×

জাতীয়

একই দিনে পদ্মা সেতু দিয়ে বাস-ট্রেন চলা নিয়ে সংশয়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২০, ০৯:৫১ এএম

দেশের সর্ববৃহৎ রেল প্রকল্প ও প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারভিত্তিক এক নম্বর প্রকল্প ‘পদ্মা লিংক রেল প্রকল্পের’ জটিলতা মিটছে না। প্রথমে নকশায় রেললাইন ছিল না। পরে তা যোগ করা হয়। বাড়ে সময় ও ব্যয়। সম্প্রতি আবার রেল লিংকের দুই পাড়ের দুটো পয়েন্টে ভায়াড্রাক্টে ত্রুটি দেখা দিয়েছে। যার ফলে সেতুর উপর দিয়ে বেশি উচ্চতার রেল ওয়াগান বা কন্টেইনার যাতায়াত করতে পারবে না। ফলে আবারো রেল লিংকের ডিজাইনের ত্রæটি সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছে। সেতু বিভাগ রেল লিংক প্রকল্পের ডিজাইন বদলানোর অনুমতিও দিয়েছে। এ বিষয়ে পদ্মা লিংক রেল প্রকল্পের পরিচালক মো. ফখরুদ্দীন আহমেদ ভোরের কাগজকে জানান, পদ্মা সেতুর দুই পাড়ে দুটি পয়েন্টে ভায়াড্রাক্টের ত্রæটি সংশোধনের চেষ্টা চলছে। পদ্মা লিংকের ইঞ্জিনিয়ার (চীনা কোম্পানি) সেই সঙ্গে বুয়েটের একটি টিম (এক্সপার্ট) এ ত্রুটি সংশোধনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আশা করি, তারা এটির সংশোধন করে ফেলবে। তবে এখন পর্যন্ত ভায়াড্রাক্ট ভেঙে ফেলার কোনো প্রস্তাব আসেনি। না ভেঙে ত্রুটি সংশোধনের চেষ্টা চলছে। এদিকে মূল পদ্মা সেতুর সার্বিক অগ্রগতি ৯১ শতাংশের ওপরে। সেখানে পদ্মা লিংক রেল প্রকল্পের অগ্রগতি মাত্র ৩১ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি ৩৭ শতাংশ। তবে পদ্মা লিংক রেল প্রকল্পের মোট অগ্রগতি ৩১ শতাংশ হলেও বাকি কাজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শেষ করে একই সঙ্গে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিনে সেতুর উপর দিয়ে বাস ও ট্রেন একসঙ্গে চলবে সেই ভাঙা থেকে মাওয়া পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার রেললাইনের কাজের অগ্রগতি মাত্র ৬০ শতাংশ। অতিবৃষ্টি, করোনা মহামারির কারণে এখানে কাজের গতি স্লথ। সে কারণে একই দিনে পদ্মা সেতু দিয়ে বাস ও ট্রেন চলাচল নিয়ে সংশয় রয়েছে বিশেষজ্ঞদের। এ বিষয়ে প্রকল্পের পিডি ফখরুদ্দীন আহমেদ ভোরের কাগজকে জানান, করোনার কারণে কাজ অনেক পিছিয়েছে। তাছাড়া চীন থেকে মালামাল আসতে দেরি হচ্ছে। কেননা আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা চীনে গিয়ে মালামালের কোয়ালিটি পরীক্ষা করার পর মালামাল দেশে আসার কথা, কিন্তু আমরা যেতে পারছি না। সে কারণে মালামালও আসতে দেরি হচ্ছে। এসব কারণে মূল কাজে বিলম্ব হচ্ছে। তাছাড়া চীনের ইঞ্জিনিয়াররা সবাই কাজে যোগ না দেয়ায় বিলম্ব হচ্ছে। তবে ভায়াড্রাক্টের নকশার কাজ চায়নার কন্ট্রাকটররা সমাধান করবে, তার সঙ্গে আমাদের বুয়েটের বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়াররা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অনুমোদন দেবেন। প্রকল্প সূত্র জানায়, ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেললাইন বসানোর কাজের আপাতত অগ্রগতি মাত্র ৩১ শতাংশ। তবে ভাঙা থেকে মাওয়া পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার রেললাইন বসানো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চলছে। তার উপরে দুই পাড়ের দুটো ভায়াড্রাক্টের ত্রু টি বিষফোঁড়া হিসেবে দেখা দিয়েছে। এখনো ডিজাইনের এই ত্রু টি সংশোধন করা সম্ভব হয়নি। এ জন্য ২-৩ মাস ভায়াড্রাক্টের কাজ বন্ধ রয়েছে। ফলে পাইলের নকশা পরিবর্তন করতে হচ্ছে। সেতুর দুই প্রান্তে সংযোগ সড়কের উপর দিয়ে রেলপথটি অতিক্রমের স্থানে প্রয়োজনীয় উচ্চতা ও ব্যাসার্ধ রাখা হয়নি। এতে সংযোগ সড়ক দিয়ে যান চলাচল বিঘ্নিত হবে বলে মনে করছেন প্রকৌশলীরা। এ কারণে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের নকশা সমন্বয় করা হচ্ছে। তবে মাটি ভরাটের কাজ চলছে। তাছাড়া করোনার কারণে চীন থেকে প্রয়োজনীয় রেলসহ মালামাল আসতেও দেরি হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, আপাতত পুরো কাজ দূরে থাক, সেতুর উপর দিয়ে আসা-যাওয়া করার মতো মাওয়া থেকে ভাঙা ৩০ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে রেলওয়ের পক্ষে। যেখানে সেতুর অগ্রগতি ৯১ শতাংশের ওপরে সেখানে রেলের অগ্রগতি ৩১ শতাংশ, দুটোর এত পার্থক্য, যাতে একই দিনে বাস-ট্রেন চালানো নিয়ে সংশয় রয়েছে অনেকের। এ বিষয়ে বুয়েটের পুরাকৌশল বিভাগের ইঞ্জিনিয়ার ড. এম শামসুল হক জানান, পদ্মা সেতু রেল প্রকল্পের ব্রিজে উঠার আগে দুই পাড়ে দুটো পয়েন্টে ভায়াড্রাক্টের উচ্চতা ও ব্যাসার্ধ নিয়ে নকশার জটিলতা দেখা দিয়েছে। আসলে যখন চীনা কোম্পানি নকশা তৈরি করে তখন এটি খেয়াল করা হয়নি। যার ফলে বেশি উচ্চতা সম্পন্ন কন্টেইনার বা ওয়াগান ব্রিজে উঠতে পারবে না। এটি সংশোধনের জন্য বুয়েটসহ রেলওয়ের ইঞ্জিনিয়ারা চেষ্টা করছেন। একটা সমাধান হবে আশা করা যায়। তবে পদ্মা সেতুর অগ্রগতির তুলনায় রেলের অগ্রগতি কম নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি। তার ওপরে ভায়াড্রাক্টের নকশা সংশোধন আরো সময় নেবে, যার ফলে অগ্রগতিতে বাধাপ্রাপ্ত হবে বলে মন্তব্য করেন এ বিশেষজ্ঞ। এদিকে বারবার ত্রুটির কারণে নকশা সংশোধন করে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ও ব্যয়-দুটোই বাড়ছে। ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকায় শুরু হয়ে পদ্মা লিংক রেল প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় ২০১৫ সালে দাঁড়ায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকায়, সময়সীমা ধরা হয় ২০২০ সাল। যদিও পরে তা বেড়ে ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা হয়, বর্তমানে রেললাইনের নির্মাণ ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। অন্যদিকে, সময়সীমা ক্রমাগত বাড়তে বাড়তে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে। পদ্মা সেতু রেল প্রকল্পের কাজ সময়মতো শেষ হবে কিনা, সে বিষয় নিয়েও সংশয় রয়েছে। সম্প্রতি পদ্মা সেতু ও রেল সংযোগ প্রকল্পের এসব ত্রæটিপূর্ণ স্থান পরিদর্শন করেন রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। নির্মাণ ও নকশায় এসব ত্রুটির বিষয়ে সেখানে সাংবাদিকরা দৃষ্টি আকর্ষণ করলে রেলমন্ত্রী বলেন, এত বড় প্রকল্পের কিছু সমস্যা হতেই পারে। সেতু চালু হওয়ার আগেই এটি চিহ্নিত করা গেছে। তাই এটি সহজেই সমাধান করা যাবে। দ্রুত ত্রুটি সংশোধন করে ২০২১ সালের জুনে সেতুর উপর দিয়ে রেল চলাচল করবে। এদিকে, প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনা সংক্রান্ত সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা গেছে, রেল লিংক প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৬ সালের মে মাসে। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সাড়ে ৪ বছরে আর্থিক অগ্রগতি ৩৩ শতাংশ, আর বাস্তব অগ্রগতি ৩১ শতাংশ। এর মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। সংশোধিত মেয়াদ অনুসারে, আগামী ৪ বছরের মধ্যে প্রকল্পিিটর বাকি ৬৭ শতাংশ এবং বাস্তব কার্যক্রমের অবশিষ্ট ৬৯ শতাংশ কাজ শেষ হওয়ার কথা। এক্ষেত্রে আগামী ৪ বছরে গড়ে ১৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে আর্থিক ও ১৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ হারে বাস্তব অগ্রগতি অর্জন করতে হবে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে এ প্রকল্পের আর্থিক লক্ষ্যমাত্রা ৯ শতাংশ। এতে প্রতীয়মান হয়, চলতি অর্থবছরের এই আর্থিক লক্ষ্যমাত্রার বিবেচনায় প্রকল্পটি সমাপ্ত করতে আরো ৮ দশমিক ৩ বছর সময়ের প্রয়োজন হতে পারে। এ হিসাবে কাজটি শেষ হতে বিদ্যমান সময়ের চেয়ে অতিরিক্ত প্রায় ৪ দশমিক ৩ বছরসহ মোট ১২ দশমিক ৮ বছর সময় লাগবে। সেক্ষেত্রে প্রকল্পটিকে আর ফার্স্ট ট্র্যাকভুক্ত প্রকল্প হিসেবে বিবেচনার সুযোগ থাকবে না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App