×

জাতীয়

বিপাকে বেসরকারি স্কুল

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২০, ০৯:১৪ এএম

বিপাকে বেসরকারি স্কুল

করোনায় বন্ধ ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ক্লাস না হলেও প্রতি বছরের ধারাবাহিকতায় ২১ সালের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিতে স্কুলে স্কুলে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে নতুন বই। গতকাল বগুড়ার ধুনট এন ইউ পাইলট হাইস্কুল গেট থেকে তোলা ছবিটি -ভোরের কাগজ

রাজধানীর ধানমন্ডির শংকর পেরিয়ে মোহাম্মদপুর আল্লা করিম মসজিদের পাশের গলিতে চিলড্রেন একাডেমি নামের স্কুলটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। করোনার কারণে রুজি বন্ধ থাকায় স্কুলটি আর চালাতে পারছিলেন না অধ্যক্ষ আইরিন আক্তার। একপর্যায়ে গত অক্টোবরে তিনি বন্ধ করে ভাড়া করা স্কুল বাড়িটি ছেড়ে দিয়েছেন। গতকাল এ প্রতিবেদককে আইরিন আক্তার জানান, গত জানুয়ারিতে পাশের গলি থেকে স্থানান্তর করে চিনড্রেন একাডেমিকে এখানে নিয়ে আসেন। প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থী নিয়ে স্কুলটি ভালোই চলছিল। কিন্তু গত ১৮ মার্চ থেকে করোনার প্রকোপ ঠেকাতে সরকারি নির্দেশে স্কুলটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে জমানো টাকা দিয়ে প্রতি মাসে স্কুলবাড়ির ভাড়া ৭০ হাজার টাকা পরিশোধ করে আসছি। স্কুলের বন্ধ যতই বাড়তে থাকে ততই জমানো টাকা শেষ হতে থাকে। একপর্যায়ে সব শূন্য হয়ে যায়। অক্টোবর থেকে স্কুলবাড়ির ভাড়া ৭০ হাজার টাকা দিতে পারিনি। বাধ্য হয়ে ভাড়া করা স্কুলবাড়ি ছেড়ে দেই। এর ফলে স্কুলটিতে কর্মরত ২২ জন শিক্ষক ও ৪ জন কর্মচারীর চাকরিও আর নেই। চাকরি হারিয়ে তারা গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। প্লে গ্রæপ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত এখানে পড়ানো হতো। তারা তো টিউশন ফি দিত? এর জবাবে তিনি বলেন, কোথা থেকে দেবে? অভিভাবকরাও রুজি করতে পারছেন না। এর ফলে টিউশন ফিও আসেনি। যার কারণে বাড়ি ভাড়াও দিতে পারিনি। ভাড়া না পেয়ে বাড়িওয়ালা চাপ দেয়া শুরু করলেন। এক সময় ইজ্জতের বিষয় হয়ে দাঁড়াল। বাধ্য হয়ে স্কুলই ছেড়ে দিলাম। এখন স্কুল বন্ধ হওয়ায় এখানকার শিক্ষার্থী কোথায় যাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যারা যারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন তাদের আমরা অন্য প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করিয়ে দিচ্ছি। মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধের পাশে চাঁদ উদ্যানে ছিল গ্রিনভিউ বিদ্যানিকেতন। প্লে গ্রুপ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হতো। করোনার কারণে বন্ধ হওয়ার পর থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত টেনেটুনে স্কুলটি চালিয়েছিলেন অধ্যক্ষ হেলালুদ্দিন। কিন্তু গত সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে স্কুলবাড়ির ভাড়া বাকি পড়ে। অক্টোবরে ভাড়ার জন্য বাড়িওয়ালা চাপ দিলে হেলালুদ্দিনের স্ত্রী জানান, টাকা নেই। বাড়িওয়ালা বাড়ি ভাড়া আদায়ে হেলালুদ্দিনের স্ত্রীর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন। এরপর পুলিশও আসে। একপর্যায়ে সামাজিক সালিশ-বিচারের মাধ্যমে কিছু টাকা দেয়া হয় বাড়িওয়ালাকে। নভেম্বরের শুরুতে স্কুল বাড়িটিই ছেড়ে দেয়া হয়। হেলালুদ্দিনের বন্ধু ও বঙ্গবন্ধু কিন্ডারগার্টেন স্কুল এন্ড কলেজ পরিষদ মোহাম্মদপুর থানা শাখার সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, হেলাল মারা যাওয়ার পর গ্রিনভিউ বিদ্যানিকেতনটি চালানোর ক্ষমতা আর কারো রইল না। এর ফলে বাধ্য হয়ে স্কুলটি বন্ধ করতে হয়েছে। এখানে অধ্যয়নরত ২৪০ জন শিক্ষার্থীকে অন্যান্য স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া হচ্ছে। শুধু এই দুই স্কুলই নয়, সারাদেশে প্রায় ২ হাজার স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। এই সংখ্যা দিনে দিনে আরো বাড়ছে। করোনার প্রকোপ কমাতে সরকার গত ১৮ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়। কয়েক ধাপে বন্ধের পরিধি বাড়তে বাড়তে আগামী ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে। ধারণা করা হচ্ছে, বন্ধ আরো বাড়বে। এই বন্ধের মধ্যে আগামী শিক্ষাবর্ষে ভর্তি কার্যক্রম লটারিতে শেষ করার কথা জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ অবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে স্কুল বন্ধ থাকলেও এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা বেতন পেয়েছেন। কিন্তু নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং এর শিক্ষক-কর্মচারীরা টাকা না পেয়ে ভীষণ বিপাকে পড়েছেন। অবস্থা আরো খারাপ হয়েছে ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে ওঠা কিন্ডারগার্টেন ও প্রিপারেটরি স্কুলগুলোর। টাকা না পেয়ে কোথাও স্কুল বিক্রি হচ্ছে, আবার কোথাও স্কুল একেবারে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সরকারের অনুমতি না নিয়ে স্কুলগুলো তৈরি না হওয়ায় এই দুর্যোগে সরকার থেকেও তারা কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন না। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, গত জুলাই মাসে রাজধানীর মাটিকাটায় আইডিয়াল পাবলিক স্কুলটি বিক্রি করা হয়েছে। বিক্রির আগে ‘স্কুলটি বিক্রি করা হবে’ এমন শিরোনাম লিখে নোটিস টানানো হয়েছিল। স্কুলটির অধ্যক্ষ নারগীস আক্তার বলেন, আর না পেরে গত আগস্টে স্কুলটি বেচে দিয়েছি। এই বিদ্যালয়ের মতোই করোনার প্রকোপ নেমে এসেছে সারাদেশের সব নন-এমপিওভুক্ত এবং কিন্ডারগার্টেন স্কুলে। গত ১৭ মার্চ থেকে অনেকটা আকস্মিতভাবেই বিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বকেয়া টিউশন ফি আদায় হয়নি। আয় না থাকায় শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দেয়াও সম্ভব হয়নি। স্বল্প বেতনের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেশির ভাগই বেতন-ভাতা না পেয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ৬৫ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুলের মধ্যে গত ৭ মাসে অন্তত ২ হাজার স্কুল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। ভাড়া বাড়িতে থাকা এসব স্কুল গুটিয়ে নিয়ে কর্তৃপক্ষ বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। সরিয়ে ফেলা হয়েছে স্কুলের সাইনবোর্ডও। কোনো রকম আগাম বার্তা বা নোটিস না দিয়ে স্কুল উধাও হয়ে যাওয়ায় অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরাও পড়েছেন বিপাকে। আসছে জানুয়ারিতে অন্য বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য অনেক অভিভাবক সন্তানের টিসি (ট্রান্সফার সার্টিফিকেট) আনতে গিয়ে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাউকে খুঁজে পাচ্ছেন না। বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন স্কুল এন্ড কলেজ ঐক্য পরিষদের চেয়ারম্যান এম ইকবাল বাহার চৌধুরী বলেন, আক্ষরিক অর্থেই কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষক-কর্মচারীরা না খেয়ে, আধপেটা খেয়ে চরম মানবেতর জীবনযাপন করছেন। অনেক প্রতিষ্ঠানে টিউশন ফির অর্থে খরচ নির্বাহ না হওয়ায় ভর্তুকি দিতে হয়। স্কুল বন্ধ থাকায় মার্চ মাস থেকে কোনো টিউশন ফি আদায় না হওয়ায় সব ধরনের বিলসহ বাড়ি ভাড়া, বেতন-ভাতা পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। বাড়ির মালিক বাড়ি ভাড়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। শিক্ষক-শিক্ষিকা, কর্মকর্তা ও গরিব কর্মচারীরা অর্থকষ্টে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এ কারণে হাজার দুয়েক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধই হয়ে গেছে। তবে এক বিজ্ঞপ্তিতে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, যেসব কিন্ডারগার্টেন ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে বা যারা গ্রামে চলে গেছেন, তারা তাদের সন্তানদের কাছাকাছি সরকারি স্কুলে টিসি ছাড়া ভর্তি করাতে পারবেন। নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী সংগঠনের সভাপতি গোলাম মাহদুন্নবী ডলার ভোরের কাগজকে বলেন, করোনার কারণে নন-এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্ধ হয়নি। তবে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা খুবই কষ্টে জীবনযাপন করছেন। অনেকেই পেশা বদলে দোকানদারি করছেন। সরকারের উচিত এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রতি নজর দেয়া।    

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App