×

সারাদেশ

মধ্যপাড়া খনিতে সাত মাসে ২২৪ কোটি টাকার পাথর বিক্রি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২০, ০৫:৪১ পিএম

মধ্যপাড়া খনিতে সাত মাসে ২২৪ কোটি টাকার পাথর বিক্রি
পার্বতীপুরে মধ্যপাড়া খনিতে করোনাকালীন সময়ে গত সাত মাসে রেকর্ড পরিমাণ ৯ লাখ মেট্রিক টন পাথর বিক্রি হয়েছে। এ থেকে রাজস্ব আয় হয়েছে ২২৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। পেট্রোবাংলার এই প্রতিষ্ঠানটি গত (২০১৯-২০) অর্থবছরে ৮ লাখ ৬৫ হাজার মে.টন পাথর বিক্রি করে প্রায় ২১ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। এ নিয়ে পরপর দু’বছর খনিটি লাভের মুখ দেখলো। চলতি (২০২০-২১) অর্থবছরে আরও বেশী মুনাফা হবে বলে খনি কর্তৃপক্ষ আশা করছে। খনির উৎপাদন, রক্ষনাবেক্ষণ ও পরিচালন ঠিকাদার জিটিসি’র ইউরোপিয়ান সুদক্ষ প্রকৌশলীদল ও দেশীয় খনি শ্রমিকদের প্রচেষ্টায় পূর্ণমাত্রায় গড়ে প্রতিদিন ৫ হাজার মে.টন পাথর উৎপাদন করায় এবং খনি কর্তৃপক্ষ পাথর বিক্রিতে কার্যকরী উদ্যোগ নেওয়ায় তা সম্ভব হয়েছে। এদিকে, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান জিটিসি’র চুক্তি মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় খনি কর্তৃপক্ষ নতুন ঠিকাদার নিয়োগের দরপত্র আহবান করে ফেব্রুয়ারি মাসে। করোনার কারণে দরপত্র দাখিলের সময় কয়েক দফা বাড়িয়ে তা ২০ ডিসেম্বর করা হয়। নতুন ঠিকাদার নিয়োগ করা হলে খনির পাথর উৎপাদনের বর্তমান ধারা অব্যাহত রাখা যাবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। উৎপাদন কমে গেলে আবারও খনিটি লোকসানের মুখে পড়ার আশংকার কথা জানিয়েছেন মধ্যপাড়া খনি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতা ও এলাকাবাসী। এ অবস্থায় তারা জিটিসি’র সাথে চুক্তি নবায়নের আহবান জানিয়েছে। জানা গেছে, করোনাভাইরাজের কারণে তিন মাস বন্ধ থাকার পরও ২০১৯-২০ অর্থবছরে মধ্যপাড়া খনি থেকে ৮ লাখ ২৩ হাজার ৯৫৯ মে.টন পাথর উৎপাদন করা হয়। এসময়ে বিক্রি হয়েছে ৮ লাখ ৬৪ হাজার ৯০৬.৫২ মে.টন পাথর। এ থেকে মুনাফা হয়েছে প্রায় ২১ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে উৎপাদন হয় ১০ লাখ ৬৭ হাজার ৬৪৬ মে.টন পাথর। এরমধ্যে ৭ লাখ ৩১ হাজার ৪৯৩ টন পাথর বিক্রি করে মুনাফা হয়েছে ৭ কোটি ২৬ লাখ টাকা। শুধুমাত্র গত এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সাত মাসে করোনাকালিন অবস্থাতেই ৯ লাখ ১ হাজার ৫০০ টন পাথর বিক্রি করে রাজস্ব আয় হয়েছে ২২৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। সুত্র জানায়, ২০০৭ সালের ২৫ মে মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানী লিমিটেড (এমজিএমসিএল) বাণিজ্যিক উৎপাদনে যায়। উৎপাদন শুরুর পর থেকে নানা প্রতিকুলতার কারণে পেট্রোবাংলা প্রতিদিন তিন শিফটে ৫ হাজার মে.টন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে এক শিফটে গড়ে ১ হাজার মে.টন পাথর উত্তোলন করে আসছিল। এরফলে ২০১৩ সালের জুন পর্যন্ত ৬ বছরে খনিটি লোকসান দেয় প্রায় একশ কোটি টাকা। এ অবস্থায় খনির উৎপাদন ও রক্ষনাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয় বেলারুশের জেএসসি ট্রেস্ট সকটোস্ট্রয় ও দেশিয় প্রতিষ্টান জার্মানিয়া করপোরেশন লিমিটেড নিয়ে গঠিত জার্মানিয়া ট্রেস্ট কনসোর্টিয়ামকে (জিটিসি)। জিটিসি’র সাথে চুক্তি সাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুযায়ী তারা ৬ বছরে ১৭১.৮৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে ৯২ লাখ মে.টন পাথর উত্তোলন করে দিবে। বেলারুশের খনি বিশেষজ্ঞ এবং দেশীয় প্রকৌশলীসহ প্রায় সাড়ে ৭শ’ খনি শ্রমিক নিয়ে তিন শিফট চালু করে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫ হাজার মেট্রিক টন পাথর উত্তোলনের সক্ষমতা অর্জন করে জিটিসি। চুক্তি অনুযায়ী উৎপাদন সহায়ক সবধরণের মাইনিং ইক্যুইবমেন্ট (খনন যন্ত্র) সরবরাহ করার কথা খনি কর্তৃপক্ষের। কিন্তু খনি কর্তৃপক্ষ অর্থসংকট সহ নানা কারণে সময়মত বিদেশ থেকে তা আমদানী করতে পারেনি। ফলে মাইনিং ইক্যুইবমেন্টের অভাবে উৎপাদন শুরুর দেড় বছরের মাথায় ২০১৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পাথর উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে প্রায় ২ বছর পাথর উৎপাদন বন্ধ থাকে। এরই মধ্যে জিটিসির সাথে চুক্তি মেয়াদ শেষ হয়ে যায় চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি। এ সময়ের মধ্যে জিটিসি পাথর উত্তোলন করে প্রায় ৩৭ লক্ষ মেট্রিক টন। জিটিসি’র মতে প্রয়োজনীয় মাইনিং ইক্যুইবমেন্ট এবং এক্সপ্লোসিভের (বিস্ফোরক) অভাবে তারা ৩ বছর খনিটি পরিচালনা করতে পারেনি। এ জন্য মধ্যপাড়া খনি কর্তৃপক্ষকে দায়ী করে জিটিসি ৩ বছর সময় এবং যন্ত্রাংশ ক্রয় বাবদ ৩০৩ কোটি টাকা দাবি করে। বিষয়টি এক পর্যায়ে আরবিটেশন ট্রাইবুনাল পর্যন্ত গড়ায়। আরবিটেশন ট্রাইবুনাল স্থিতিঅবস্থা দিলে তা জিটিসি’র পক্ষে যায়। উভয়পক্ষের এই অচলাবস্থার মধ্যে ২০১৯ সালের নভেম্বর এবিএম কামরুজ্জামান এমজিএমসিএল-এ ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে যোগদান করে জিটিসি’র সাথে বিরোধ নিরসনে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি পেট্রোবাংলার মহাব্যবস্থাপক (জিএম-নিরীক্ষা) শাহনেওয়াজ বেগমের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। এমজিএমসিএল-জিটিসি’র মধ্যে চুক্তি সমাপ্তিকরণ ও দেনাপাওনা নিরুপন, যথাসময়ে স্টোপ উন্নয়ন ও পাথর উৎপাদন না হওয়ার কারণসমুহ চিহ্নিতকরণসহ দায়-দায়িত্ব নির্ধারণ, অন্তর্বর্তীকালীন খনির উৎপাদন কার্যক্রম সচল রাখার জন্য করণীয় এবং নিয়োমিত ঠিকাদার নিয়োগ ইত্যাদি বিষয়ে কমিটির মতামত চাওয়া হয়। কমিটি যথাসময়ে স্টোপ উন্নয়ন ও পাথর উৎপাদন না হওয়ার জন্য এমজিএমসিএল-জিটিসি উভয়পক্ষকে দায়ী করে করণীয় নির্ধারণ করে ৯ ফেব্রুয়ারি পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যানের নিকট প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনে অন্তর্বর্তীকালীন ডিপিএম পদ্ধতিতে অভিজ্ঞ ঠিকাদার নিয়োগ, খনির উৎপাদন সচল রাখতে জিটিসি’র সাথে চুক্তি মেয়াদ এক বছর বৃদ্ধি করা, চুক্তি মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই খনি বুঝিয়ে নেওয়া এবং নিয়োমিত ঠিকাদার নিয়োগ করা ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ করা হয়। এমজিএমসিএল নিয়োমিত ঠিকাদার নিয়োগের উদ্যোগ নিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসেই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। করোনার কারণে দরপত্র দাখিলের সময় কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে তা ২০ ডিসেম্বর করা হয়। পাশাপাশি জিটিসি’র চুক্তি মেয়াদ ১ বছর বৃদ্ধি করা হয়। জিটিসি’র সাথে সাইট লেটার এগ্রিমেন্ট সাক্ষরিত হয় ২৯ জুলাই। ২০২১ সালের ১৭ জুলাই জিটিসি’র চুক্তি মেয়াদ শেষ হবে। নতুন চুক্তি অনুযায়ী ১ বছরে জিটিসি ১.১ মিলিয়ন মে.টন পাথর উৎপাদনের পাশাপাশি খনি ভূগর্ভে দু’টি স্টোপ উন্নয়ন করে দিবে এবং অন্যান্য উৎপাদনশীল স্টোপ সমুহে ১.১৮ মিলিয়ন মে.পাথর মজুদ রেখে যাবে। উভয়পক্ষে সমঝোতা হওয়ায় আরবিটেশন ট্রাইবুনাল থেকে জিটিসি অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেয় বলে সুত্র জানায়। এমজিএসিএল’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবিএম কামরুজ্জামান বুধবার (২ ডিসেম্বর) জানান, মধ্যপাড়ার পাথর ব্যবহারে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রনালয়ের আহবানে সাড়া দিয়ে রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পদ্মা রেল লিংক প্রকল্প, রেলপথ ও সড়ক সেতু মন্ত্রনালয়সহ বহু সরকারি প্রতিষ্ঠান তাদের নির্মাণ কাজে মধ্যপাড়ার পাথর ব্যবহার করেছে। সরকারি এ উদ্যোগে মধ্যপাড়ার পাথরের চাহিদা ও বিক্রি বৃদ্ধিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তাছাড়া মধ্যপাড়া খনির পাথর বিশ্বমানের হওয়ায় বিভিন্ন বেসরকারী নির্মাণ প্রতিষ্ঠান আগ্রহী হয়ে ওঠেছে। এক প্রশ্নে জবাবে তিনি বলেন, এখন প্রতিদিন উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৫ হাজার মে.টন পাথর এবং বিক্রিও হচ্ছে ওই পরিমাণে। বর্তমানে খনি ইয়ার্ডে প্রায় ২ লাখ মে.টন পাথর মজুদ রয়েছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App