×

জাতীয়

এপার-ওপার মিতালি!

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৪ ডিসেম্বর ২০২০, ১২:২৪ পিএম

এপার-ওপার মিতালি!

পদ্মা সেতু। ফাইল ছবি

পদ্মা সেতুর ৪০তম স্প্যান বসছে আজ ১০ ডিসেম্বর বসবে ৪১তম স্প্যান কাজ আর মাত্র ৮ থেকে ১০ ভাগ বাকি

সাতদিন আগে স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে সফলভাবে বসানো হয়েছে ৩৯তম স্প্যান। সেতুর মোট ৪১টি স্প্যানের মধ্যে এখন রইল বাকি দুই। সুখবর হচ্ছে- আজ শুক্রবার ৪০তম স্প্যানটি সেতুতে বসানো হবে। এরপর স্বপ্ন স্পর্শ করতে বাকি থাকবে আর মাত্র ১৫০ মিটার। কাছে বা দূর থেকে তাকালেই স্বপ্নের সেতুর পুরো অবয়ব এখন স্পষ্টভাবেই পুরোপুরি দৃশ্যমান। এগিয়ে চলছে রোড ও রেল স্লাব বসানোর কাজ। ইতোমধ্যেই সেতুতে স্থাপন করা স্প্যানগুলোতে কোনো সমস্যা আছে কিনা তাও পরীক্ষা-নীরিক্ষা ও পর্যবেক্ষণ চলছে। ফলে দেশবাসীর স্বপ্ন এখন একেবারেই সত্যি হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। সবদিক বিবেচনায় বলা যায়, সেতুর কাজ আর মাত্র ৮-১০ ভাগের মতো বাকি আছে। ২০২১ সালে পুরো কাজ শেষে স্বপ্নের সেতু সবার চলাচলের জন্য খুলে দেয়ার ব্যাপারে প্রকল্পের সবাই দৃঢ় ও আশাবাদী।

পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা এখন দেশের মানুষের স্বপ্ন বাস্তবায়নের অল্প দূরে অবস্থান করছি। টার্গেট অনুযায়ী, সব কাজ এগিয়ে চলছে। চলতি সপ্তাহে ৪০তম স্প্যানটি বসানোর প্রস্তুতি চলছে। এরপরই ১০ ডিসেম্বরের মধ্যেই ৪১তম স্প্যান সেতুতে বসানোর টার্গেট নিয়ে সব প্রস্তুতিও রয়েছে। এখানে গায়ের জোরে কাজ করার কোনো সুযোগ নেই।

তিনি বলেন, রেল সংযোগের ক্ষেত্রে সৃষ্ট সমস্যা নিরসনের কাজ চলছে। তবে আমরা এখনো সংশোধিত নকশা হাতে পাইনি। নকশা পেলেই ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে এতে মূল সেতু নির্মাণে কোনো সমস্যা হবে না। স্প্যান উঠানোর সঙ্গে সঙ্গে সড়ক স্লাব ও রেল স্লাব বসানোর কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। বর্ষা মৌসুম আসার আগেই মূল সেতুর কাজ শেষ করার টার্গেট নিয়ে আমরা ব্যস্ত সময় পার করছি। সরেজমিন দেখা গেছে, ঢাকা-মাওয়া সড়কের কুচিয়ামোড়া ব্রিজ পার হয়ে এগিয়ে গেলেই পদ্মা সেতু নির্মাণের মহাযজ্ঞ চোখে পড়ে। এরপর যতই সামনের দিকে যাওয়া যায় ততই সবকিছু আরো স্পষ্ট হয়। লৌহজংয়ের কুমারভোগ কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডসহ সেতুর প্রতিটি বিভাগে দেশি ও বিদেশি প্রকৌশলী, শত শত কর্মী নিরলসভাবে কাজ করছেন। দূর থেকে দেখলে মনে হয় সেতু তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু কাছে গেলেই দেখা যায় কর্মচাঞ্চল্য। রেল স্লাব ও সড়ক স্লাব একটার পর একটা নির্ধারিত স্থানে বসে যাচ্ছে। প্রকল্পের প্রকৌশলী ও কর্মীরা ইতোমধ্যেই শেষ স্প্যান ২টি পুরোপুরি প্রস্তুত করেছেন। ফিটিংস ও রং করানোর কাজ শেষে স্প্যান ২টি এখন ক্রেনে তুলে সেতুতে বসানোর অপেক্ষা। গত সপ্তাহেই মাওয়ার লৌহজংয়ের কুমারভোগ কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে ২টি স্প্যান ফিটিংসের কাজ শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে। ৪০ নম্বর স্প্যানটি মাওয়ার স্প্যান ফেব্রিকেশন ইয়ার্ডের ভেতর থেকে বাইরে এনে নদীর কাছাকাছি রাখা হয়েছে। আজ শুক্রবার সকালে স্প্যানটি মূল সেতুতে স্থাপন করার জন্য ক্রেনে তোলা হবে। আগামী ১০ ডিসেম্বরের মধ্যেই ৪০ ও ৪১ নম্বর স্প্যান বসানোর প্রস্তুতি চলছে। সবকিছু অনুকূলে থাকলে আগেও বসানোর সম্ভাবনা রয়েছে। এই ২টি স্প্যান মূল সেতুতে উঠলেই স্বপ্নের পদ্মা সেতু আর স্বপ্ন থাকবে না। দেশের মানুষ স্বপ্ন স্পর্শ করবে। আগে একটি স্প্যান সেতুতে বসাতে ১-২ মাস সময় লাগত। এখন দ্রুততার সঙ্গে সব স্প্যান উঠে যাচ্ছে। গত ১১ অক্টোবর থেকে ১২ নভেম্বরের মধ্যে ৬টি স্প্যান সেতুতে বসানো হয়েছে। বাকি ২টি স্প্যান ১০ ডিসেম্বরের মধ্যেই বসানোর টার্গেট নিয়েছেন প্রকৌশলীরা। শেষ স্প্যান ২টি উঠানোর প্রস্তুতিস্বরূপ নদীতে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নাব্যতা ফিরিয়ে আনা হচ্ছে ও সেখানে নৌ-কেন্দ্রিক নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। সেতুর ১১ ও ১২ নম্বর পিলারের কাছ দিয়ে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা ২টি ইঞ্জিন বোটের মাধ্যমে নজরদারি চালাচ্ছেন।

সেতুর সড়ক স্লাব বিভাগে দেখা গেছে, একের পর এক সড়কের স্লাবগুলো ক্রেনের সাহায্যে তুলে ২৪ চাকার লম্বা যানে বহন করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করা হচ্ছে। প্রকৌশলীদের তত্ত্বাবধানে সেখান থেকে তুলে নিয়ে ব্রিজের উপরে বসানো স্প্যানের উপর সংযোগ করা হচ্ছে। এই স্লাবের উপর নির্মিত সড়ক দিয়েই সব যানবাহন যাতায়াত করবে। স্লাবের ফাঁকে ফাঁকে স্টিলের ক্যাবল ও বড় বড় পাইপ ঢুকিয়ে একটির সঙ্গে অপরটির সংযোগ করা হচ্ছে। মাওয়া ও জাজিরা উভয় প্রান্তে ইতোমধ্যেই বসানো স্প্যানগুলোতে স্ল্যাব বসানোর কাজ চলছে। ১৮ কোটি মানুষের আকাক্সিক্ষত স্বপ্নের পদ্মা সেতুর সড়কের জন্য ২ হাজার ৯১৭টি রোডওয়ে স্ল্যাব লাগবে। এরই মধ্যে প্রায় ১৩০০টি স্লাব বসানো হয়েছে। এই বিভাগের কর্মী তারেক জানান, আগামী জুন মাসের মধ্যে সব স্প্যানে সড়ক স্লাব বসানোর কাজ শেষ হবে। স্প্যান সেতুতে বসানোর পর স্থাপন করতে বেশ কয়েকদিন লেগে যায়। এরপর থেকে সড়ক ও রেল স্লাব বসানোর দায়িত্বে থাকা কর্মীরা কাজ শুরু করে।

করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভারের মধ্যেই পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ ব্যাপক গতিতে এগিয়ে চলছে। প্রতিদিনই বসছে রেল স্লাব। ইউরোপের দেশ লুস্কেমবাগ থেকে আনা লোহার স্টিঙ্গার দিয়ে তৈরি রেল স্লাবের উপর রেললাইন নির্মাণ করা হবে। এই লাইন দিয়েই ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৭০ কিলোমিটার পথে ট্রেন চলাচল করবে। রেললাইন নির্মাণের জন্য সেতুতে ২ হাজার ৯৫৯টি রেলওয়ে স্ল্যাব বসানো হবে। এখানেও বেশ অগ্রগতি হয়েছে। ইতোমধ্যেই ১ হাজার ৯০০টির বেশি রেল স্ল্যাব মূল সেতুর স্প্যানে বসানো হয়েছে। দুই তলা সেতুর নিচ তলা দিয়েই রেল চলাচল করবে।

প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মোহাম্মদ আব্দুর কাদের জানান, এখন আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় টার্গেট অনুযায়ী স্প্যান সেতুতে বসানো হচ্ছে। ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে সেতুর ১১ ও ১২ নম্বর পিলারে ৪০তম স্প্যান-২-ই বসানোর পরিকল্পনা রয়েছে। বিজয় দিবসের আগেই মাওয়া প্রান্তে সেতুর ১২ ও ১৩ নম্বর পিলারে ৪১তম স্প্যান ‘২-এফ’ অর্থাৎ শেষ স্প্যানটি বসানো হবে। এজন্য সব প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। আবহাওয়া ভালো থাকলে, কুয়াশা না থাকলে এই ২টি স্প্যান বসানো হলেই আমরা আমাদের স্বপ্ন স্পর্শ করব। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করা আমাদেরও স্বপ্ন এবং একই সঙ্গে চ্যালেঞ্জ। আমরা সেতুর ৫ হাজার ৮৫০ মিটার দৃশ্যমান করতে সক্ষম হয়েছি। মূল সেতুর ৯০ শতাংশের বেশি কাজ শেষ হয়েছে। এছাড়া নদীশাসনের অগ্রগতি হয়েছে ৭৪ দশমিক ৫ শতাংশ।

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারে প্রথম স্প্যান বসানো হয়েছিল। প্রথম স্প্যান থেকে শুরু করে আজ ৩৯তম স্প্যান বসানো পর্যন্ত মধ্যবর্তী সময় ছিল ৩ বছর ১ মাস ২৮ দিন। ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে সেতুর ১১ ও ১২ নম্বর পিলারে ৪০তম স্প্যান (স্প্যান ২-ই) বসানোর পরিকল্পনা আছে প্রকৌশলীদের। চলতি বছরের বিজয় দিবসের আগেই মাওয়া প্রান্তে ৪১তম স্প্যানটি বসার কথা রয়েছে।

প্রসঙ্গত, চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি (এমবিইসি) মূল সেতুর নির্মাণকাজের দায়িত্বে রয়েছে। এছাড়া চীনের অপর প্রতিষ্ঠান সিনো হাইড্রো করপোরেশন নদীশাসনের কাজ করছে। বাংলাদেশের প্রকৌশলীদের সঙ্গে কয়েকশ চীনা কর্মী প্রকল্পের কাজের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App