সনদ আছে, স্বীকৃতি নেই
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২০, ০৯:৪২ এএম
আফাজ আলী
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কাছে তিনি ছিলেন আদরের ‘খোকন।’ জাতীয় নেতা ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ডাকতেন ‘বঙ্গবন্ধুর খোকন।’ মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানীর কাছে দত্তক সন্তান। মহান একাত্তরে টাঙ্গাইলে ১১নং সেক্টরে কাদেরিয়া বাহিনীর ৫নং কোম্পানির অধীনে অংশ নিয়েছেন ১২৮টিরও বেশি সফল যুদ্ধে। যুদ্ধের চিহ্ন হিসেবে পাঁচ দশক ধরে বয়ে বেড়াচ্ছেন পাঁজরের একটি ভাঙা হাড় ও ডান পায়ে গোড়ালির ক্ষত। বীরত্বের পুরস্কারস্বরূপ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত সনদসহ রয়েছে তিনটি সনদ। কিন্তু নেই বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। একাত্তরে এসএলআর নিয়ে জীবনবাজি রেখে দেশকে শত্রæমুক্ত করার যুদ্ধে জয়ী হলেও আজ জীবনযুদ্ধে একটু একটু করে হেরে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। কঠিন কাজ করার মতো শক্তি নেই ৭০ ছুঁইছুঁই দেহে। তবুও হাতে তার কুঠার। অসুস্থ স্ত্রীর ওষুধ আর সংসারের খরচ মেটাতে কাঠমিস্ত্রিই তার পরিচয়। মাঝে মাঝে অমসৃণ হাতে ছুঁয়ে দেখেন বীরত্বের সনদগুলো। ঝাপসা হয়ে আসে দৃষ্টি। নিজের অজান্তেই বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস, এভাবে কি কাটার কথা ছিল বঙ্গবন্ধুর খোকনের শেষ জীবন? মৃত্যুর আগে বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিটুকু কি মিলবে তার ভাগ্যে?
যশোরের কেশবপুর উপজেলার আফাজ আলী। গৌরীঘোনা ইউনিয়নের বুড়ূলী গ্রামের প্রয়াত শরীয়তুল্লাহ দফাদারের ছেলে আফাজ আলী বর্তমানে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে কেশবপুর পৌর এলাকার বালিয়াডাঙ্গায় বসবাস করেন। কাঠ শ্রমিকের কাজ করে অসুস্থ স্ত্রী ও ২ ছেলেমেয়ে নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত সনদপত্র, সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক আতাউল গনি ওসমানীর স্বাক্ষরিত সনদপত্র (ক্রমিক নং-৩২৩০৮), ১১ নং সেক্টরের আঞ্চলিক অধিনায়ক কাদের সিদ্দিকী স্বাক্ষরিত স্বাধীনতা সংগ্রামের সনদপত্র এবং রণাঙ্গনের (৫নং কোম্পানি) কমান্ডার রবিউল আলম গেরিলা স্বাক্ষরিত সনদপত্র রয়েছে যুদ্ধাহত আফাজ আলীর। তবুও নেই স্বীকৃতি।
স্বীকৃতির জন্য দাবি জানালেও বারবার উপেক্ষিত আফাজ আলী। বিজয়ের অর্ধশতকেও মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম না উঠার কারণ জানতে চাইলে তিনি ভোরের কাগজকে জানান, সার্টিফিকেট হারিয়ে গিয়েছিল। বাবার পুরনো ভিটে খোঁড়ার সময় মাটির নিচে পড়ে থাকা সার্টিফিকেটের বাক্সটি খুঁজে পান। মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য ২০০৫ সালে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সরাসরি আবেদন করেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিল ও স্বাক্ষর দিয়ে আবেদন গ্রহণ করা হয় ওই বছরের ৩ সেপ্টেম্বর। পরে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই বোর্ডে তিনি যোগাযোগ করেন। সেখান থেকে জানানো হয়েছে কমান্ডার রবিউল আলম গেরিলাকে বোর্ডে আনতে হবে। কিন্তু বয়োবৃদ্ধ কমান্ডার রবিউল আলমকে কেশবপুরে আনতে পারেননি তিনি। আর এখন তো কমান্ডার রবিউল সবকিছুর ঊর্ধ্বে, পরপারে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষকদের মতে, ৫০ বছর পরও সঠিক তালিকা করতে পারেনি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। আফাজ আলীর মতো অসংখ্য বীর যোদ্ধার নাম তালিকায় নেই। অন্যদিকে তালিকায় ঠাঁই পেয়েছেন একাধিক বিতর্কিত ব্যক্তি। এ ব্যাপারে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির ভোরের কাগজকে বলেন, নির্ভুল তালিকার জন্য আমরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছি। কেন ৫০ বছর পরে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য আবার যুদ্ধ করতে হবে? এটি তো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। কিন্তু তারা সঠিক দায়িত্ব পালন করতে পারেনি।
ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির সভাপতি ডা. এম এ হাসান ভোরের কাগজকে বলেন, তালিকা নিয়ে মন্ত্রণালয়ের পুরোই লেজেগোবরে অবস্থা। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে কেন স্বীকৃতির জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হবে? মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রতিটি এলাকা থেকে তাদের খুঁজে বের করা।
আফাজ আলীর একাত্তর : উত্তাল একাত্তরে আফাজ আলী ১৮ বছরের তরুণ। রক্তে মারণ নেশা। মগজে টগবগ করছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ। সারাদেশে জলপাই ট্যাংক আর জলপাই পোশাকের পৈশাচিকতা রুখতে ঘর ছাড়েন। বাবার পকেটের টাকা চুরি করে যশোরের গৌরবিহারীর ছেলের সঙ্গে চলে যান টাঙ্গাইল। ঠাঁই পান টাঙ্গাইল কোতোয়ালি থানায় কর্মরত দারোগার বাসায়। সখ্যতা গড়ে তোলেন থানার পাশের চা দোকানদার বাবুর সঙ্গে। বাবুর মাধ্যমে পরিচিত হন টাইগার কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে।
এরপর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, জেনারেল ওসমানী, কমান্ডার রবিউল আলমের সঙ্গে পরিচিত হন। কোতোয়ালি থানার তথ্য জানান তাদের। পাহাড়তলীতে দ্বিতীয় ব্যাচে যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে কাঁধে তুলে নেন অস্ত্র। এরপর টাঙ্গাইল সদরের চারাবাড়ী, খুদিরামপুর, কালীহাতির বল্লা বাজার, রতনগঞ্জ, তেজপুর, বল্লববাড়ী, জোগারচর, ঘমজানি, পৌজান, ছাতিহাটি, ঘোনাবাড়ী, ঘাটাইলের ঝাওয়াইল, গুপ্ত বৃন্দাবন, কালিদাসপাড়াসহ ১২৮টি সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেন। ঘাটাইল ক্যান্টমেন্ট দখলের দিন ডান পায়ের গোড়ালিতে গুলিবিদ্ধ হন। কালীহাতি যুদ্ধে সহযোদ্ধা সুকুমার মারা যান। এ সময় মোসলেম ও লুৎফর আহত হন। ওই যুদ্ধে ডিগবাজি দেয়ার সময় এসএলআর বুকের নিচে পড়ে বুকের ডান পাশের একখানা পাজরের হাড় ভেঙে যায় আফাজ আলীর। যুদ্ধ শেষে টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে বঙ্গবন্ধুর কাছে দুটি অস্ত্র জমা দেন। ওই অনুষ্ঠানে এম এ জি ওসমানী ও বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী উপস্থিত ছিলেন।
জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত আফাজ আলী : স্বাধীন দেশেও যুদ্ধ শেষ হয়নি আফাজ আলীর। একদিকে স্বীকৃতি আদায়ের লড়াই, অন্যদিকে সংসারের ঘানি টানতে টানতে ক্লান্ত জীবন। তবুও থেমে নেই বেঁচে থাকার যুদ্ধ। দুবেলা-দুমুঠো ভাতের সংস্থানে কাঠ চেরাইয়ে কাজে বৃদ্ধ আফাজ আলীর আয় দিনে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা। চোখে ভাসে যুদ্ধদিনের স্মৃতি ও সহযোদ্ধাদের লাশ। কষ্টের জীবনে সান্ত¡না খোঁজেন মোবাইল ফোনে চোখের জলে আর স্বাধীনতার গানে। বললেন, ধানমন্ডি-৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ক্যাপ্টেন মনসুর আলীসহ এক টেবিলে ভাত খেয়েছি একাধিকবার। পেয়েছি সন্তান স্নেহ। আমাকে কেউ আর খোকন বলে ডাকে না। অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারি না নিজের ও অসুস্থ স্ত্রীর। একটাই চাওয়া, শুধু মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতিটুকু নিয়ে মরতে চাই।