×

জাতীয়

পাহাড়ে শান্তি কোন পথে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২০, ০৯:৩৬ এএম

পাহাড়ে শান্তি কোন পথে

ফাইল ছবি

শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন চায় পাহাড়িরা চুক্তি বাস্তবায়নে প্রচেষ্টা অব্যাহত : সরকার

দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসান ঘটিয়ে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। ২৩ বছর আগে স্বাক্ষরিত এই চুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ে কিছু দিনের জন্য রক্তপাত বন্ধ হলেও চুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হওয়ায় দিনে দিনে অশান্ত হয়ে ও ঠে পাহাড়। একটি হিসাব অনুযায়ী, গত দুই দশকে পাহাড়ি আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যকার নানা দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কারণে আট শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত ও পঙ্গু হয়েছেন আরো অনেকে। স্থানীয়রা মনে করেন, শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না হলে পাহাড়ে শান্তি ফিরবে না। আর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, চুক্তি বাস্তবায়নের চেষ্টা অব্যাহত আছে। জানা গেছে, পার্বত্য শান্তিচুক্তির আলোকে স্থানীয় সরকারের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান পার্বত্য জেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। এতে সরকার মনোনীত কমিটির মাধ্যমে পরিষদগুলো পরিচালিত হচ্ছে। চুক্তি অনুযায়ী, স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়নের মাধ্যমে পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।

এদিকে পাহাড়ের দলগুলোর মধ্যে অস্থিরতার কারণে দিন দিন বাড়ছে আঞ্চলিক সংগঠনের সংখ্যা। নতুন নতুন দলে রূপান্তরিত এসব উপদলের সন্ত্রাসী কার্যক্রম ও চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ পাহাড়ের বাসিন্দারা। এ অবস্থায় পাহাড়ের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তারে যৌথবাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান চালানোর দাবিও তুলেছেন কেউ কেউ। প্রতিনিয়ত হামলা-পাল্টা হামলায় বিপর্যস্ত পার্বত্য এলাকার অর্থনীতিও।

১৯৭৩ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি বা জেএসএস গঠিত হয়। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম এবং গেরিলা যুদ্ধের শেষে একটি রাজনৈতিক সমাধান হিসেবে ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে একটি চুক্তির মাধ্যমে শান্তিবাহিনীর সশস্ত্র যোদ্ধারা অস্ত্র সমর্পণ করে শান্তিবাহিনী বিলুপ্ত ঘোষণা করলেও জেএসএস একটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে গণতান্ত্রিক আন্দোলন জারি রাখে। তবে চুক্তি স্বাক্ষরের বিরোধিতা করে একটি অংশ মূল দল থেকে বের হয়ে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট বা ইউপিডিএফ গঠন করে ১৯৯৭ সালেই। এরপর থেকেই মূলত জেএসএস এবং এর ছাত্রফ্রন্ট পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) সঙ্গে ইউপিডিএফের নিয়মিত এবং অনিয়মিতভাবে দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হয়। পরে ২০১০ সালে মূল দল জেএসএস থেকে একটি গ্রুপ বের হয়ে সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচয় দিয়ে জেএসএস (এমএন লারমা) গঠন করে। এই জেএসএসকে (এমএন লারমা) সমর্থন দেয় ইউপিডিএফ। ফলে জেএসএস মূল দলটি হয়ে যায় জেএসএস (সন্তু লারমা) আর সংস্কারপন্থি দলটি হয়ে যায় জেএসএস (এমএন লারমা)। ২০১০ সালের পর থেকে চতুর্মুখী দ্বন্দ্ব-সংঘাত শুরু হয় জেএসএস (সন্তু লারমা), জেএসএস (এমএন লারমা), ইউপিডিএফ এবং পিসিপির মধ্যে। পরে ২০১৭ সালের নভেম্বরে ইউপিডিএফ ভেঙে ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নামকরণ করে নতুন একটি ফ্রন্ট তৈরি করা হয়। জনশ্রুতি রয়েছে, ইউপিডিএফের একটি অংশ ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) নাম ধারণ করে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন মূল দল জেএসএসের (সন্তু লারমা) সঙ্গে সংযুক্ত হয়। ফলে চতুর্মুখী সংঘাত পঞ্চমুখী রূপ নেয়। এভাবেই পাহাড়ে আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যকার ভাঙন এবং নানান দল ও উপদল মিলে নতুন করে ‘হিংসার ঝরনাধারা’ শুরু করে। যার ফলে পাহাড়ে নিয়মিত বিরতিতে রক্তপাতের ঘটনা ঘটে।

পাহাড়ে শান্তির বিষয়ে জানতে চাইলে আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং ভোরের কাগজকে বলেন, যারা অপেক্ষা করে তাদের জন্য ২৩ বছর দীর্ঘ সময়। এত দীর্ঘ সময়েও চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাহাড়ের মানুষ হতাশ। চুক্তির কিছু বিষয় বাস্তবায়ন হলেও মৌলিক বিষয়গুলো এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠন হলেও কার্যক্রম চালানোর ক্ষমতা নেই। তাদের পরিচালনার আইন হলেও বিধি না হওয়ায় অকেজো হয়ে পড়ে আছে এসব প্রতিষ্ঠান। তিনি বলেন, ২৩ বছর আগে যার হতে এই চুক্তি হয়েছিল গত ১২ বছর সেই সরকারই দেশের ক্ষমতায়। তাই আশা করি সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই চুক্তি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নজর দেবে। একই সঙ্গে পাহাড়িদের উচিত চুক্তি বাস্তবায়নে সরকারকে সহায়তা করা।

প্রবীণ রাজনীতিবিদ ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী অধিকার আন্দোলনের নেতা পঙ্কজ ভট্টাচার্য বলেন, শান্তিচুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশে কোনো প্রকার যুদ্ধ ছাড়াই ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। পাহাড়িদের জাতিসত্ত্বাকে মেনে নিয়ে চুক্তি বাস্তবায়ন হলেও ২৩ বছরে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। বাকি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো এখনো বাস্তবায়ন করা হয়নি। বিশেষ করে ভূমি সমস্যা ও প্রশাসনিক কাঠামোর সমাধান হয়নি। তিনি বলেন, পাহাড়ি বাঙালিদের পুনর্বাসন না হওয়ায় চুক্তিবিরোধী শক্তি বেশি লাভবান হচ্ছে। চুক্তি বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীকে গভীরভাবে ভাবতে হবে। কারণ তিনিই এই চুক্তি করেছিলেন। চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ার দায় বাঙালি জাতির কাঁধে নেয়া উচিত হবে না।

আদিবাসীবিষয়ক গবেষক, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল ভোরের কাগজকে বলেন, পাহাড়ে শান্তির জন্য প্রয়োজন শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন। চুক্তি সম্পাদনের সময় সরকারের যে সদিচ্ছা ও দুই পক্ষের যে বোঝাপড়া ছিল, পরবর্তী সময়ে তা রক্ষা করা হয়নি। এই সুযোগে বিরোধীপক্ষের নানামুখী অপতৎপরতায় চুক্তি বাস্তবায়নে ভাটা পড়েছে। তিনি বলেন, পাহাড়ের মূল সমস্যা ভূমি সমস্যার নিষ্পত্তি না হওয়া। ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীগুলো দিন দিন ভূমিহারা হচ্ছে। চিম্বুক পাহাড়ও দখল হয়ে যাচ্ছে। পাহাড়ে ফাইভ স্টার হোটেলসহ সব ধরনের ট্যুরিজম বন্ধ করে ইকো ট্যুরিজম গড়ে তোলা প্রয়োজন।

এ বিষয়ে খাগড়াছড়ির সরকার দলীয় সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ভোরের কাগজকে বলেন, সরকার শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সেই অনুযায়ী পাহাড়ে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। তিনি বলেন, প্রশাসনিক কাজ হস্তান্তরের জন্য কাজ চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। তবে জমি সমস্যার সমাধানের জন্য আলাপ-আলোচনা চলছে। আশা করি পর্যায়ক্রমে শান্তিচুক্তির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন করা হবে। প্রসঙ্গত, ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতির শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App