×

জাতীয়

যুদ্ধ শেষ হয়নি হাসানের

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২০, ০৯:৪৫ এএম

যুদ্ধ শেষ হয়নি হাসানের

এম এ হাসান

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাঠকক্ষ থেকে রক্ত উপত্যকা বাংলাদেশের রণাঙ্গন। সেক্টর-৩ এর কমান্ডার মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহর অধীনে একের পর যুদ্ধ বিজয়ের সাফল্যগাথা। একাধিক সম্মুখ যুদ্ধে জয়ী হয়ে ছিনিয়ে নিয়েছেন পাকিস্তানি সেনাদের ট্যাঙ্ক ও অস্ত্র। যুদ্ধে বাম পায়ে পচন ধরেছিল তার। তবুও হার মানেননি। নেতৃত্ব দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আখাউড়া যুদ্ধে। লে. বদিউজ্জামানসহ ১৬ জন সহযোদ্ধা হারিয়েও বিজয় এনেছেন। স্বাধীন দেশেও তার যুদ্ধ শেষ হয়নি। বিজয়ের অর্ধ শতাব্দীতেও দাঁড়িয়ে লড়াই করছেন রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের বিচারে। গণহত্যাসহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছেন দেশে-বিদেশে।

তিনি লে. ডা. আনিস (এম এ হাসান)। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান। মুক্তিযুদ্ধে তিনি ও তার বড় ভাই লে. সেলিমের সাহসিকতার প্রশংসা করে আন্তর্জাতিক মিডিয়া এবিসি টেলিভিশন ২ ভাইকে নিয়ে ডকুমেন্টরি তৈরি করেছিল। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য ২ ভাইকেই ‘বীর প্রতীক’ খেতাব দিয়ে গেজেট প্রকাশ করেছিল বাংলাদেশ সরকার। তবে পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তাদের ২ ভাইয়ের নাম মুছে ফেলা হয়েছে।

জানতে চাইলে ডা. এম এ হাসান ভোরের কাগজকে বলেন, ১৯৭৩ সালে পত্রিকায় প্রকাশিত সরকারি গেজেটে আমার ভাই লে. সেলিম ও আমার নাম ঠাঁই পেয়েছিল সম্মানসূচক বীরপ্রতীক হিসেবে। সেনাবাহিনীর কাগজে-কলমেও আমাদের নাম ছিল বীরপ্রতীক হিসেবে। সেনাবাহিনীর সার্টিফিকেটও রয়েছে। কিন্তু পরে আমাদের নামগুলো মুছে ফেলা হয়। এজন্য এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকারকেই দায়ী করেছেন তিনি। বললেন, লে. সেলিম রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও আমি লে. আনিস ঢাকা মেডিকেল উল্লেখ ছিল। পরে এয়ার ভাইস মার্শাল এ কে খন্দকার ও মঈনুল হোসেন মিলে তদ্বিরের কারণে তড়িঘড়ি করে আমাদের নাম বাদ দিয়েছে। খেতাব দেয়ার পুরো প্রক্রিয়ায় অনেক গ্যাপ, তদ্বির ছিল।

মেডিকেলের পাঠকক্ষ থেকে রণাঙ্গনের মাঠ : ডেডলাইন একাত্তরের ২৫ মার্চ। অপরারেশন সার্চ লাইটের নামে ঘুমন্ত বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রক্ত লোলুপ পাকিস্তানি হায়েনারা। মৃত্যুদূত জলপাই ট্যাঙ্কের সামনেই বড় ভাই সেলিমের সঙ্গে পাকিস্তান সার্ভে অফিস, তেজগাঁ পলিটেকনিকেল ইনস্টিটিউট, সাতরাস্তার মোড় এবং সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরের সামনে শত্রু মোকাবিলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন আনিস। ৩১ মার্চ ২ ভাই যোগ দেন দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। ক্যাপ্টেন মতিনের অধীনে ২ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে প্রতিরোধ যুদ্ধে জয়ী হন। ১৪ এপ্রিল লালপুরে সম্মুখ সমরে প্লাটুন কমান্ডার লে. সেলিমের অধীনে যুদ্ধ করেন। বড় ভাইয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা হিসেবে একে একে শাহাবাজপুর, শমশেরনগর, নাসিরনগর, তেলিয়াপাড়া যুদ্ধে জয়ী হন। তেলিয়াপাড়ায় মাইলস্টোন ৮৪ ও মাইলস্টোন ৮৬ তে হেলাল মুর্শেদের সঙ্গে সারা রাস্তা মাইন পুঁতে অপেক্ষা করেন ২৫ বেলুচ রেজিমেন্টের দুর্ধর্ষ হানাদারদের জন্য। হায়েনাদের প্রথম গাড়িটি অবিকৃতভাবে চলে গেলে হতাশ হলেও ২০ থেকে ২৫ জন সেনাসহ দ্বিতীয় গাড়িটি উড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। কিন্তু ওই গাড়ির বেঁচে যাওয়া সৈন্য ও প্রথম গাড়িটি ফিরে আসায় বিপদে পড়েন তিনি। মাইন বিস্ফোরণের বিকট শব্দে কানে সমস্যা হওয়ায় হেলাল মুর্শেদের ফিরে যাওয়ার সংকেত শুনতে না পেয়ে একাই লড়েন পাকিদের বিরুদ্ধে। ৩ দিক থেকে ঘিরে ফেলা শত্রুদের হাত থেকে বাঁচতে নালায় ঝাঁপিয়ে পড়ে আরো বিপদে পড়েন। শত্রুদের লুকায়িত বাঁশের ফাঁদে আটকে যায় বাম পা। সামনে সাক্ষাৎ মৃত্যু পাকিস্তানিরা। কোমরে থাকা ৫টি গ্রেনেড ছুঁড়ে নালা থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে নদীতে পড়েন। সে যাত্রায় বেঁচে ক্যাম্পে ফিরে দেখেন তার জন্য মিলাদ ও দোয়া পড়ছেন কে এম সফিউল্লাহ। কিন্তু বাম পায়ে তার পচন ধরে ও মেরুদণ্ডের ১০ নম্বর হাড়টি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে বাগডোগড়া হাসপাতালে চিকিৎসা করা হয়।

মে মাসে তেলিয়াপাড়ায় আজাদ কাশ্মির রেজিমেন্টের পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে সামনে ছিলেন একটি সাব মেশিনগান নিয়ে ডা. হাসান ও লাইট মেশিনগান নিয়ে সুবেদার ইসমাইল। ক্যাপ্টেন মতিন ও সেলিম পেছন থেকে তাদের সহযোগিতা করছিলেন। যুদ্ধে শহীদ হন সুবেদার ইসমাইল। অসম সাহসিকতায় খানসেনাদের পরাজিত করে একটি ট্রাক দখল করেন ও ওদের অস্ত্র কেড়ে নেন ডা. হাসান ও তার সঙ্গী যোদ্ধারা।

আখাউড়া যুদ্ধে ডা. হাসানকে নেতৃত্ব নেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয় ২৮ নভেম্বর রাতে। ২৯ নভেম্বর ত্রিপুরা থেকে পায়ে হেঁটে শত্রু অঞ্চলে ৬ মাইল ভেতরে গর্ত করে আস্তানা তৈরি করেন। সঙ্গে অস্ত্র-গোলাবারুদ ও ভারতীয় বাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগের জন্য একটি ওয়ারলেস। ৩০ নভেম্বর থেকে ১ ডিসেম্বর আখাউড়ার উত্তর সীমান্তবর্তী আজমপুর ও রাজাপুর এলাকায় পাক বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ হয়। ৩ ডিসেম্বর রাতে মুক্তিবাহিনী আজমপুরে শক্ত অবস্থান নিলে সেখানেও অবিরাম যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে পাকহানাদার বাহিনীর প্রায় ৩০ সেনার মৃত্যু হয়। ওদের দুটি ট্যাঙ্ক বিধ্বস্ত করা হয়। অন্যদিকে ৪ ডিসেম্বর আজমপুরে পাক বাহিনীর মর্টারশেলের আঘাতে শহীদ হন সহযোদ্ধা লে. ইবনে ফজল বদিউজ্জামান। ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী সম্মিলিতভাবে আখাউড়া আক্রমণ করেন। ৫ ডিসেম্বর তুমুল যুদ্ধের পর ৬ ডিসেম্বর সকালেই আখাউড়া সম্পূর্ণভাবে শত্রু মুক্ত হয়। পরে আখাউড়া ডাকঘরের সামনে লাল-সবুজ পতাকা উত্তোলন করেন পূর্বাঞ্চলীয় রণাঙ্গনের প্রধান জহুর আহাম্মদ চৌধুরী।

যুদ্ধ শেষ হয়নি অর্ধ শতকেও : যুদ্ধের পঞ্চাশ বছর পরও রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার জন্য যুদ্ধ করছেন ডা. এম এ হাসান। নারী মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতি, গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, গণকবরগুলো সংরক্ষণ করা, বিস্মৃতির আড়ালে হারিয়ে যাওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে খুঁজে জাতির সামনে তুলে ধরাসহ মুক্তিযুদ্ধের নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গবেষণা করছেন তিনি। হেগে আন্তর্জাতিক আদালতে কাজ করা বিশে^র দুইশজন বিশিষ্ট ব্যক্তির একজন ডা. এম এ হাসান। ১৯৮৬ সাল থেকে ফরেনসিক বিভাগে গণকবরের মাথার খুলি ও হাড়গোড় নিয়ে গবেষণা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণার জন্য ২০১৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। তবে ঘোষণার পর ‘বীরপ্রতীক’ খেতাব কেড়ে নেয়ার যন্ত্রণা তাকে বিদ্ধ করে প্রতিমুহূর্তে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App