×

সাময়িকী

পারমিতার জগৎ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২০, ০৯:৪৮ পিএম

পারমিতার জগৎ

ওদের দু’জনের কেউ আমার কথার গূঢ়ার্থ বুঝলো না। দু’জনেই প্রশ্ন নিয়ে তাকালো, মাসুমের চোখে বোকা বোকা দৃষ্টি, আর পারমিতার চোখে বিস্ময়। এবার আমি সরাসরি পারমিতাকে বললাম, “তুমি এখন বিকশিত হচ্ছো, এখন তোমাকে আকাশটা দেখতে দেয়া উচিত, তোমার চোখ থেকে সীমাবদ্ধতার অচলায়তনটা সরিয়ে দেয়া উচিত; তাই নয় কি?” পারমিতা হেসে বলে, “আপনি কবিতা লেখেন তাই না সবুজ ভাই?” আমি পারমিতার কথায় মনে মনে খুশি হলাম, কিন্তু প্রকাশ্যে বললাম, “না পারমিতা তেমন কিছু নয়! এই একটু...” কথা শেষ করতে পারছিলাম না আমি, পারমিতা আমায় সাহায্য করলো, “আপনার কথাগুলো খুবই সুন্দর, মনে হয় যেনো গল্প-উপন্যাসের ডায়লগ।” খলখল করে হেসে ওঠে পারমিতা। আমি ভাবতাম, “পারমিতা কি আমার প্রশংসা করলো, না-কি ইনসাল্ট করলো?” আমার ভাবনার ফাঁকে মাসুম আমাদের কথা কিছু শুনে, কিছু না শুনে বোকার মতো হেসে উড়িয়ে দিয়ে পারমিতাকে নিয়ে এগিয়ে গেল।

দুই. হাঁটতে হাঁটতে কখন আমি ব্রহ্মপুত্রতীরে এসে পড়েছিলাম টেরও পাইনি। এ ব্যাধি আমার নতুন নয়; অবচেতনে ব্রহ্মপুত্র আমায় ডাকে, আর ঘোরের মধ্যে চলে আসি নদীটির তীরে। কৈশোরে যখন ওর সাথে আমার প্রথম পরিচয়, তখনই সখ্য হয়ে যায়, সে সখ্যে কখনো বন্ধু হয়ে যায়, তখন সে নদ, আমার বাল্যের সখা; যখন তটরেখা ছুঁয়ে খঞ্জনা হাঁটে পদচ্ছাপ ফেলে, তখন সে আর নদ থাকে না, নদী হয়ে যায়-সখি হয়ে ডাকে, ক্রমশ প্রেয়সী হয়ে ওঠে। নদীটির সাথে আমার তখন মন দেয়া-নেয়া, ওর সুরে সুর মিলিয়ে গান গাই- এ-কূল ভেঙে ও-কূল তুমি গড়ো যার এ-কূল ও-কূল দু’কূল গেল তার লাগি কী করো... সুরে সুরে কখন যে গোপন একাকীত্বগুলো মুছে যায় বুক থেকে, টেরও পাই না। শরৎ মিলিয়ে যাচ্ছে ক্রমে হেমন্ত আসি আসি করছে, ওপাড়ে কাশফুলের ঔজ্জ্বল্য সরে যাচ্ছে; দুর্গাপূজার উৎসব শেষ হলো সদ্য, এখন সবার অপেক্ষা লক্ষ্মীপূর্ণিমার। দুর্গাপূজায় যেমন পথে-পথে, পাড়ায়-পাড়ায় উৎসব; লক্ষ্মীপূজায় তেমনি ঘরে-ঘরে উৎসব; নদীটি সড়ক থেকে অনেকটা দূরে সরে গেছে, দু’মাস আগেও ঘোলা জলের ঢেউ সড়ক ছুঁই-ছুঁই করছিলো। জেগে ওঠা চরে ওপারের এক বীণ-পরিবার করলা আর মরিচের টাল করেছে। করলা-লতা পল্লবিত হচ্ছে। মরিচের চারাগুলোও বেশ ডাগরটি হয়ে উঠেছে। কোনো কোনোটিতে একটি দু’টি ফুলও ফুটছে, যেনো বালিকারা ফুটিতেছে, কৃষকের উদ্বেগ বাড়ছে। টালের চারদিকে বাঁশের খুঁটিতে তার লাগিয়ে ঘের দেয়া হয়েছে, একপাশে টালে ঢোকার পথও রাখা হয়েছে, কপাটের সামনেই ছনের শয্যা পাতা হয়েছে পাহারার জন্য। নদী থেকে ক’হাত ফাঁকেই। পাহারা এখনো জোরদার হয়নি খুব, ফল পুষ্ট হবার সাথে সাথে নজরদারীও বাড়বে। ফাঁকা ছনের শয্যায় অর্ধশায়িত হয়ে আমি নদীতে সন্ধ্যা নামার দৃশ্য দেখছিলাম; পাট বোঝাই একটা বড় নৌকা ভাটির দিকে চলে গেল, পালে হাওয়া লাগিয়ে অন্য একটা নৌকা উজানে যাচ্ছে, গলুইয়ে একজন মাঝি হাল ধরে গান গাইছে আর দু’জন মাঝি নিবিষ্ট মনে গুন টেনে যায় আমার সামনে দিয়ে। ওপারে কয়েকটা পাখি দিবসের শেষ ওড়াউড়িটা সেরে নিচ্ছে, দূর থেকে আমি সঠিক বুঝতে পারছি না ওগুলো কী পাখি, কিন্তু ওদের ওড়ার আনন্দ দেখতে ভালোই লাগছে। উজানের দিকে সূর্যটা জলে আবীররঙ ছড়িয়ে দিয়ে ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে। আমি তখন দেখছি বিষাদ কীভাবে সন্ধ্যাকে গ্রাস করে কয়েক মুহূর্তের জন্য।

আমার মগ্নতার মধ্যেই সড়ক থেকে ঢাল বেয়ে নিচে নেমে আসে দু’জন। মেয়েটি আগে আগে আর ছেলেটি পেছনে। ছেলেটি বারবার সতর্ক করে মেয়েটিকে বলছে, “আরে সাবধানে হাঁটো না আমার হাত ধরে! পড়ে যাবে তো!” মেয়েটি খল খল শব্দে হাসে। পেছন থেকে ওদের কথা আর হাসির শব্দ আসছে; কেনো জানি না মেয়েটির হাসির শব্দে পলকে সন্ধ্যার বিষাদ সরে গিয়ে শরতের দ্বাদশী চাঁদ আলোকিত হয়ে উঠতে চায়, আমার বুকের মধ্যেও ছলাৎ-ছলাৎ ঢেউ খেলে যায়। ওদের কথা আর হাসি নিকটবর্তী হলো আরও, স্পষ্ট হলো আরও। ছেলেটি বললো, “এখানে আসার কী দরকার ছিলো তোমার?” মেয়েটি সরলভাবে বললো, “সমস্যা কী? আমি সব্জিক্ষেত দেখবো, কৃষকের সাথে কথা বলবো!” ছেলেটি হাসে, “কৃষক কোথায় পাবে? ওপার থেকে পশ্চিমারা এসে এখানে করলা-লাউ-মুলার চাষ করে।” ওরা কাছে চলে এসেছে; মেয়েটি বলে, “কী-কাণ্ড! এতো দেখি আধুনিক কৃষক! জিন্স পরে শুয়ে আছে!” মেয়েটির কথায় আমি বসলাম, ফিরে তাকালাম; আমায় দেখে মেয়েটির উচ্ছ¡াস যেনো উথলে পড়লো; “ও আল্লা! মাসুম, দেখো সবুজ ভাই!” এবার আমি বিস্ময়ে দেখলাম পারমিতা আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। পেছন থেকে মাসুম হেঁটে এলো। “কী-রে সবুজ তুই এখানে কী করছিস?” আমি মাসুমের প্রশ্নের উত্তর দেবার আগেই পারমিতা আমার পাশে বসে পড়লো ছনের শয্যায়। মাসুম যেনো কিছুটা অস্বস্তিতে পড়লো, “কী মুশকিল পারু, তুমি মাটিতে বসে পড়লে কেনো?” পারমিতা হাসতে হাসতেই উত্তর করলো, “মাটি কোথায়! দেখো না কী সুন্দর বিছানা। আর সবুজ ভাই যদি শুয়ে থাকতে পারে আমি বসলে দোষ কী? তুমিও বসো না?” পারমিতা ওর মনোযোগ আমার দিকে ঘোরালো; “আপনি এখানে শুয়ে কী করেন? এই সব্জিক্ষেত কি আপনার?” আমি মৃদু হাসলাম, “আমার না, এটা বীণদের, ওরা নদীর ওপারে থাকে।” চোখ পিটপিট করে পারমিতা বলে, “আপনি তাইলে এখানে শুয়ে কী করেন? কবিতা লেখেন?” পারমিতার যেনো আগ্রহের সীমা নেই। আমি রহস্য করে বলি, “পাহারা দিই, পেটচুক্তি।” পারমিতা আমার পিঠে মৃদু চড় দিয়ে বলে, “যাহ!” এ ক’বছরে পারমিতা অনেক সাহসী হয়ে উঠেছে। আমি কথা ঘোরাতে প্রশ্ন করি, “তুমি কবে এলে? টেরও পেলাম না!” পারমিতা উত্তর দিলো, “আমি তো আজই এলাম। পরশু আমার ভর্তি পরীক্ষা এগ্রি ভার্সিটিতে।” তার মানে পারমিতা এবার ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছে! মাসুম এবার তাড়া দিয়ে বললো, “চলো পারু! সন্ধ্যা হয়ে গেছে! বাসায় যেতে হবে! ভাবী কিন্তু পরে রাগ করবে!” পারমিতা ড্যামকেয়ার, “কিছুই হবে না! আমি এখানে একটু বসবো। তুমিও বসো না কেনো? তুমি বরং একটা কাজ করো আটানার বাদাম নিয়ে আসো, সবাই মিলে খাই।” মাসুমের অস্বস্তি এবার চরমে। কী করবে বুঝতে পারছে না ও। আমি বেশ বুঝতে পারছি মাসুমের মনের অবস্থা। পারমিতা আবার ওকে তাগাদা করলো, “কী-হলো! যাচ্ছো না কেনো? তুমি না গেলে বসো, আমিই নিয়ে আসছি!” মাসুম একটুক্ষণ ইতস্তত করে ফিরে গেল উপরে সড়কের দিকে। আধো আলো আধো ছায়াতে বসে পারমিতা আর আমি মাসুমের অসহায় ফিরে যাওয়া পাঠ করলাম।

পারমিতার মন খুব খারাপ, চুপচাপ বসে ছিলো। আর কোনো মেয়ে হলে বসে বসে নীরবে চোখের জল ফেলতো; কিন্তু পারমিতা সহজে কাঁদবার মেয়ে নয়। সেদিন মরিচটালের পাশে বসে বাদাম খেতে খেতে পারমিতার সাথে সখ্য হয়ে গিয়েছিলো আমার। পারমিতা বলেছিলো, “সবুজ ভাই, এগ্রিভার্সিটিতে চান্স পেয়ে গেলেই আমি এবার এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যাচ্ছি। আপনি কিন্তু মাঝে মাঝে চলে আসবেন। দু’জনে মিলে বোটানিক্যাল গার্ডেনে বসে গল্প করবো আর আপনার কবিতা শুনবো। আমি কিন্তু আপনার কবিতা খুব পছন্দ করি।” আমি পারমিতার কথায় হাসলাম, “আমার কবিতা তুমি পেলে কোথায়, যে পছন্দ করে ফেললে?” পারমিতাও হাসলো, “হুম, তাহলেই বুঝুন; আপনি জানেন না, কিন্তু আমি আপনার কবিতার খোঁজ ঠিকই রাখি।” মাসুম এ সময় বাদাম নিয়ে এলো। আমি বললাম, “তোমার খোঁজখবর রাখবার জন্য তো মাসুম আছে, করিম ভাই আছে, আরও কতো মানুষ! আমার সুযোগ কোথায়?” পারমিতা আবার হাসলো, “সুযোগ দিচ্ছে কে আপনাকে? সুযোগ আপনার নিজের করে নিতে হবে। আর আমি যখন আশ্বাস দিচ্ছি সমস্যা কোথায়?” মাসুম এসে আমাদের পাশে বসলো এবং বাদাম খাওয়ায় মনোযোগী হলো। ওর খাওয়ার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, ও যেনো দ্রæত বাদাম খাওয়ার প্রতিযোগে নেমেছে। কে কত বেশি বাদাম খেতে পারে, আর কত তাড়াতাড়ি বাদাম শেষ করা যায়। আমি বাদাম খাচ্ছিলামই না, আর পারমিতা মাঝে মধ্যে দু’একটা বাদাম মুখে তুলছিলো। আমাদের অবাক করে দিয়ে পারমিতা হঠাৎ বলে উঠলো, “সবুজ ভাই, আমাকে আপনার সাথে নাটকে নেবেন? আমি কিন্তু ভালো অভিনয় জানি।” শব্দ করে হেসে উঠলো সে। মাসুমের মুখটা কালো হয়ে গেলো, সদ্য আলোকিত দ্বাদশ চাঁদের মৃদু আলোতেও মাসুমের মুখের উদ্বেগ পাঠ করা যাচ্ছিলো। নিজেকে সহজ করার চেষ্টা করে মাসুম বললো, “নাটক করলে আর পড়া-লেখা হবে না। নাটক করলে পড়বে কখন?” পারমিতা সিরিয়াস কণ্ঠে বললো, “যারা নাটক করে তারা কি লেখাপড়া করে না না-কি?” মাসুম পারমিতার কথায় ইতস্তত করছিলো। আমার কেনো জানি মনে হলো, পারমিতা এসব কথা আড্ডা পল্লবিত করার জন্যই বলছে। বললাম না কিছুই আমি; কিন্তু এবারে মনে হলো, পারমিতা সিরিয়াস, বললো, “না-না সবুজ ভাই আমি সিরিয়াস। দরকার হলে আমি আব্বার কাছ থেকে অনুমোতি নিয়ে আসবো। আপনি শুধু আমাকে নাটকটা শিখিয়ে দিন না, পরে তো আমি টেলিভিশনেও নাটক করবো।” আমি বিষয়টাকে সহজ করতে বললাম, “তুমি নাটক করলে ভালোই হবে, করবেও ভালো, মানাবেও ভালো। সবচেয়ে বড় কথা, নাটকে আমরা অসুন্দর মেয়েকেও গল্পের খাতিরে সুন্দরী বলি, সে ক্ষেত্রে তুমি আসলেই সুন্দরী হবে। তবে আমাদের সমাজ বিষয়টাকে সহজভাবে নেবে কি-না সেইটে গুরুত্বের।” মাসুম এবার তাগাদা দিলো, “আরে চলো চলো, আগে তো বাসায় যাই। নাটক করবে কি-না সেটা পরে বোঝা যাবে। চল, অনেক দেরি হয়ে গেলো, মা আবার রাগারাগি করবে।” ওরা দু’জন উঠে গেলো। যেতে যেতে পারমিতা বললো, “তাহলে কথা কিন্তু থাকলো সবুজ ভাই, আপনি আমাকে নাটকে নিচ্ছেন?” আমি হাসতে হাসতে বললাম, “অসুবিধা নেই নিয়ে নেবো।” ওরা দু’জন রাস্তায় উঠে গেলো। আমি দ্বাদশ চাঁদের আলোয় অনেক্ষণ ভিজলাম, আমার জ্যোৎস্নাস্নান দেখলো কৈশোরের সখা ব্রহ্মপুত্র। জ্যোৎস্নাজলে ভিজতে ভিজতে ব্রহ্মপুত্রের সাথে পারমিতাকে নিয়ে কথা হলো অনেক; আমার আকুতিগুলো ব্রহ্মপুত্র কবিতার পঙক্তি করে ফেরৎ পাঠালো, সেখানে পারমিতার বাদামের খোশা ছাড়াবার কথা এলো, কল্লোলিত হাসির কথা আর নিঃশব্দে ফিরে যাবার কথাও।

এমনিতেই সেদিন আমি পারমিতার রেজাল্টের খোঁজ নিতে গেলাম, মিতাভাবী বললেন, “ওর মনটা খুবই খারাপ। ওর খুব ইচ্ছা ছিলো এগ্রিভার্সিটিতে পড়বে কিন্তু চান্স পেলো না; ওয়েটিং লিস্টে অবশ্য আছে; চান্স পাবে কি-না কে জানে!” মাসুম হঠাৎ বললো, “অতো চিন্তার কী আছে, ও তো মেডিকেলেও আছে ওয়েটিং লিস্টে; ওখানে তো সিরিয়াল তিন, নিশ্চয়ই মেডিকেলে চান্স হয়ে যাবে।” আমি পরিবেশটা সহজ করতে বললাম, “ভালোই তো পারমিতা ডাক্তার হবে। অসুখ-বিসুখে আমাদের নাড়ি টিপবে।” এবার পারমিতা ছ্যাঁৎ করে উঠলো, “আরে আমি তো ডাক্তার হতেই চাই না! মানুষ কাটাকুটি আমার ভালোই লাগে না।” আমি তাকে আস্বস্ত করে বললাম, “সব ডাক্তারই পেট কাটে না-কি? তুমি মেডিসিনের ডাক্তার হবে, না হয় চোখের।, মানুষের চোখের ভাষা পড়বে।” এবার পারমিতা হাসলো, “চোখ দেখে মনের খোঁজ নেয়া হলো কবির কাজ, আমার চোখ দেখে মনের কথা কিছু বলুন তো শুনি?” আমি পারমিতার মনের আনন্দটা ধরে রাখতে বললাম, “মাথা খারাপ! তোমার চোখে তাকিয়ে থাকলে আমি তো পলকেই মূর্ছা যাবো, মনের কথা বলবো কখন?” পারমিতা হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টায়, “আচ্ছা সবুজ ভাই আপনি হাত দেখতে পারেন?” আমি রহস্য করে হাসলাম, তারপর বললাম, “হাত দেখতে না পারার কী আছে?

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App