×

সাময়িকী

গল্প হতেই পারে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ ডিসেম্বর ২০২০, ০৯:১৭ পিএম

গল্প হতেই পারে

এক. গল্পটা লিখতে গিয়ে পেছনে ফিরে যায় দীপান্বিতা। এ মুহূর্তে দৃশ্যপট থেকে উধাও হয়ে যায় শনিবারের বিকেল, নয়টা পাঁচটার ঘূর্ণন। বাস চলছে দুলকি চালে। বাসযাত্রী সবাই রঘুনাথ সরকারি মহাবিদ্যালয়ে ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র-ছাত্রী। তারুণ্যের আনন্দ-বেদনা আর উদ্যমের মাঝে কাটিয়েছে ওরা সারাদিন। সারাদিনের বনভোজনের আনন্দ ফিরে যাবার ব্যথায় মাঘের সূর্যালোকের মতো ম্লান মনে হয়। দ্যুতি আর নিবিড় বসেছে পাশাপাশি সিটে। সামনের সিটে দ্যুতির মাথা ঠেকানো। - কিরে কি হয়েছে? নিবিড় জানতে চায়। - একটু মাথা ধরেছে। আস্তে করে জবাব দেয় দ্যুতি। ততক্ষণে মেখলা বিথি নাজনীন ইমন শামীমসহ সবাই গান ধরেছে- বেশি কিছু আশা করা ভুল বুঝলাম এতদিনে...। দ্যুতি মাথা তুলে নিবিড়ের দিকে চেয়ে বাসের বাইরে তাকায়। নদীর পাড়ে এখানে ওখানে বিক্ষিপ্ত খড়ের স্ত‚প। দু’একটা পাখি উড়ে যাচ্ছে, সূর্য ক্রমেই ম্লান হয়ে যাচ্ছে। নিবিড় সিট থেকে উঠে গিয়ে সবার সঙ্গে গানে যোগ দেয়। দ্যুতি সিটে বসেই গানে গলা মেলায় কিন্তু কোথায় যেন কোমল বেদনা অনুভ‚ত হয়। পরের দিন। শীতের দুপুর বেলা কলেজ থেকে ফিরছে দীবা, রুমী, নীলাসহ দ্যুতি। বাতাসে বসন্তের আগমনী ঘ্রাণ কড়ই গাছের ডিম্বাকার পাতাগুলো ঝরে পড়ছে টুপটাপ। এরই মাঝে সাইকেলের বেল বাজিয়ে পাশে এসে দাঁড়ায় রবীন আর নিবিড়- এই দ্যুতি বিকালে তোর বাসায় যাবো একটু দরকার আছে। আবার টো টো করতে বেরিয়ে যাস না কোথাও। গতকাল থেকে দ্যুতির মাথাব্যথা ভালো হয়নি, তার ওপর নিবিড়ের কথা বলার ভঙ্গি দ্যুতির গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। - আমি বাসায় থাকবো না টো টো করে বেড়াবো তাতে তোর কি? নিবিড় হাসতে থাকে। - আরে বাবা এত রেগে যাচ্ছিস কেন? একটু মজা করতে পারি না? বেল বাজিয়ে চলে যায় নিবিড়ের সাইকেল।

দুই. গল্পের শুরুটা লিখে ভাবনায় ডুব দেয় দীপান্বিতা। গল্পের পরের ধাপ ভাবতে থাকে। টেবিলে শীতের ক্ষীণ রোদ্রচ্ছটা। শনিবারের বিকেলটা দীপার একান্ত নিজের। ডোরবেল বেজে ওঠে দীপা উঠে গিয়ে দরজা খুলে, রাজন দাঁড়িয়ে থেকে প্রশ্ন করে- সারাদিন কেমন কাটল? রাজনকে ঈর্ষান্বিত করার জন্য দীপা বলে- ফার্স্ট ক্লাস। - আহা তোমার মতো দু’দিন ছুটি যদি পেতাম! হাই তোলে রাজন। দীপা খাতাপত্র গুছিয়ে রেখে বলে, তুমি শাওয়ার নাও আমি চা করছি। তারপর চা খেতে খেতে নতুন গল্পটা শেয়ার করবো তোমার সাথে। ড্রয়ার খুলে ফতুয়া নিতে গিয়ে লন্ড্রি করা কাপড়ের সাথে দেয়া নিউজ পেপারের লেখায় চোখ যায় রাজনের। দিগন্ত বিস্তৃত রাজধলা বিল। আসন্ন সন্ধ্যায় উড়ে যাচ্ছে জানা অজানা পাখির দল। টুপ করে জলে আওয়াজ তুলে মাছেরা। সূর্য ডুবছে তারই লাল আভা আকাশজুড়ে। থিরথির করে কাঁপছে বিলের পানি। ঠিক তখনই নিস্তব্ধতাকে ছিন্ন করে একজন- আমি তোকে ভালোবাসি। এই বিল সাক্ষী আর সাক্ষী তোর চোখের আলো। তুই হাসছিস? -খুব বেশি নাটকীয় হয়ে যাচ্ছে না শিখা? আচ্ছা অমল কোনটা নাটকীয়তা, আমার এ ভালো লাগার অনুভ‚তি না তোর কপটতা। কথা বলতে বলতে আনমনা দেখায় শিখাকে। অমলকে খানিকটা দিশাহারা মনে হয়, মমতা মাখানো কণ্ঠে বলে উঠে- তুই আমাকে ভুল বুঝছিস। - কিরে আমার অমিত আর লাবণ্য কোথায় গেল? নির্দেশক পরিচালক তরুণদার হাঁক শুনে দু’জনেই বিলের পাড় থেকে কলেজ প্রাঙ্গণে আসে। সামনের সপ্তাহে কলেজের নবীনবরণ উপলক্ষে শেষের কবিতার মঞ্চায়ন হবে। অমল আর শিখা অভিনয় করছে অমিত ও লাবণ্য চরিত্রে। অমল ও শিখা দু’জনই ভালো বন্ধু কিন্তু ক’দিনের রিহার্সেলে শিখার দুর্বলতা প্রকাশ পায় অমলের প্রতি। ক’দিন থেকে অমল খেয়াল করছে শিখার পরিবর্তন। রিহার্সেলের এক পর্যায়ে কেটি এসেছে মহামায়ার বাড়িতে, হঠাৎ প্রচণ্ড ধুলাবালি উড়িয়ে শুরু হয় ঝড়। পৃথিবীর বুকের জমাট অভিমান উড়ে যায় দমকা হাওয়ায়। ঝড় জল ছাপিয়ে নাটকের পাত্র-পাত্রীরা গান ধরে- বৈশাখী ঝড় এলো এলোরে...। ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে অমল খেয়াল করে রুমের মধ্যে শিখা নেই। জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বিদ্যুৎচ্ছটায় একটি ছায়ামূর্তি চোখে পড়ে। প্রচণ্ড বাতাস উপেক্ষা করে বাইরে যায় অমল। -শিখা তুই বাইরে কেন? জোর করে হাত ধরে রুমে নিয়ে আসে অমল। গল্পটা এ পর্যন্ত পড়ার পর রাজন দেখে বাকিটুকু ছেঁড়া। কখনো কখনো পূর্বধলা স্টেশনে পৌঁছে রাজন দেখতো ট্রেন চলে গেছে। পরের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায় থাকতো না তার। গল্পটা পড়ার পর নিজেকে ট্রেন ফেল করা যাত্রীর মতো হতোদ্যম মনে হয় রাজনের। - কি হলো ফ্রেশ হও, চা নিয়ে আসছি। দীপার কথায় সম্বিত ফিরে আসে রাজনের। - হ্যাঁ আসছি, একটু অপেক্ষা করো। বিদ্যুৎ চলে যায়। প্রতিদিনের মতো শুরু হয় লোডশেডিং। মোম হাতে বাথরুমে ঢোকে রাজন। জোরে শাওয়ার ছাড়ে। গোসল সারতে সারতে রাজন একটু আগে পড়া গল্পের বাকি অংশ কল্পনা করতে থাকে। -এই ঝড়ে তুই বাইরে ভিজছিলি কেন? অমল বলে। শিখা অমলের দিকে তাকিয়ে, -শোন, এই ঝড় অন্তত তোর মতো নির্দয় না। আমার কিচ্ছু হবে না। - না হলেই ভালো। অন্তত নাটকটা ভালোভাবে মঞ্চস্থ হলে বাঁচি। শিখাকে বাইরে থেকে হাত ধরে টেনে আনার সময় কথাগুলো বলে। অমল শিখার সামনে এটা বললেও মনে মনে ভাবেÑ তোর মাথার যা অবস্থা! শেষ পর্যন্ত যে কি হয়! ঝড়-বৃষ্টি থেমে যায় কিছুক্ষণ পর। সেদিন আর রিহার্সেল হয় না। ঝড়ের পরে প্রকৃতি আবার শান্ত। পথে যেতে যেতে অমল প্রশ্ন করে শিখাকে।- কাল রিহার্সেলে আসবি তো? শিখা অমলের দিকে তাকিয়ে হ্যাঁসূচক ইঙ্গিত দেয় তবে মুখে কোনো কথা বলে না। শিখার মনের মধ্যে বয়ে যাওয়া ঝড়ের আভাস অমল জানতে পারে না। শিখাকে বাড়ি পৌঁছিয়ে ফেরার পথে অমল ভাবতে থাকে- এই প্রাণবন্ত মেয়েটির বন্ধুত্ব তাকে আকর্ষণ করে। কিন্তু বন্ধুত্বের বাইরে অন্য কোনো সম্পর্কের কথা সে ভাবতে পারে না। বাইরে থেকে দীপা দরজায় টোকা দেয়। এই এতক্ষণ কি করো। চা নিয়ে বসে আছি যে। রাজন দীপা চায়ের ফাঁকে ফাঁকে লেখালেখি নিয়ে কথা বলে। রাজন পুরনো পত্রিকার অসমাপ্ত গল্পটা পড়ে শোনায় দীপাকে। অন্যদিকে দীপা বলতে থাকে- জানো রাজন, একটা গল্প শুরু করেছিলাম কিন্তু চরিত্রের গভীরে যেতে পারছি না বলে আফসোস হচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে গল্পটা আবার শুরু করি। রাজন চায়ের কাপ টেবিলে রেখে দীপাকে বলে বারবার লেখ। তোমার চারপাশের লোকজনকেই খুঁটিয়ে দেখো, দেখবে একসময় চরিত্রের গভীরে যেতে পারছো। বাইরে তাকায় দীপা। আঁধারে তলিয়ে যাচ্ছে চারপাশ। মেঘের আড়ালে চাঁদ উঁকি মারার চেষ্টা করছে। নগরের বসতির পাশাপাশি সবুজ গাছপালাগুলো আমাদের নিশ্বাস নেবার সুযোগ করে দেয়। বেঁচে থাকবার লড়াইয়ের গল্পগুলো পুরানো। উঁচু নিচু ভেদে সেগুলোর ভিন্নতা আছে। বিশ্রামরত রাজনের দিকে তাকিয়ে দীপান্বিতা নতুন আঙ্গিকে লেখার কথা ভাবে।

তিন. বৃষ্টি ঝরছে একটানা। স্মৃতি ভালো করে শাড়ির আঁচল গায়ে জড়িয়ে নেয়, গুটিশুটি মেরে শুয়ে জানালা দিয়ে বৃষ্টি দেখে। ক’দিন আগেও সবুজ আমে ভরাছিল গাছটা আর এখন সব আম পেকে ঝরে পড়েছে। বৃষ্টির সঙ্গে বাতাসে গাছের ডালগুলো পাতাসহ বারবার নুয়ে পড়ছে। মাঝে মাঝে ধাক্কা দিচ্ছে টিনের চালে। নিজের মনে বারবার ঘটনাটা উল্টেপাল্টে দেখছে স্মৃতি। গতকাল সাখাওয়াতের বলা কথাগুলো তাকে নাড়া দেয়। -রেজোয়ান তোমাকে কিছু বলবে মনে হয়। সাখাওয়াতের হেঁয়ালি ভরা কথা স্মৃতির ভালো লাগে না তাই বিরক্তি নিয়ে জানতে চায়- কি বলবে কোনো কাজের কথা হয়তো, তাতে আপনার এত উৎসাহ কেন? সাখাওয়াত মুচকি হাসে, স্মৃতির কথার উত্তর দেয় না। এ ধরনের অনিশ্চয়তার মাঝে রেখে সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বেরিয়ে যায় সাখাওয়াত। সাখাওয়াত স্মৃতির চেয়ে বছর আট-দশের বেশি বড় হবে। তাই বন্ধুত্বের মাঝে একটা বড়ভাই ছোটবোন সুলভ সম্পর্ক রয়েছে। রেজোয়ান স্মৃতির চেয়ে অল্প কয়েক বছরের বড়, ছিমছাম গড়নের এই যুবককে স্মৃতির ভালোই লাগে তবে কখনো ভালোলাগা থেকে মনের নাগাল ধরবার চেষ্টা করেনি দু’জনের কেউই। যেমন সাংগঠনিক কাজ-কর্ম শেষে অনেক সময় বাড়তি আড্ডা দেয়ার সময় থাকে কিন্তু রেজোয়ান তা করে না। একবার পত্রিকার প্রকাশনা উপলক্ষে বেশ রাত হয়ে যায় বাসায় ফিরতে তাই স্মৃতি রেজোয়ানকে বলেছিল- আমাকে একটু বাসস্টপ পর্যন্ত এগিয়ে দেবেন? দৃঢ়কণ্ঠে রেজোয়ান পাল্টা জবাব দিয়েছিল- আপনারা না নারীমুক্তি চান কথায় কথায় সমানাধিকারের প্রশ্ন তোলেন তাহলে আবার অন্যের সহযোগিতা চাইছেন কেন? এ নিয়ে বিস্তর তর্ক-বিতর্ক করা যেত কিন্তু স্মৃতির ইচ্ছে করেনি কোনো কথা বলতে। একাই অন্ধকারে হেঁটে বাসের জন্য রওনা দিয়েছিল। এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে স্মৃতি। রুমমেট লুবনার ডাকে ঘুম ভেঙে যায়- স্মৃতি আপা, দেখেন কে এসেছে? ঘুম জড়ানো চোখে তাকিয়ে দেখে খালিদ ভাইকে। আব্দুল খালেদ স্মৃতি রেজোয়ান সাখাওয়াত সবার নেতা। সচারাচর স্মৃতির বাসায় আসে না। স্মৃতি ওয়াশরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানির ছিটা দিতে দিতে খালেদ ভাইয়ের আসার সম্ভাব্য কারণ ভাবতে থাকে। লুবনা তাড়া দেয়- তোমার সঙ্গে জরুরি কথা আছে ভাইয়ার, তুমি কথা বল আমি চা করছি। লুবনা চায়ের পানিতে চা পাতা দেয়ার ফাঁকে শুনতে পায় খালেদ ভাইকে স্মৃতি বলছে- ভাই কোথাও কোনো সমস্যা হয় নাই তো। সমস্যা না থাকলে খালেদের মতো লোক তার বাসা পর্যন্ত আসার কথা নয় মনে মনে ভাবে সে। -সমস্যা ভাবছেন কেন ভালো কিছুও তো ঘটতে পারে, হাসতে হাসতে খালেদ বলে। -গতকাল সাখাওয়াত ভাই কি সব হেঁয়ালি কথাবার্তা বলছিল আমি বুঝতে পারিনি। তাই ভাবছিলাম- স্মৃতির মুখে সাখাওয়াতের নাম শুনে খালেদের চোয়াল শক্ত হয়; চশমা খুলে বলে- সাখাওয়াতকে তো আমি বারবার না করেছি আপনাকে কিছু বলতে, তারপরও বলেছে! স্মৃতি সহজ করার জন্য বলে- না, তেমন কিছু বলেনি। চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে খালেদ শুরু করে- মধ্যবিত্ত ভদ্রতার প্রয়োজন নেই খোলাখুলি বলি, -রেজোয়ান আপনাকে তার ভালো লাগার কথা আমাকে জানিয়েছে। স্মৃতি কিছু বলতে যাবে, খালেদ থামিয়ে দিয়ে বলে- আমার কথা এখনও শেষ হয়নি, প্রশ্ন করতে পারেন এই যুগে এসে রেজোয়ান তার ভালোলাগার কথা আপনাকে সরাসরি না বলে আমাকে বলতে গেল কেন? আমাদের মতো দেশে একজন নারী সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক যে কোনো ক্ষেত্রে হোক; কাজ করতে গেলে পুরুষেরা সহকর্মী-সহযোদ্ধা না ভেবে প্রথমেই প্রেমিকা ভাবতে শুরু করে। এ ধরনের ঘটনার সম্মুখীন আপনি হয়েছেনও- ওদের একতরফা ভালো লাগার জন্য আপনাকে অহেতুক চাপ নিতে হয়েছে। সিরিয়াস কথাগুলো শুনতে শুনতে স্মৃতি হেসে ফেলে- সেজন্য উনি আপনাকে মিডিয়া হিসেবে নিয়েছেন কিন্তু আমি এ ব্যাপারে কি করতে পারি? স্মৃতির দিকে তাকিয়ে খালেদ হাসে- ধরেন, আপনি কোনো প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করেন অথবা কোনো সংগঠন, সেখানে ১০-১২ জন পুরুষ রয়েছে আপনি কীভাবে হ্যান্ডল করবেন, নিজেই ভাবুন। স্মৃতিকে ভাবনার দায়িত্ব দিয়ে করমোদন করে বিদায় নেয় খালেদ। রেজোয়ানের মিটিং ছিল বুড়িগঙ্গার পাড়ে। কি কারণে যেন শ্রমিকরা উপস্থিত হতে পারেনি! রেজোয়ান হাঁটতে থাকে। গতকাল খালেদ ভাইকে জানিয়েছে কমরেড স্মৃতিকে ভালো লাগার কথা। তার প্রতি উত্তরে খালেদ গম্ভীর স্বরে বলেছিলেন- আমাকে কেন বলছেন, সরাসরি স্মৃতিকে বলতে পারতেন। -হ্যাঁ বলতে পারতাম- রেজোয়ান খালেদের চোখের দিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়। -তাহলে? -যে কোনো নারী সমাজের চৌকাঠ পার হলে পুরুষরা সবাই তার দিকে ছুটে আসে। বিভিন্নভাবে তাকে কাছে পাওয়ার চেষ্টা করে। সে কারণে এত বছর একসঙ্গে কাজ করলেও আমি সচেতন ছিলাম যাতে কোনোরকম দুর্বলতা প্রকাশ না পায়। রেজোয়ানের কাঁধে হাত দিয়ে স্পর্শ করে খালেদ- সে ব্যাপারে আপনি সফল হয়েছেন কমরেড। আপনারা দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ পরস্পরকে ভালো লাগার কথা বলতেই পারেন। পার্টিও চায় আপনাদের মতো পেটি বুর্জোয়া শ্রেণি থেকে আসা শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের শ্রেণি অনুশীলনের মাধ্যমে পারস্পরিক জুটি হয়ে উঠুক। তাহলে কেবল বিপ্লবে আমরা দৃঢ় নেতৃত্ব পাবো। আপনি বিষয়টি তাকে সরাসরি বলতে পারেন। -তা পারি কিন্তু স্মৃতির দিক থেকে কোনো দুর্বলতা না থাকলে সেক্ষেত্রে আমি এক পা-ও এগোবো না, এই সিদ্ধান্তও আমার নেয়া আছে অতএব আপনাদের দুশ্চিন্তার কারণ নেই; আমি কাটিয়ে উঠতে পারবো। দু’দিন আগে বলা কথাগুলো নিয়ে মনের মধ্যে নাড়াচাড়া করছিল রেজোয়ান। নিজের ভেতরে এতটাই বিভোর ছিল যে একটা বাস কাছ ঘেঁষে চলে গেলো; সজাগ হয় সে। স্মৃতি যখন জানলো রেজোয়ান তার প্রতি দুর্বল তখন ভালো লাগার পাশাপাশি মিশ্র অনুভ‚তি কাজ করলো। পারিবারিক আবহের কারণে প্রচলিত ব্যবস্থায় নারীরা পুরুষদের প্রতি যে ধরনের কৌত‚হল অনুভব করে স্মৃতির মধ্যে তা ছিল না। সবসময় ভাবতো- যাকে ভালো লাগবে সরাসরি জানাবে কোনো আড়াল না রেখে কিন্তু বাস্তব জীবনের ঘটনাগুলো সেরকম ঘটেনি। রেজোয়ানের ব্যাপারে একটা ভালো লাগা অনুভ‚তি থাকলেও তা প্রকাশ করা হয়ে উঠেনি। বরং অন্য দু’একটি ঘটনা এক্ষেত্রে স্মৃতির বিরক্তির উদ্রেক করেছে। নিজেকে কিছুটা গুটিয়েই নিয়েছিল সে। রেজোয়ানের ভালোলাগার ব্যাপারটাতে তাই দু’ধরনের প্রতিক্রিয়া হলো এক, রেজোয়ানের ব্যাপারে আমি কি কোনো ধরনের আগ বাড়ানো ইন্ধন জুগিয়েছি? দুই, সমমনা দু’জন মানুষের প্রেম হতে দোষ কি? স্মৃতির মনে পড়ে সেদিন প্রথম কাজীপাড়া বাসস্টপ পর্যন্ত এসেছিল রেজোয়ান। কিছুটা আনমনা এবং খাপছাড়া ভাব দেখে স্মৃতি প্রশ্ন করেছিল- কিছু বলবেন? প্রশ্নটা শুনে দ্বিধান্বিত মনে হয়েছিল রেজোয়ানকে। স্মৃতি তার ব্যাগ থেকে একটা পেয়ারা বের করে খেতে দিয়েছিল রেজোয়ানকে- নেন বাড়ি থেকে এনেছি। রেজোয়ানের চোখের আলো লক্ষ করেছিল স্মৃতি। কিন্তু আর এগোয়নি দু’জন। কাজের কথায় এগিয়েছিল তারা। যে কেউ কোনো বন্ধুকে পেয়ারা বা পকেট ক্যালেন্ডার দিতে পারে যে কোনো কমরেডকে অসুস্থতায় ডাক্তার দেখাতে পারে। জ্বর তপ্ত শরীরে কপালে আঙুল ছুঁইয়ে তাপমাত্রা পরিমাপ করতে পারে সে নারী বা পুরুষ যেই হোক না কেন। এসবকে সহকর্মী বা বন্ধু হিসেবে নিতে পারার মতো সমাজ বাস্তবতা আমাদের সমাজে নেই তা নারী হিসেবে স্মৃতির অভিজ্ঞতার ঝুলি কেবল সমৃদ্ধই হয়েছে। রেজোয়ানকে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম মনে হয়েছে স্মৃতির। রেজোয়ান ও স্মৃতি দু’জনেরই এতদিনের পথচলা সমান্তরাল গতিতে চলছিল এবার প্রয়োজন বোধহয় একটা বিন্দুতে মিলিত হবার। লেখা শেষ হলে কাগজ-কলম গুছিয়ে রাখে দীপা।

চার. এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল দীপার। লেখার টেবিলে বসতে পারেনি। আজ আবার কাগজ কলম নিয়ে লেখার টেবিলে বসেছে সে। কম্পিউটার ল্যাপটপের বদলে ডায়েরিতে লেখা তার পছন্দ। দু’টি ঘটনা লেখার পর একটু ভিন্নভাবে লেখার চেষ্টা করে সে। এক সময়ের তুখোড় রাজনৈতিক কর্মী ছিল রেজোয়ান। বন্ধু রেজোয়ানের ঘটনাটাকে গল্পে রূপ দেয়ার চেষ্টা করে দীপা। বাতাস এলে গাছের পাতার শব্দ যেমন আন্দোলিত করে মন তেমনি হাজারো ঘটনা ও স্মৃতির পাতারা আন্দোলিত হতে থাকে দীপার মন জুড়ে...

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App