‘তি, সমন্বয়, নেতৃত্বের অভাব, নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণে দুর্নীতি, নিম্নমানের সেবা, সেবার ক্ষেত্রে বৈষম্য বা কোনো সেবা না দেয়া। এসব কারণে মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা ও নানা ধরনের সন্দেহ তৈরি হয়েছে।

অ্যাডভান্স ফ্যামিলি প্ল্যানিং (এএফপি) মিডিয়া অ্যাডভোকেসির টিম লিডার পুলক রাহা জানান, করোনা মহামারিতে গ্রাম ও শহর সব জায়গার মানুষ বলতে গেলে ঘরবন্দী অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। তবে এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন জায়গায় চলছে গোপনে বাল্যবিয়ের আয়োজন। করোনাকালীন আর্থিক সংকটের কারণে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো তাদের কিশোরী মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি বিদ্যালয় বন্ধ এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিত সেবা প্রদান না করায় কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্যও ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে।

ঢাকার নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত যুববান্ধব স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা ও সম্ভাবনা শীর্ষক এক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকরা জানান, দেশের এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীই বয়সে তরুণ। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে তাদের স্বাস্থ্যসেবায় আরও নজর দেয়া দরকার। যুবাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে। এ লক্ষ্যে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগ ও অংশীজনদের সমন্বয় প্রয়োজন।

জানা গেছে সরকার কিশোর কিশোরীদের শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার জন্য সারা দেশে ৯০৩টি কৈশোরবান্ধব কেন্দ্র স্থাপন করেছে। এসব কেন্দ্র থেকে স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হচ্ছে- জানানো হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। করোনা মহামারীর সময় এসব কেন্দ্রের অধিকাংশই ছিলো বন্ধ। তবে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাহান আরা বানু ওই আলোচনায় বলেন, পুরো দেশে ৯০৩টি এমন কেন্দ্রের মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীদের জন্য সেবা কার্যক্রম চালাতে সরকারের পরিকল্পনা আছে। এছাড়া তরুণ-তরুণীদের এই সেবা নিশ্চিতে বিভিন্ন প্রকল্পে প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। কিশোরীদের জন্য ১৫০টি বিদ্যালয়ে দেড় হাজারের বেশি ফার্স্ট এইড বক্স দেয়া হয়েছে।

তিনি জানান, তরুণদের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবা সংক্রান্ত সচেতনতা বাড়াতে এবং করোনাকালে এই সেবা পৌঁছে দিতে ১৬৭৬৭ কল সেন্টার চালু করা হয়েছে। টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে এই সেবা দেয়া হচ্ছে। ২০২৩ সালের মধ্যে প্রতি উপজেলায় দুটি কেন্দ্র স্থাপন করার লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে। শিল্প এলাকায় তরুণ-তরুণীদের জন্য স্যাটেলাইট ক্লিনিকের কার্যক্রম চলছে। এমনকি প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App