×

সাময়িকী

সোনালী ডুমুর ও সেলিনা হোসেন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২০, ০৮:৫৮ পিএম

সোনালী ডুমুর ও সেলিনা হোসেন

দেশভাগ একটি অনিবার্য ঘটনা, ভারতবর্ষ বিভক্ত হওয়ার পেছনে মুষ্টিমেয় ধর্মান্ধ-সাম্প্রদায়িক মানুষের চিন্তা-চেতনা কাজ করেছে সরাসরি, যারা অন্য সম্প্রদায়কে সহ্য করতে পারেনি, ছোঁয়াছুঁয়ি-মেলামেশাকে বড় ঘৃণার চোখে দেখতো, মানুষ তারপরও মানুষকে সম্মান করে কিন্তু জাতিভেদের প্রকাষ্ঠে পড়ে মানুষ অমানুষে পরিণত হয়, দেশে শিক্ষিতের হার বাড়লেও ধর্মান্ধকে সমূলে উপড়ে ফেলা কঠিন হয়। ভারতবর্ষ বিভক্ত হওয়ার অনেক আগেই দেখা যায় দু’সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষ-হানাহানি-ঈর্ষাপরায়ণতা, কেউ কাউকে মানতে বা সইতে পারে না। বিংশ শতাব্দীজুড়েই জাতিগত দাঙ্গার উদ্ভব হয়, যার ফলে মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ভেঙে যায়, ছিচল্লিশে কলকাতায় দাঙ্গায় মানুষ ড্রেনে-ফুটপাতে মরে থাকে, কে বাঙালি কে অবাঙালি বা বিহারি তা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো হিন্দু-মুসলমান। হাজার বছর ধরে দু’সম্প্রদায় একে অপরের খুব কাছে থাকলেও কি এমন ঘটনা ঘটলো যে কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছে না, এর পেছনে ছিল ইংরেজ বেনিয়াদের কারসাজস, তারা লেজ গুটিয়ে লন্ডনে যাওয়ার পূর্বেই ভারতবর্ষের মানুষদের একটা ভিন্নতা বুঝিয়ে দিয়ে যায়, যাতে কেউ তাদের পথকে বাধা দিয়ে আটকাতে না পারে। কঠিন তাদের চিন্তা-ভাবনা-দর্শন, মানুষ তাদের পাতানো ফাঁদে পা দিয়ে ভাইয়ে-ভাইয়ে যুদ্ধ করে, ভাইয়ের মাথায় ভাই ত্রিশূল মারে, এর মধ্যে আছে সাম্প্রদায়িক ভাবাপন্ন কতিপয় মানুষের কাণ্ডজ্ঞানহীন বুদ্ধি, যারা ধর্মকে আশ্রয় করে নিজেদের আসনটি পাকাপোক্ত করতে চায়। দাঙ্গার যে ভয়াবহতা তা সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে সেলিনা হোসেনের ‘সোনালী ডুমুর’-এ, মানুষ কেন কাঁদে এবং তার কান্নার ভেতরে যে যন্ত্রণা তা স্পষ্ট হয় উপন্যসের আখ্যানে, চেনা মানুষও অচেনা হয়ে যায় সময়ের প্রেক্ষাপটে, তখন মানুষের অবয়ব খুলে আরেক মানুষে পরিণত হয়, যাকে চেনা যায় না, প্রতিনিয়ত মানুষের যে মুখোশ, খুলতে-খুলতে একসময় সে আর মানুষ থাকে না, হয়ে যায় জানোয়ার, তার ভেতরে মানুষের রক্তের নেশা জেগে ওঠে, রক্তপিপাসু মানুষকে কোন অর্থে মানুষ বলা যায়।

গিরগিটির মতো খোলস খুলে সে জানোয়ার ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরন্ন-নিঃস্ব মানুষের ওপর, কতো তার হিংস্রতা তা সবই প্রকাশ পায়, দেশভাগের আগে-পরে যে বিভীষিকাময় অধ্যয় রচিত হয়েছে ভারতবর্ষে, তার ছবি অঙ্কিত করেছেন সেলিনা হোসেন (জ. ১৯৪৭)। পাঞ্জাব বা বিহারে যে দাঙ্গার আগুনে পুড়েছে মানবতা, মরেছে মানুষের সভ্যতা, হিংসার ছোবলে মানুষ হয়েছে পদদলিত-লাঞ্ছিত, তার রূপ এসেছে বাংলায়, ছিচল্লিশের দাঙ্গায়, দাঙ্গা সভ্যতার সমস্ত উপকরণ বিদীর্ণ করে, দেহের পোশাক যেমন পুড়ে যায়, তার ভেতরের সজ্জিত মানবতা-মনুষ্যবোধের মৃত্যু ঘটে, তখন সে হয়ে যায় মনুষ্যের বিপরীত। দেশভাগ নিয়ে তিনি লেখেন, ‘সোনালী ডুমুর’ (২০১২ আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা) প্রকাশ হলেও (২০১৫ সালে ইত্যাদি গ্রন্থ, ঢাকা) প্রকাশ করে, উপন্যাসটিকে পঁচিশটি অধ্যয়ে ভাগ করা হয়েছে, চারশত পৃষ্ঠার বিশাল কাহিনীমালা, ভারত উপমহাদেশের বিভক্ত কাহিনী এতে বিভিন্ন আঙ্গিকে চিত্রায়িত হয়েছে, উপন্যাস যেন মানুষের কথা বলে মানবতার কথা বলে, সোনালী ডুমুর উপন্যাসে সেলিনা হোসেন তা সত্যসত্যিই স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন, যুদ্ধ-হিংসা আর সাম্প্রদায়িকতা মানুষকে কখনো শান্তি দিতে পারে না, দিতে পারে না সামাজিক বা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। মানুষের জন্য মানুষ হয়েও কোথায় একটা বিভেদ কোথায় একটা দেয়াল যেন অভিশপ্ত নগরীর মতো শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলে, সেখানে দাঁড়িয়ে সবাই বাস্তবিক নির্বাক দর্শক, কারো কিছু বলার নেই, করারও নেই, একটা সময়ের আবর্তে মানুষ যেন শৃঙ্খলহীন হয়ে গেছে, সামনে-পেছনে চাপ-চাপ ঘন-কালো নিকষ অন্ধকার। সেই অন্ধকার সাগর পেরিয়ে কোথায় চলেছে, কেউ জানে না, তারপরও মানুষ কোথায় যেন চলছে, চলেই যাচ্ছে রৌদ্দহীন সময়ে। সেলিনা হোসেন উপন্যাস আখ্যানে মানবতাকে টেনে এনেছেন মানবসভ্যতার প্রয়োজনে, শিল্পের প্রয়োজনে, সেখানে শুধুই মানুষ যেন মানুষের জন্য পাশে এসে দাঁড়ায়। এ’ যাবৎকাল যতো উপন্যাস তিনি রচিত করেছেন, ‘সোনালী ডুমুর’ অন্যতম আখ্যান হিসেবে পরিগণিত, ইতিহাস কখনো সত্য হয়ে কথা বলে, কখনো বা ইতিহাস নির্বাক দর্শক যেন, বৃহদায়তনের এ’ গ্রন্থের ভেতরে মানুষের মধ্যে আবহমানকাল ধরে যে ভালোবাসা-সৌহার্দ-সম্প্রতি বিরাজমান, তারই বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যায়।

দেশভাগ এবং দাঙ্গা তারপর কতিপয় মানুষের স্বার্থসিদ্ধির যে চ‚ড়ান্ত রূপ তারই প্রকাশ ঘটে ভেতরে-বাইরে। কলকাতার দাঙ্গার সংবাদে নোয়াখালীতে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে এবং গান্ধীজী ছুটে আসে, এরপরে দেখা যায় দাঙ্গা থামে কিন্তু যন্ত্রণা দগদগে ঘাঁ’য়ের মতো বিষক্রিয়া ছড়ায়, দেওভোগ থেকে চাঁদপুরে যে পরিবারটির অবস্থান হলো, সেখানে তাদের নিরাপত্তা অভাববোধ কখনো-সখনো বড় বেশি অনুভ‚ত হলো, তারপরও ডাঙায় তো থাকতেই হয় মানুষকে, সে আর কি করবে, না পানি অথবা জঙ্গল, সবখানেই তো শঙ্কা আছেই। বিম্ববর্তী মাঝে-সাঝে ছেলে প্রফুল্লর জন্য উদাসীন হয়ে যায় কিন্তু পিতা হিসেবে সুবোধনাথ ছেলের কথায় চটে যায়, এমন ছেলে যে কি না দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিলো, যৌথ একটা পরিবার, যেখানে দু’ভাই তাদের বউ-ছেলে-মেয়ে নিয়েই তো সংসার, মোটামুটি একটা চমৎকার আবহাওয়ায় কেটে যায়, সরোজিনী যখন স্বামী অমিয়নাথের কাছে সংসারের যাবতীয় বিষয়াদি নিয়ে গল্প করে, সেখানে বিম্ববর্তীও ছুটে আসে, সুবোধনাথও সায় দেয়, দু’ভাই যেন বিনা সুতোয় গাঁথা চাঁদ-সুরোজ। কিন্তু হঠাৎ কি একটা অনাসৃষ্টি দেশভাগে তাদের খণ্ডিত হতে হলো, নিজেরাই কোনো ক‚লকিনারা খুঁজে পায় না, একটা শঙ্কা একটা আতঙ্ক তাদের আজ তাড়া করে বেড়ায়। আগুন-দাঙ্গা আগুন যেন সামনে-পেছনে ধেয়ে আসছে, কোথাও লুকোনোর জায়গা নেই, তারপরও জীবন নিয়ে পলায়ন, কারণ বেঁচে থাকাটাই বড় কথা।

উপন্যাসের পাতায়-পাতায় শঙ্কা আর আতঙ্ক, সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘুর ওপর একটা সচিত্র চিত্র লক্ষণীয়, প্রতিমুহূর্তে মানুষের প্রতি মানুষের যে অবিশ্বাস-অনাস্থা তা পুঞ্জীভ‚ত হয়, বাগানবাড়ি হাত ছাড়া হওয়ার ফলে যে শোক-ক্ষোভ মনের মধ্যে দানায়িত হয়, তার ঠিক দু’মাসের মাথায় ভ‚দেব দত্তের স্ত্রী অর্থাৎ মাধুরীর দিদিমা নিজেকে আর সামলাতে না পেরে পরলোকে চলে গেলেন, মাধুরীর ক্ষোভ ঝরে পড়ে, দাঙ্গায় আমার মাকে কেটে টুকরো করা হয়েছিল, এবার দাঙ্গায় দিদিমা চলে গেলো, মানসিক অত্যাচারও একপ্রকার দাঙ্গার রূপ লাভ করে।

চৌষট্টির দাঙ্গায় ডাক্তার নন্দী বেঁচে যান, কিন্তু দাঙ্গার ভেতর দিয়ে তিনি বোঝেন মানুষ সত্যিই কখনো-সখনো অমানুষে পরিণত হতে সময় লাগে না। মানবতা-ভালোবাসা এবং সহানুভ‚তি সবই একনিমেষে চূর্ণ হয়, তিনি মনে করেন, দাঙ্গা লাগায় স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী আর এর মদদ দেয় স্বয়ং সরকার, এ’ সবই নষ্ট রাজনীতির নষ্ট ফল। উপন্যাসের একেবারে শেষ প্রান্তে এসে দেখা যায়, পাঞ্জাবের লুধিয়ানা হাসপাতাল থেকে টেলিগ্রাম আসে, তার ছেলে ভাস্কর আর শেখর নন্দী তাদের স্ত্রী ও শিশু সন্তানসহ মোটরগাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করেছে, দুর্ঘটনার সংবাদ শুনে মুষড়ে যায়, তার চেয়ে বড় কথা শিশুটির অবস্থা আশঙ্কাজনক। সংবাদ শুনে ডাক্তার নন্দী-শান্তি কয়েকদিনের মধ্যে কলকাতায় রওনা হন, পাঞ্জাবের অমৃতসরের পথে ট্রেনে ওঠেন, ডাক্তার নন্দী নাই এদিকে রোগীরা ভালো চিকিৎসার জন্য নন্দীকে খোঁজ করে।

সাহিত্যিক সেলিনা হোসেন এভাবেই আমাদের মস্তিষ্কে আঘাত করেছেন, আঘাত করে আমাদের মৃত চেতনাকে সজাগ করার চেষ্টা করেছেন। দেশভাগ বা বাংলাভাগ আমাদের বাঙালিত্বকে শুধু ছোট করেই দেয়নি বরং পষ্ট করে বললে, বলতে হয় কবর দিয়েছে, আমাদের বাঙালিত্বকে পুরোদস্তুর কবর দেয়া হয়েছে বাংলা বিভাজনের মধ্য দিয়ে, আর তারপর নন্দী ডাক্তারের মতো মহান মানুষদের সম্পদ-সম্পত্তি যখন হয়ে যায় শত্রুসম্পত্তি, তখন নিজের ওপর নিজেরই বড় ঘৃণা হয়, এবং ঘৃণা জন্মে। ‘সোনালী ডুমুর’ শুধু একটি উপন্যাসই নয়, বাঙালি জাতির বিবেকের দলিল।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App