×

জাতীয়

সাজেকের ‘প্রিয়া’ পড়তে চায় অস্ট্রেলিয়ায়

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ ডিসেম্বর ২০২০, ০১:১৫ পিএম

সাজেকের ‘প্রিয়া’ পড়তে চায় অস্ট্রেলিয়ায়

সাজেকে চা বিক্রি করে প্রিয়া

কাছ থেকে দেখা যাচ্ছে সূর্যটা উঁচু পাহাড়ের আড়ালে ডুবে যাচ্ছে। সূর্য ডোবার এই অপরূপ দৃশ্যটি দেখতে কার না ইচ্ছে জাগে। যেমনটা আগ্রহ থাকে সকালে গায়ে গরম কাপড় মুড়িয়ে পূর্ব দিগন্তে চেয়ে থাকার, কখন পাহাড়ের মধ্যে থেকে কুয়াশার বুক চিরে বেরিয়ে আসবে সকালের রাঙা সূর্য। মধ্যদুপুরে সেই সূর্যটাই যখন পূর্ণ যৌবনে পা রাখবে ততক্ষণে আগন্তুকরা ক্যামেরা হাতে অপেক্ষমান থাকবেন দূরাকাশের সেই অগ্নিগোলকটাকে ফ্রেমবন্দি করতে।

এই দৃশ্যগুলো খুব কাছ থেকে দেখেও যেন স্বপ্নের মতো লাগে। তাইতো দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে আসে মেঘ-পাহাড়ের রাজ্য বাংলাদেশের ভূস্বর্গ খ্যাত সাজেক ভ্যালিতে। আকাশের নীল যেন এখানে এসে ছুঁয়েছে দিগন্ত। যতদূর দৃষ্টি যায়, ছোট-বড় সবুজ পাহাড়। উপর থেকে দৃষ্টি মেললে যেন সবুজ সমুদ্রের ঢেউ। একটি থেকে আরেকটি পাহাড়ের মাঝে যেন আটকে আছে সাদা মেঘের ভেলা। প্রকৃতির রাজ্যে সাজেকের কংলাক হচ্ছে সর্বোচ্চ চূড়া। কংলাকের পথে অনেকটা অংশজুড়ে একটি হেলিপ্যাড। সন্ধ্যায় সূর্যাস্ত দেখতে জড়ো হয়েছেন হাজারও দর্শনার্থী। সবার চোখ সেই অস্তগামী সূর্যের দিকে। পশ্চিম আকাশে হেলে পড়া সূর্যটা পাহাড়ের ঘন সবুজ অরণ্যের গভীরে যেন ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যার অন্ধকার নামতে না নামতেই মেয়েটির চায়ের দোকানে ভিড় জমেছে। অনেকেই বাঁশের টিউবের চা খেতে খেতে সূর্যাস্তের অপূর্ব দৃশ্য কাছ থেকে দেখছেন।

চা কারিগর মেয়েটির পরনে সালোয়ার-কামিজ। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে একটি মোটা কাপড়ের শার্টও গায়ে তার। হেলিপ্যাডের ওপর অনেকগুলো দোকান। পাহাড়িরা ছোট ছোট টেবিলের উপর বিভিন্ন ধরনের সতেজ খাবার সাজিয়ে বসে আছেন। কলা, আনারস, পেঁপে, আখ, জাম্বুরা বিক্রি করছেন। কেউ কেউ তৈলাক্ত খাবার বানাচ্ছেন। মেয়েটি শুধু বাঁশের টিউবে করে চা-সিগারেট আর বিভিন্ন ধরনের চকলেট বিক্রি করছে।

বাঁশের টিউবে চা খাওয়ার খুব ইচ্ছা জাগলো আমার। কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। মেয়েটির নামটা জানতে দেরি হলো না। অনেকেই তাকে ‘প্রিয়া’ বলে ডেকে চা সিগারেট নিচ্ছে। আমিও ‘প্রিয়া’ বলে ডাক দিয়ে এক টিউব চা দিতে বললাম। অপরিচিত গলায় ‘প্রিয়া’ ডাক শুনে মেয়েটি কিছুক্ষণ তাকিয়ে হাতে এক টিউব চা তুলে দিলো। এরইমধ্যে আমাদের ভ্রমণসঙ্গী কয়েকজন এসে সেখানে হাজির। একে একে সবাই চুমুক দিলো প্রিয়ার সেই টিউব চায়ে।

দু-এক কথাতেই মনে হলো মেয়েটি খুব মিষ্টভাষী। চা বানানোর ফাঁকে যে কারও সঙ্গে সে গল্প করে। অনায়াস ভঙ্গিতে কথার জবাব দেয়। দোকানের সামনে দুটি চেয়ার আর নিজে বসে আছে আরেকটি চেয়ারে। কখনও কখনও চেয়ার থেকে ওঠে অন্যকে বসতে দিচ্ছে। মেয়েটির সুন্দর ও সাবলীল স্বভাবের কারণে কাস্টমারাও একটু স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ফলে প্রিয়ার দোকানের সামনে রাখা চেয়ার দুটি কখনোই ফাঁকা থাকে না।

চা খেতে খেতে আড্ডা জমলো মেয়েটির সাথে। চা বানানোর ফাঁকে কথা হলো পাহাড়ে তাদের সংগ্রামী জীবন নিয়ে। আমাদের চোখে তাদের জীবন কষ্টের হলেও মেয়েটির চোখ-মুখ বলে দিচ্ছে সুখেই কাটছে তাদের জীবন। কথা হলো পরিবার, পড়ালেখা ও পাহাড়ি আদিবাসীদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তনের নানা বিষয় নিয়ে।

কথাতেই আঁচ করা গেল, প্রিয়া বেশ মেধাবী মেয়ে। বাবা-মা আর ছোট ভাই নিয়ে চার সদস্যের পরিবার তাদের। বাবা-মা পাহাড়েই বিভিন্ন ধরনের কৃষিকাজ করে। আবার বাবা বিকেলে হেলিপ্যাডে কলা-আনারস বিক্রি করেন। তার মা-ও হেলিপ্যাডে চা বিক্রি করেন। মায়ের সেই দোকানটিতেই পড়ালেখার ফাঁকে সাহায্য করেন প্রিয়া। গড়ে ৮০-১০০ টিউব চা ও সিগারেট মিলিয়ে রোজ গড়ে ওই দোকানে তিন হাজার টাকা বেচাবিক্রি হয়। যার মাধ্যমে শুধু প্রিয়ার মায়ের দোকান থেকেই মাসে আয় হয় প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা।

প্রিয়া সাজেকের একটি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পাস করেছে। মাত্র ১২ পয়েন্টের জন্য হাতছাড়া হয়েছে জিপিএ ফাইভ। বর্তমানে রাঙামাটি জেলার একটি কলেজে দ্বাদশ শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ছেন। সে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে অথবা দেশের বাহিরে অস্টেলিয়ায় পড়ালেখার স্বপ্ন দেখে। কথা বলে জানা গেছে, অস্ট্রেলিয়ায় তার স্বজনদেরও কেউ কেউ পড়ালেখা করছেন।

সময়ের পালাক্রমে ‘রাঙামাটির ছাদ’ খ্যাত এই সাজেকে উন্নয়নের ছোঁয়ায় এসেছে নানা পরিবর্তন। দেশ-বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা সৌন্দর্য পিপাসু দর্শনার্থীদের প্রতিদিনের পদচারণায় পাহাড়ি এ উপজাতি জনগোষ্ঠীর মধ্যে লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। একটা সময় তিন বেলা খাবার না জুটলেও তাদের অনেকেরেই স্বপ্ন এখন আকাশছোঁয়া। বাবা-মায়ের ভাগ্যে পড়ালেখা না জুটলেও তাদের অনেকে দেশের বড় ও নামি প্রতিষ্ঠানে সন্তানদের পড়ানোর স্বপ্ন দেখেন। তাদের কেউ কেউ উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য ছেলে-মেয়েদের বিদেশেও পাঠান। সর্বোপরি সবুজ ঘেরা ওই উঁচু পাহাড়ের মানুষগুলো সমতলের চেয়ে শুধু উঁচুতেই বাস করে না, তাদের স্বপ্নগুলোও ঠিক ততোধিক উঁচু।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App