×

সাময়িকী

মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস ও বাংলাদেশের ইতিহাস

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২০, ১০:০০ পিএম

মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস ও বাংলাদেশের ইতিহাস

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের রক্তস্নাত অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে আমাদের যে বিপুল সাহিত্যের ভাণ্ডার গড়ে উঠেছে তাতে উল্লেখযোগ্য স্থান করে নিয়েছে উপন্যাস। সত্তরের দশকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভ‚মিতে রচিত উপন্যাসের সংখ্যা নেহাত কম নয়। এগুলোর অনেকগুলো পুরোপুরি শিল্প সফল হয়তো হয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের আবেগ, অনুভ‚তি ও সে সময়ের রক্তাক্ত অধ্যায়ের নানা চিত্রে সেগুলো সমুজ্জ্বল। সত্তরের দশকের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক উপন্যাসগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর বহুমাত্রিক ছবি পাওয়া যায়। একদিকে একাত্তরের মার্চের উত্তাল দিনগুলোর ঘটনাপ্রবাহ, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংস গণহত্যা, নির্বিচার লুণ্ঠন, ব্যাপক ধ্বংসলীলা, নির্মম নারী ধর্ষণ ও নিষ্ঠুর অত্যাচারের ফলে দেশের ভেতরে কোটি কোটি মানুষের নিরাপত্তাহীন সন্ত্রস্ত অবরুদ্ধ জীবন এবং মৃত্যুভয়ে আতঙ্কিত অসহায় মানুষের দলে দলে দেশত্যাগ করে পালিয়ে বাঁচা, অন্যদিকে অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ সংগ্রাম ও অসীম আত্মত্যাগ সত্তরের দশকের বাংলাদেশের উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য উপাদান হয়ে আছে। এসব ঘটনা নানা উপন্যাসে নানাভাবে প্রতিফলিত ও চিত্রিত হয়েছে। প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় আনোয়ার পাশার (১৯২৮-১৯৭১) রাইফেল রোটি আওরাত (১৯৭৩) উপন্যাসের কথা। এটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম উপন্যাস। এটি রচিত হয় মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১-এর মার্চ থেকে এপ্রিল মাসে। আত্মজৈবনিক এ উপন্যাসে উঠে এসেছে একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত প্রগতিশীল আন্দোলনের কেন্দ্রভ‚মি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সেই সঙ্গে আন্দোলনে উত্তাল ঢাকা শহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর পৈশাচিক আক্রমণ, তাণ্ডবলীলা ও গণহত্যার চিত্র। সমস্ত ঘটনা বর্ণিত হয়েছে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুদীপ্ত শাহীনের প্রত্যক্ষ বর্ণনা রীতিতে। একাত্তরের যন্ত্রণাক্লিষ্ট দিনগুলোর পাশাপাশি এ উপন্যাসে উঠে এসেছে দীপ্ত যৌবনের স্বপ্নিল সম্ভাবনা। উপন্যাসের নায়ক সুদীপ্ত শাহীন আসলে লেখক অনোয়ার পাশারই প্রতিভাস। প্রায় একই সময়ে শওকত ওসমান রচনা করেন জাহান্নাম হইতে বিদায় (১৯৭১) উপন্যাসটি। এ উপন্যাসের গাজী রহমানও পেশায় শিক্ষক। এ উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর তাÐবলীলার বিবরণ। বীভৎস অবস্থায় জীবন বাঁচানোর তাগিদে লাখ লাখ মানুষের সাথে গাজী রহমানও দেশ ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন প্রতিবেশী দেশ ভারতে। এ উপন্যাসে হানাদার বাহিনীর তাণ্ডব লীলায় বিধ্বস্ত স্বদেশকে তাঁর মনে হয়েছে জাহান্নাম বা নরক। একই ধরনের উপন্যাস শওকত আলীর যাত্রা (১৯৭৬)। এ উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নের ঘটনা স্থান পেয়েছে। বিবৃত ঘটনার সময়কাল ২৫ মার্চ থেকে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। ২৫ এপ্রিলের ভয়াবহ হামলার পর ঢাকা শহর ছেড়ে দলে দলে মানুষ নৌকায় করে বুড়িগঙ্গা পাড়ি দিয়ে পালাতে শুরু করে গ্রামের দিকে। লক্ষ্যহীন তাদের যাত্রা। উপন্যাসের মূল চরিত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রায়হান সপরিবারে আশ্রয় নেন পথে পড়া গ্রামের একটি স্কুলে। কিন্তু হানাদার বাহিনী গ্রাম অভিমুখে এগোতে থাকলে তারা ওই আশ্রয় ছাড়তে বাধ্য হন। তারা জানেন না তাদের এই যাত্রার শেষ কোথায়। উপন্যাসে মধ্যবিত্ত মানুষের দোদুল্যমান মনোভঙ্গি ফুটিয়ে তোলায় ব্রতী হয়েছেন লেখক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারী সমাজের ব্যাপক আত্মত্যাগ ও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসে তার প্রতিফলন ঘটেছে খণ্ডিতভাবে। বীরত্বের ভ‚মিকার চেয়ে হানাদার বাহিনীর হাতে নারী নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে কোনো কোনো উপন্যাসে। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় শওকত ওসমানের নেকড়ে অরণ্য (১৯৭৩) উপন্যাসের কথা। এ উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে নারী নির্যাতনের মর্মন্তুদ কাহিনী। সিভিল সাপ্লাইয়ের গোডাউনে প্রায় একশ নারীকে ধরে এনে উলঙ্গ করে রেখেছিল হানাদাররা। এখানেই নির্যাতনের শিকার হয় পাঁচজন নারী। তাদের অতীত জীবনালেখ্য, তাদের বন্দি জীবনের মর্মন্তুদ ঘটনাকে তুলে ধরা হয়েছে উপন্যাসে। এই ধারাতেই বিবেচ্য সৈয়দ শামসুল হকের নিষিদ্ধ লোবান (১৯৮১) উপন্যাসটি। এ উপন্যাসের কাহিনী গড়ে উঠেছে বিলকিস নামের এক নারীকে নিয়ে যে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তার পিতামাতা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, ঘরবাড়ি হারায়। তার স্বামী নিখোঁজ হয়ে যায়। ঘটনাচক্রে তার সঙ্গে পরিচয় হয় প্রদীপকুমার তথা সিরাজের। পাকিস্তানি সৈন্যরা যখন তাদের গুলিতে নিহত মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ দাফনে নিষেধাজ্ঞা জারি করে তখন রাতের অন্ধকারে লাশগুলো দাফন করতে গিয়ে তারা পাকিস্তানি মিলিটারির হাতে ধরা পড়ে। কিন্তু অভাবনীয়ভাবে বিলকিস প্রতিবাদে অবিচল থাকে। রিজিয়া রহমানের রক্তের অক্ষর (১৯৭৮) উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে পাকিস্তানি মিলিটারিদের হাতে লাঞ্ছিত ভাগ্যাহত বাঙালি নারী ইয়াসমিনের জীবনের ঘটনা। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করার অপরাধে তাদের পরিবারের সবাইকে পাকিস্তানিরা হত্যা করে। উচ্চশিক্ষিত ইয়াসমিনকে হত্যা না করে তারা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি করে রাখে। সেখানে তার ওপর তারা পাশবিক অত্যাচার চালায়। ছয় মাসের দুঃসহ অত্যাচার ও বন্দিজীবন শেষে দেশ স্বাধীন হলে ইয়াসমিনের ঠাঁই হয় নারী পুনর্বাসন কেন্দ্রে। সরকার নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনের ঘোষণা দিলেও স্বাধীন দেশে সে সম্মানযোগ্য মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে কোনো কোনো উপন্যাসে। হানাদার বাহিনীর নারী লোলুপতার ঘৃণ্য চেহারাকে শওকত ওসমান ফুটিয়ে তুলেছেন তার দুই সৈনিক (১৯৭৩) উপন্যাসে। এ উপন্যাসে দুই সামরিক অফিসার পাকিস্তানের সমর্থক একজন মুসলিম লীগপন্থি চেয়ারম্যানের বাড়িতে পরম আতিথেয়তা লাভের পর তার কলেজপড়–য়া দুই মেয়েকে জোর করে তুলে নিয়ে যায়। নিজের চোখের সামনে মেয়েদের তুলে নিতে দেখে অসহায় বাবা তীব্র গøানিতে আত্মহত্যা করে। শওকত ওসমানের জলাঙ্গী (১৯৭৪) উপন্যাসের বিষয়বস্তুতেও এমনটি দেখা যায়। এ উপন্যাসে বর্ণিত হয়েছে একজন মুক্তিযোদ্ধা ও তার প্রেমিকার ওপর নির্মম নির্যাতনের ঘটনা। এদের হাত-পা বেঁধে গলায় পাথর ঝুলিয়ে মেঘনা নদীতে ডুবিয়ে মারা হয়। এরা নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হয়। মৃত্যুর আগ মুহূর্তে ‘জয় বাংলা’ ¯েøাগান দিয়ে তাদের অবিচলিত দেশপ্রেমকে মহিমান্বিত করেছে। কোনো কোনো উপন্যাসে ফুটে উঠেছে শত্রু-কবলিত ঢাকা শহরের চিত্র। রশীদ হায়দারের খাঁচা (১৯৭৩) উপন্যাসে শত্রু-কবলিত এই নগরীর তিনটি ফ্ল্যাটের মানুষের অবরুদ্ধ জীবনকে খাঁচার প্রতীকে তুলে ধরা হয়েছে। এ উপন্যাসে মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মতৎপরতার প্রতি মুগ্ধ আবেগের প্রকাশ যেমন ঘটেছে, তেমনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারায় নায়কের মর্মবেদনাও ফুটে উঠেছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঢাকা নগরীর নয় মাসের অবরুদ্ধ জীবনচিত্র পাওয়া যায় রাবেয়া খাতুনের ফেরারী সূর্য (১৯৭৪) উপন্যাসেও। এ উপন্যাসে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের দৈনন্দিন জীবনযাপনের কাহিনীকে কেন্দ্র করে বর্ণিত হয়েছে অবাঙালি ও রাজাকারদের লুটপাট-অত্যাচার, ঢাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা তৎপরতার ঘটনা, মুক্তিযুদ্ধে ভারতসহ বৈদেশিক শক্তিগুলোর ভ‚মিকা ইত্যাদি। উপন্যাসটি শেষ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ঘটনার মধ্য দিয়ে। এ উপন্যাসে পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক একটি ছবি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা প্রথমে ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে হলেও ক্রমে তা ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে। এই যুদ্ধে গ্রামের সাধারণ মানুষের ছিল স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। গ্রামীণ পটভ‚মিতে মুক্তিযুদ্ধের ছবি আমরা পাই কয়েকটি উপন্যাসে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ উল্লেখযোগ্য আমজাদ হোসেনের অবেলায় অসময় (১৯৭৪) ও সেলিনা হোসেনের হাঙর নদী গ্রেনেড (১৯৭৬)। আমজাদ হোসেনের অবেলায় অসময় উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধকালীন গ্রাম জীবনের ছবি চিত্রিত হয়েছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের মুখে একটি গ্রামের নানা ধর্মের নানা সামাজিক স্তরের অসহায় নরনারী কয়েকটি নৌকায় করে পালিয়ে যেতে থাকে প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় নিতে। তারা পেছনে ফেলে আসে নির্যাতনের দুঃসহ স্মৃতি। আতঙ্কময় বিপন্ন বর্তমান তাদের কুরে কুরে খায়। আর তাদের যাত্রা অনিশ্চিত অক‚ল ভবিষ্যতের দিকে। যাত্রাপথে তারা সর্বত্র প্রত্যক্ষ করে হানাদার পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর নির্মমতা ও নৃশংসতার নানা চিহ্ন। সেলিনা হোসেনের হাঙর নদী গ্রেনেড (১৯৭৬) উপন্যাসের পটভ‚মিও মুক্তিযুদ্ধকালীন গ্রাম। এ উপন্যাসে দেশের জন্য গ্রামবাংলার এক সাধারণ মায়ের অসামান্য অবদানের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারায় গ্রামীণ জীবনে সৃষ্টি হয় মুক্তিযুদ্ধের উন্মাদনা। এই উন্মাদনায় পাড়াগাঁয়ের অশিক্ষিত মা তার প্রাণপ্রতিম সন্তানের জীবন উৎসর্গ করে মুক্তিসংগ্রামকে এগিয়ে নেয়। সারাসরি মুক্তিযুদ্ধকে বিষয় না করে মুক্তিযুদ্ধের পটভ‚মির চিত্রকে ব্যবহার করা হয়েছে কিছু উপন্যাসে। সত্তরের দশকের মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসগুলোর কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। প্রথমত, অধিকাংশ উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক ছবির পরিবর্তে আংশিক ও খণ্ড খণ্ড ছবি ধরা পড়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক রূপায়ণ ঘটেছে এমন উপন্যাস সত্তরের দশকে রচিত হয়নি। দ্বিতীয়ত, অধিকাংশ লেখকই সমাজের মধ্য স্তরের প্রতিনিধি। তাই তাদের লেখায় তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা ও মানস প্রতিক্রিয়ার প্রতিফলন ঘটেছে বেশি। সব মিলিয়ে বলা যায়, সত্তরের দশকের মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাসে বাংলাদেশের ইতিহাসের এক মহান অধ্যায়কে সাহিত্যে ফুটিয়ে তোলায় লেখকদের অবদান কম নয়। পরবর্তী দশকগুলোতে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যেসব উপন্যাস রচিত হয়েছে সে ক্ষেত্রে এই দশকের উপন্যাস সুদূরপ্রসারী প্রভাব রেখে গেছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App