×

জাতীয়

‘বীরশ্রেষ্ঠ’র অপেক্ষায় অর্ধশতক

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ ডিসেম্বর ২০২০, ১২:৫১ পিএম

‘বীরশ্রেষ্ঠ’র অপেক্ষায় অর্ধশতক

শহীদ জগৎজ্যোতি দাস

‘আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন।’ মহান একাত্তরে ভাসমান ভীমের মতোই যুদ্ধের রসদ বোঝাই পাকিস্তানি নৌযানগুলো ভরাডুবি করে অকাল বৈশাখির ঝড় তুলতেন পাকি শিবিরে। চিরদুর্দম, দুর্বিনীত, মহাপ্রলয়ের নটরাজ নৃত্য কাঁপন ধরাত খানসেনাদের মনে। ক্ষুব্ধ-বিক্ষুব্ধ খানসেনারা এই মহাবিদ্রোহীকে ফাঁদে ফেলে হত্যা করতে তৈরি করে চক্রব্যূহ। নিজের অজান্তেই চক্রব্যূহে প্রবেশ করেন বাংলার অভিমন্যু। অস্ত্রেশস্ত্রে সুসজ্জিত হানাদার বাহিনীর বিশাল বহরের সঙ্গে যুদ্ধের একপর্যায়ে সঙ্গীদের নিরাপদ স্থানে পাঠানোর নির্দেশ দিয়ে একাই লড়াই করে নির্মমভাবে প্রাণ বিসর্জন দেন। জন্মের ঋণ শোধ করেন বুকের তাজা রক্তে।

একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের ত্রাস আর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণার নাম জগৎজ্যোতি দাস। মুক্তিযুদ্ধে ভাটি বাংলার গেরিলা বাহিনীর কমান্ডার হাওরপুত্র জগৎজ্যোতি মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে তৈরি করেছিলেন ফায়ারিং স্কোয়াড ‘দাসপার্টি’। তার ‘দাসপার্টি’ মূর্তিমান আতঙ্ক ছিল হানাদারদের কাছে। জগৎজ্যোতির মুখোমুখি হওয়া মানে পাকিস্তানিদের নিশ্চিত পরাজয়। উত্তর-পূর্ব রণাঙ্গনে মুক্তিসেনাদের কাছে ছিলেন প্রেরণার রসদ। মৃত্যুর সময়ও তিনি রেখে যান ওই প্রেরণার উৎস। দেশের জন্য তার আত্মোৎসর্গের পর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে মুজিবনগর সরকারের ঘোষণা ছিল, ‘স্বাধীন বাংলাদেশে কেউ যদি সর্বোচ্চ মরণোত্তর খেতাব পান, তবে তার প্রথম দাবিদার জগৎজ্যোতি দাস।’ এ ঘোষণা অল ইন্ডিয়া রেডিওতেও প্রচার হয়। কিন্তু প্রতিশ্রুত সে খেতাব আজো মেলেনি জগৎজ্যোতির। বিজয়ের পর ১৯৭৩ সালের গেজেটে ‘বীরবিক্রম’ খেতাব দেয়া হয় হাওরপুত্রকে। কিন্তু ঘোষণা দিয়েও কেন জগৎজ্যোতিকে মরণোত্তর সর্বোচ্চ খেতাব ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ সম্মানে ভূষিত করা হয়নি- বিজয়ের অর্ধশতকে এসে এই প্রশ্ন সহযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষকদের। জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির ভোরের কাগজকে বলেন, খেতাব নিয়ে অনেক রাজনীতি হয়েছে। অনেক স্বজনপ্রীতি, পক্ষপাতিত্ব হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম এ জি ওসমানী এই দায়িত্বে ছিলেন। তিনি কেন তার দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করেননি, তাকে এই প্রশ্ন করা উচিত ছিল।

তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ জনগণের অসাধারণ বীরত্বকে অস্বীকার করা হয়েছে। সামরিক বাহিনীর ছাড়া কাউকে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব দেয়া হয়নি। অন্যদিকে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কহীন পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু ব্যক্তিকে খেতাব দিয়েছেন। এতে মুক্তিযুদ্ধের অবমাননা হয়েছে।

জ্যোতির আলোয় আলোকিত একাত্তর : বিকাল শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু সন্ধ্যা নামেনি মফস্বল শহরে। যুদ্ধের দামামার রং আকাশজুড়ে। এরই মধ্যে ঈদের বাজার। ডেটলাইন ১৬ নভেম্বর, একাত্তর। ১৩টি সফল অভিযানের নায়ক জগৎজ্যোতি তখন যুদ্ধ মাঠের কিংবদন্তি। তার একের পর এক সাফল্যে তাকে যে কোনো মূল্যে পরাজিত করার ফন্দি করে হানাদাররা। মৃত্যুঞ্জয়ী জগৎজ্যোতি জানতেন না এই অভিযানই তার শেষ অভিযান। জগৎজ্যোতি ও তার দাসপার্টির সঙ্গীদের লক্ষ্যস্থল ছিল হবিগঞ্জের বাহুবল। কিন্তু লক্ষ্যস্থলে যাওয়ার আগেই বদলপুর নামক স্থানে হানাদারদের কূটকৌশলের ফাঁদে পা দেন জগৎজ্যোতি। বদলপুরে ৩/৪ জন রাজাকার ব্যবসায়ীদের নৌকা আটক করে চাঁদা আদায় করছিল। দেখতে পেয়ে ক্ষুব্ধ জ্যোতি নির্দেশ দেন রাজাকারদের ধরে আনার। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের দেখেই পিছু হটতে থাকে কৌশলী রাজাকাররা। সঙ্গী ১০-১২ জন মুক্তিযোদ্ধা আর সামান্য গোলাবারুদ নিয়ে তাড়া করেন। অদূরেই কুচক্রী পাকসেনারা বিশাল বহর আর প্রচুর গোলাবারুদ নিয়ে অপেক্ষা করছিল জ্যোতিকে ধরতে। বর্তমানে শাল্লা উপজেলা সদর ঘুঙ্গিয়ারগাঁও পাকিস্তানি ক্যাম্প থেকে মাত্র ২০০ গজ দূরে রাজাকার আর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে জ্যোতির ‘দাসপার্টি’। গুলি ছোড়া হয় হেলিকপ্টার থেকেও। ভয়াবহতা চিন্তা করে জ্যোতি তার দলকে বাঁচানোর জন্য রিট্রিট করার নির্দেশ দিয়ে মাত্র একটি এলএমজি নিয়ে নিজে কাভারিং ফায়ার দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যান মাত্র দুজনÑ জ্যোতি ও ইলিয়াস। টানা যুদ্ধের একপর্যায়ে পাঁজরে গুলিবিদ্ধ হন সহযোদ্ধা ইলিয়াস। জ্যোতি পিছু না হটে তার মাথার লাল পাগড়ি খুলে শক্ত করে ইলিয়াসের বুকে এবং পিঠে বেঁধে দেন, যাতে তার রক্তক্ষরণ থেমে যায়। বিকালে নতুন ম্যাগজিন লোড করে পজিশন নিয়ে শত্রুর অবস্থান দেখার জন্য মাথা উঁচু করতেই একটি বুলেট চোখে বিদ্ধ হয়। রণক্লান্ত বিদ্রোহীর শেষ চিৎকার ‘আমি যাইগ্যা।’

ইলিয়াস তার প্রিয় কমান্ডার জ্যোতির তেজোময় দেহ কাদা পানিতে সমাহিত করলেও রাজাকাররা খুঁজে বের করে ক্যাম্পে নিয়ে যায়। মৃত জ্যোতিকেও রেহাই দেয়নি রক্তলোলুপ হায়েনারা। নির্জীব দেহের ওপর চালায় পৈশাচিক নির্যাতন। পরদিন আজমিরীগঞ্জের বিভিন্ন ঘাটে নৌকা ভিড়িয়ে জ্যোতির প্রাণহীন দেহ দেখিয়ে ভীতির সঞ্চার করে। জ্যোতির স্পন্দনহীন শরীরে থুথু ফেলে। তার গায়ে পেরেক বিদ্ধ করে সেই ছবি খবরে ছাপানো হয়। ঈদের বাজারে প্রকাশ্যে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে ক্ষত-বিক্ষত করা হয় তার লাশকে। জগৎজ্যোতির মা-বাবাকেও ধরে আনা হয় বীভৎস লাশ দেখাতে। এরপর ক্ষত-বিক্ষত লাশ ভাসিয়ে দেয়া হয় ভেড়ামোহনার জলে। জ¦ালিয়ে দেয়া হয় জগৎজ্যোতির বাড়িঘর। জগৎজ্যোতির রুমমেট, বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এ হান্নান ভোরের কাগজকে বলেন, জ্যোতির যুদ্ধের কলাকৌশলে ছিল প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত। জ্যোতির বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবের জন্য স্থানীয়ভাবে আমরা সোচ্চার ছিলাম কিন্তু আমাদের সাব-সেক্টর কমান্ডার মুসলেহউদ্দিন হয়তো তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেননি। অন্যদিকে জ্যোতির হতদরিদ্র পরিবার রাষ্ট্রীয় এই মর্যাদাকে অনুধাবন করতে পারেননি। পরিবার থেকে কোনো আবেদন জানানো হয়নি। সুনামগঞ্জে জগৎজ্যোতির একটি ভাস্কর্য তৈরির পরিকল্পনা চলছে বলে জানান তিনি।

শুধু বদলপুর যুদ্ধই নয়, একাত্তরে দেশমাতৃকার জন্য আগুন হয়ে জ্বলেছিলেন হবিগঞ্জের জলসুখা গ্রামের দরিদ্র রাজমিস্ত্রি পরিবারের এই দামাল তরুণ। টেকেরঘাট সাবসেক্টরের অধীনে বিস্তীর্ণ ভাটি অঞ্চল শত্রুমুক্ত রাখার দায়িত্ব পড়েছিল তার ওপর। দিরাই, শাল্লা, ছাতক, আজমিরীগঞ্জ, বানিয়াচং, জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার নৌপথ পাক দখলমুক্ত রাখার যুদ্ধে প্রাণবাজি রেখে লড়ে যান দাসপার্টির গেরিলা যোদ্ধারা। শুধু তার সাহসী অভিযানের কারণে পাকিস্তান সরকার রেডিওতে ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়, ‘এই রুট দিয়ে চলাচলকারী ব্যক্তিদের জানমালের দায়িত্ব সরকার নেবে না’। মাত্র ১৩ জন সহযোদ্ধা নিয়ে বানিয়াচংয়ে পাকবাহিনীর ২৫০ সেনা ও দোসরদের অগ্রগতি রোধ করে দেন, যুদ্ধে প্রাণ হারায় পাকবাহিনীর ৩৫ জল্লাদ। মাত্র ১০-১২ জন সহযোদ্ধা নিয়ে তিনি মুক্ত করেন শ্রীপুর। খালিয়াজুড়ি থানায় ধ্বংস করে দেন শত্রুদের বার্জ। আগস্ট মাসে কোনো গুলি করা ছাড়াই দিরাই-শাল্লায় অভিযান চালিয়ে কৌশলে আটক করেন ১০ সদস্যের রাজাকারের দলকে। রানীগঞ্জ ও কাদিরগঞ্জে অভিযান চালিয়েও জ্যোতি আটক করেন পাক হায়েনাদের দোসর রাজাকারদের। ২৯ জুলাই বৃহস্পতিবার জামালগঞ্জ থানা ও নৌবন্দর সাচনাবাজার শত্রুমুক্ত করে আলোচনার শীর্ষে চলে আসেন জগৎজ্যোতি। ১৭ আগস্ট পাহাড়পুরে কমান্ডার জগৎজ্যোতির রণকৌশল আর বীরত্বে রক্ষা পায় অসংখ্য নিরীহ মানুষ। একা হাতে একটি এলএমজি নিয়ে দখল করে নেন রাজাকারবেষ্টিত জামালপুর থানা। জগৎজ্যোতির বীরত্বগাঁথা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের গবেষক হাসান মুর্শেদ ভোরের কাগজকে বলেন, দাসপার্টির মূল মিশন ছিল ঢাকা থেকে নৌপথে সিলেট অঞ্চলে আসা রসদ বোঝাই নৌযানগুলো ডুবিয়ে দেয়া। দাসপার্টির আতঙ্কে নৌপথ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয় পাকি সেনারা।

কেউ কথা রাখে না : হবিগঞ্জে আজমিরীগঞ্জ উপজেলার জলসুখা গ্রামে জীতেন্দ্র দাসের ছোট সন্তান জগৎজ্যোতির জন্ম ১৯৪৯ সালে। একাত্তরে ভারতের মেঘালয়ে প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযুদ্ধের ৫ নং সেক্টরের টেকেরঘাট সাবসেক্টর কমান্ডার সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের অধীনে প্রথমে বিভিন্ন আক্রমণে অংশ নেন জ্যোতি। ইংরেজি, হিন্দি, গৌহাটির আঞ্চলিক ভাষায় পারদর্শী জ্যোতির নেতৃত্বে প্রশিক্ষিত যোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত হয় গেরিলা ফায়ারিং স্কোয়াড ‘দাসপার্টি’।

জগৎজ্যোতির বীরত্বগাথা আত্মত্যাগের সংবাদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, অল ইন্ডিয়া রেডিওসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশিত হতো। তার অসীম সাহসিকতার প্রতি সম্মান জানিয়ে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার তাকে মরণোত্তর সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব দেয়ার ঘোষণা দেয়Ñ যা ছিল মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে খেতাব দেয়ার প্রথম ঘোষণা। কিন্তু অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার ঘোষিত সম্মাননা আজো যুক্ত হয়নি তার নামের পাশে। জেনারেল ওসমানী, এয়ার ভাইস এ কে খন্দকারকে দায়ী করে গবেষক হাসান মুর্শেদ বলেন, জগৎজ্যোতিকে সর্বোচ্চ খেতাব দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু শুরু থেকেই মুক্তিযুদ্ধের সামরিক ইতিহাস তৈরি করাই মূল লক্ষ্য ছিল। জ্যোতি তো বেসামরিক বীর। জগৎজ্যোতির মতো অসংখ্য বীর তাদের প্রাপ্য সম্মান পাননি।

স্মৃতিতে জগৎজ্যোতি : আজমিরীগঞ্জে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে সহযোদ্ধাদের নির্মিত ‘শহীদ জগৎজ্যোতি’ নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। সুনামগঞ্জের সাবেক জেলা পাবলিক লাইব্রেরিকে ‘শহীদ জগৎজ্যোতি পাঠাগার’ নামে নামকরণ করা হয়েছে। কমিউনিস্ট কর্মী ও লেখিকা অঞ্জলি লাহিড়ীর উপন্যাস ‘জগৎজ্যোতি’ ও লেখক হাসান মোরশেদের ‘দাসপার্টির খোঁজে’ নামক মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বই বীর মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতিকে নিয়েই লেখা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App