×

জাতীয়

বিচারের অপেক্ষায় ৪৭ বছর

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২০, ০৯:৪৭ এএম

বিচারের অপেক্ষায় ৪৭ বছর

কমলেশ বেদজ্ঞ

ডেডলাইন একাত্তর, ৭ ডিসেম্বর। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে হটিয়ে মুক্ত হয় গোপালগঞ্জ। গোপালগঞ্জে প্রতিরোধযুদ্ধ শুরু হয় ২৭ মার্চ। তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত মহকুমা কর্মকর্তা আবদুল মজিদের সহযোগিতায় ট্রেজারি থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজ (তৎকালীন কায়েদে আযম মেমোরিয়াল কলেজ) মাঠে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালু হয়। গোপালগঞ্জে হানাদার বাহিনী ঢুকে ৩০ এপ্রিল। খুন-লুট-অগ্নিসংযোগে শ্মশানে পরিণত গোটা এলাকা। জয়নাল, মিন্টু, ইব্রাহীম, ইয়াসির, রবিউল, ইমাম উদ্দিনসহ অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা আর অধ্যাপক সন্তোষ কুমার দাস, প্রবীণ শিক্ষাবিদ গোবিন্দ ঠাকুরসহ শত শত নিরীহ মানুষের রক্তে মুক্ত হয় গোপালগঞ্জ। গোপালগঞ্জকে শত্রুমুক্ত করতে বেশির ভাগ যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন হেমায়েত বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার কমরেড কমলেশ বেদজ্ঞ। শুধু গোপালগঞ্জই নয়, মুক্তিযুদ্ধে ৮নং সেক্টরে হেমায়েত বাহিনীর এই ডেপুটি কমান্ডার রাজাপুর, রামশীল, দোনারকান্দি, পয়সারহাট, স্বরূপকাঠি, ভাঙ্গা, পাইকারবাড়ি, সিকিরবাজার, ঘাঘরের যুদ্ধসহ ওই অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ সম্মুখযুদ্ধে অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করেন। কিন্তু বিজয়ের মাত্র দেড় বছরের মধ্যেই ১৯৭৩ সালের ১০ মার্চ তিন সহযোদ্ধাসহ নির্মমভাবে খুন হন কমরেড কমলেশ। চাঞ্চল্যকর ওই খুনের আসামি তারই দলপ্রধান হেমায়েত উদ্দিন বীরবিক্রমসহ ২১ জন। সময়ের পরিক্রমায় বর্তমানে বেঁচে আছেন মাত্র ৬ আসামি।

পঁচিশটিরও বেশি সফল যুদ্ধে অংশ নেয়া এক লড়াকু মুক্তিযোদ্ধা কমলেশ বেদজ্ঞ। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে দেশ পুনর্গঠনে ইতিহাসে গোপালগঞ্জবাসীর কাছে সুপরিচিত বাম নেতা। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের প্রায় পাঁচ দশকেও বিচার পাননি তার পরিবারের সদস্যরা। মামলাটি এ পর্যন্ত হাইকোর্টে ৬ বার স্থগিত করা হয়। সর্বশেষ ২০১৫ সালে হাইকোর্ট মামলাটি খারিজ করে দেয়। মামলাটি আবার সুপ্রিম কোর্ট স্থগিত করে। জানতে চাইলে কমলেশ বেদজ্ঞের মেয়ে সুতপা বেদজ্ঞ ভোরের কাগজকে বলেন, মার্শাল’ ল কোর্টে এই বিচার প্রক্রিয়াকে চিরতরে বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়েছে। সরকার বাদী এই মামলায় হাইকোর্ট বারবার স্থগিতাদেশ দিয়েছে। বারবার আদালত বদল হয়েছে। ১৯৯৮ সালে আবার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু প্রভাবশালীদের চাপে বিচার প্রক্রিয়া স্বাভাবিক গতিতে এগোতে পারেনি। ২০১৫ সালে মামলাটির স্থগিতাদেশ খারিজের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট মামলাটি বিরতিহীনভাবে স্বল্প সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তির আদেশ দেন। বর্তমানে সুপ্রিম কোর্টে স্থগিত রয়েছে। ইতোমধ্যে হেমায়েত উদ্দিনসহ অধিকাংশ আসামির মৃত্যু হয়েছে। বেঁচে আছে ৬ আসামি।

যেভাবে খুন হন কমলেশসহ ৪ মুক্তিযোদ্ধা : তৎকালীন ছাত্রনেতা, মামলার বাদী ও জেলা কৃষক লীগ সভাপতি লুৎফর রহমার গঞ্জর দেয়া বিবরণ থেকে জানা যায়, ওই দিন মুক্তিযোদ্ধা ওয়ালিউর রহমান লেবু, কমলেশ বেদজ্ঞ, বিষ্ণুপদ কর্মকার, রামপ্রসাদ চক্রবর্তী মানিক ও লুৎফর রহমান গঞ্জর কোটালীপাড়া থেকে গোপালগঞ্জে আসার পথে টুপুরিয়ায় বেশ কয়েকজন আমাদের ওপর দা, নিড়ানি, ছেনি, শাবল, কোদাল নিয়ে হামলা চালায়। পৈশাচিক হামলায় চার নেতা ঘটনাস্থলে মারা যান। আমাকে মৃত ভেবে ফেলে রেখে যায়। এত বড় সত্য ঘটনার বিচারে এখন পর্যন্ত কোনো সাক্ষ্য আদালত নিতে পারেননি। গ্রামবাসী ৫ জন ডাকাতকে হত্যা করেছে- গোপালগঞ্জ থানায় খুনিদের এমন রিপোর্টের পর পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে ৪ মুক্তিযোদ্ধার মরদেহ দেখতে পায়। লুৎফর রহমান গঞ্জরকে সদর হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করা হয়। হত্যাকাণ্ডের দুদিন পর মারাত্মক আহত লুৎফর রহমান গঞ্জর মৃত্যুকালীন জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে তিনি হেমায়েত উদ্দিন ও তার সঙ্গীদের পৈশাচিকতার বিবরণ তুলে ধরেন।

কন্যার চোখে পিতা : কমরেড কমলেশ হত্যাকাণ্ডের সময় মেয়ে সুতপা বেদজ্ঞের বয়স ছিল মাত্র আড়াই। পিতার তেমন কোনো স্মৃতি না থাকলেও বেড়ে ওঠেছেন এক ভয়ার্ত পরিবেশে। কমলেশ হত্যাকাণ্ডের পর ভয়ে কোটালিপাড়া ছেড়ে গোপালগঞ্জে থাকতে হয় তার পরিবারকে। সেখানে ছিল নানারকম হুমকি। মুক্তিযুদ্ধে বাবার দুঃসাহসিক যুদ্ধের কথা শুনেছেন সহযোদ্ধাদের কাছে ও মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দলিল-গ্রন্থ থেকে। স্বাধীন দেশে এই দুঃসাহসিক যোদ্ধার নির্মম খুনের ব্যাপারে সুতপা বলেন, জুন মাসে আগৈলঝরা যুদ্ধে হেমায়েত উদ্দিন আহত হওয়ার পর বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন বাবা। ভারতীয় নৌবাহিনীতে চাকরির সুবাদে উচ্চতর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাবা যুদ্ধের কৌশল ভালো জানতেন। স্বাধীনতার পর তিনি জনসেবায় ও দেশ পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করেন। ওই সময় সেভ দ্য চিলড্রেনে চাকরির সুবাদে সার্বক্ষণিক মানুষের পাশে ছিলেন। ১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচনে ফরিদপুর ১১ আসনে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থনে নির্বাচনে অংশ নেন বাবা। যুদ্ধকালীন রাজাকার ক্যাম্পের পতন ঘটিয়ে প্রাপ্ত সম্পদ, মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতে চলে যাওয়া শরণার্থীদের অনেক সম্পদ হেমায়েতের কাছে রাখা হয়েছিল। বাবার ডায়েরিতে মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘটনার বর্ণনা ছিল এবং ওই সম্পদের তালিকা ছিল। যুদ্ধের পর সেসব সম্পদ ফিরিয়ে দেয়ার জন্য বাবা বারবার অনুরোধ করেছেন। কিন্তু হেমায়েত উদ্দিন রাজি হয়নি। সম্পদ জনগণের কাছে ফিরিয়ে না দিলে প্রাপ্ত সম্পদের তালিকা জনগণের কাছে প্রকাশ করার চ্যালেঞ্জ করেন বাবা। তাকে হত্যার পেছনে এটিই বড় কারণ বলে আমাদের মনে হয়। সুতপা বলেন, বাবার হত্যার বিচার চেয়ে আইনের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন আমার দাদু কার্তিক বেদজ্ঞ। স্বামী হত্যার বিচার পাননি আমার মা প্রয়াত উমা দেবী। আমিও জীবদ্দশায় এই বিচারের রায় শুনতে পাব কিনা জানি না।

অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথার স্বীকৃতি পাননি কমলেশ বেদজ্ঞ। এ ব্যাপারে বাংলা একাডেমির উপপরিচালক, ‘মুক্তিযুদ্ধে গোপালগঞ্জ’ গ্রন্থের লেখক, ড. তপন বাগচী ভোরের কাগজকে বলেন, গোপালগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধে হেমায়েত বাহিনীর ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি। এই বাহিনীর সেকেন্ড ইন কমান্ড ছিলেন কমলেশ বেদজ্ঞ। মূল দায়িত্ব পালন করেছেন কমরেড কমলেশই। প্রতিটি প্রতিরোধযুদ্ধেই তিনি সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। মূল পরিকল্পনা প্রণয়ন, আক্রমণের ছক তৈরিসহ যাবতীয় নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, স্বাধীন দেশে কমলেশ বেদজ্ঞ, ওয়ালিউর রহমান লেবু, বিষ্ণুপদ ও মানিককে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সেই খুনের আসামি ছিলেন তারই দলপ্রধান। খুনের দায় মাথায় নিয়ে হেমায়েতও আজ প্রয়াত। আমি কমলেশ বেদজ্ঞকে মরণোত্তর বীরবিক্রম উপাধি প্রদানের দাবি জানাই।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App