×

জাতীয়

সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২০, ০৯:৩১ এএম

সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ

স্বাস্থ্য

প্রথম ঘটনাটি ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার। ওই এলাকার তোফাজ্জল হোসেনের ৫ বছরের মেয়ে তাসফিয়া কিডনি রোগে আক্রান্ত। নিজের ফসলি জমি ও গরু বিক্রি করে কখনো ঢাকায়, কখনো ময়মনসিংহে মেয়ের চিকিৎসা করিয়েছেন তিনি। টাকার অভাবে গত ৩১ আগস্ট থেকে তাসফিয়ার চিকিৎসা বন্ধ। পরবর্তী ঘটনাটি চলতি মাসের জুলাই মাসের রাজধানীর উত্তরখানে। হাতুড়ে চিকিৎসকের চিকিৎসায় মারা যান মালা রানি দাস (৩৫)।

এমন ঘটনা আমাদের চারপাশে অহরহই ঘটছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চর ও হাওরাঞ্চল, ভাসমান মানুষ এখনো স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তারা বলছেন, দেশে বর্তমানে যে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা রয়েছে, তা অনেক দেশের চেয়ে ভালো। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে দেশের চিকিৎসাসেবার মান আগের চেয়ে বহুগুণ উন্নত হয়েছে। জেলা, উপজেলা এমনকি কমিউনিটি পর্যায়েও চিকিৎসাসেবার মান বেড়েছে। জনবলের ঘাটতিসহ যেসব ঘাটতি রয়েছে সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে তা উত্তরণ সম্ভব। কিন্তু এরপরও দেশে এখনো সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা (ইউএইচসি) কার্যক্রমে অনেক চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান। আর করোনাকালে দেশের স্বাস্থ্য খাতের নাজুক অবস্থা প্রকাশ পেয়েছে। সংকটকালে দেশের স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতা কী, সেই চিত্র সবার কাছেই এখন পরিষ্কার। তাই ইউএইচসি অর্জনে বাংলাদেশের সামনে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এখনো অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে বাংলাদেশকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘ইউএইচসি’র ধারণা আমাদের জন্য নতুন নয়। সংবিধানে সবার জন্য স্বাস্থ্য বিষয়টি উল্লেখ আছে। ২০০০ সালের আলমা আটা ঘোষণায়ও ‘সকলের জন্য স্বাস্থ্য’র কথা বলা হয়েছিল। তাতে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার ওপর জোর দেয়া হয়েছিল। তবে ইউএইচসিতে মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে এবং তা আমরা কীভাবে নিশ্চিত করব সেই বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

ইউএইচসির মূল কথা হচ্ছে- সব মানুষ প্রয়োজনের সময় মানসম্পন্ন চিকিৎসাসেবা পাবে। চিকিৎসাসেবা কিনতে গিয়ে কেউ দরিদ্র হবে না। এজন্য স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি অপচয় ও দুর্নীতি কমাতে হবে। স্বাস্থ্যবিমা মানুষকে সেবাপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা দেবে।

২০০০ সালের পর থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ধারণা জনপ্রিয় করার চেষ্টা করছে। তবে ২০১২ সালে জেনেভায় ওয়ার্ল্ড হেলথ এসেম্বলিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক মার্গারেট চ্যাং বলেছিলেন, ‘জনস্বাস্থ্যের উন্নতিতে এককভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী ধারণা হচ্ছে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা।’ ওই এসেম্বলিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জন্য ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা’র উদ্যোগ নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নে জনগোষ্ঠীকে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ইউএইচসির আওতায় আনতে বাংলাদেশ অঙ্গীকারবদ্ধ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি বছর বিশ^জুড়ে প্রায় ১০০ কোটি মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের মধ্যে প্রায় ১০ কোটি মানুষ স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় মেটাতে গিয়ে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ৪ কোটি ৮০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে অবস্থান করছে এবং প্রতি বছর শারীরিক অসুস্থতার কারণে ৬৪ লাখ মানুষ দরিদ্রতার শিকার হচ্ছে।

সম্প্রতি সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষাবিষয়ক এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, দেশের সব মানুষকে বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনা যাবে না। যাদের টাকা আছে তারা টাকা দিয়ে সেবা নেবে প্রাইভেট হাসপাতালে। যাদের টাকা নেই তারা যাতে অভাবে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না হয় সেদিকে নজর রয়েছে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার মান ও পরিধি বাড়াতে পারলে মানুষের আরো উপকার হবে।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ জানান, সুলভ ও সাশ্রয়ী স্বাস্থ্যসেবা অর্জনের পথে অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিক বাধা রয়েছে। দেশের ৬০ শতাংশ মানুষ এখনো ওষুধের দোকান বা অনভিজ্ঞ হাতুড়ে ডাক্তারের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে থাকে। বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, বস্তি, ভাসমান, চর ও হাওরাঞ্চলের মানুষ এখনো স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে না। যদিও উপজেলায় উপজেলা কমিউনিটি ক্লিনিক আছে, উপজেলা হাসপাতাল আছে সেখানে চিকিৎসক সংকটসহ নানান সংকট আছে।

তিনি বলেন, ইউএইচসির ধারণায় ২০৩০ সালের মধ্যে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে ও সাধ্যের মধ্যে নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে। অথচ আমাদের দেশে চিকিৎসা ব্যয় দিন দিন বেড়েই চলছে। আর এই সেবা পেতে যে পরিমাণ অর্থ খরচ হয় তার সিংহভাগই বহন করে রোগী নিজে। ইউএইচসি অর্জনের জন্য মানসম্পন্ন ও দক্ষ জনবলও দরকার। এই ঘাটতি পূরণের চেষ্টা হচ্ছে। কিন্তু এখনো ঘাটতি রয়েই গেছে। সুতরাং সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আমাদের এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।

স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলন সম্পর্কিত জাতীয় কমিটির চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব মনে করেন, ইউএইচসির জন্য প্রথমে প্রয়োজন স্বাস্থ্য খাতের সর্বগ্রাসী দুর্নীতি আর অপচয়ের লাগাম টেনে ধরা। নজরদারি ও পরিকল্পনার অভাবে দুর্নীতি ও অনিয়ম স্বাস্থ্য খাতকে পেছনে ফেলে দিচ্ছে।

এ প্রেক্ষাপটে আজ পালিত হচ্ছে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিবস। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আলাদা বাণী দিয়েছেন। এ উপলক্ষে আজ শনিবার সকাল সাড়ে ১১টায় হোটেল সোনারগাঁওয়ের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। সকাল সাড়ে ১০টায় ওয়েস্টিন হোটেল ন্যাশনাল, হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি, কিডনি ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ডায়াবেটিকের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হবে আন্তর্জাতিক সম্মেলন। সম্মেলনে প্রধান অতিথি থাকবেন পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App