×

ইতিহাস ও ঐতিহ্য

দৌলা মিয়ার বীরত্বগাথা

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২০, ১১:০৬ এএম

দৌলা মিয়ার বীরত্বগাথা

প্রতীকী ছবি

একাত্তরের জুন মাস। হবিগঞ্জের মুকুন্দপুর থেকে মনতলা পর্যন্ত শত্রুমুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধাদের সময় লেগেছিল ২১ দিন। ২১ জুন শত্রুসেনারা মনতলায় উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দিক থেকে ঘিরে ফেলে। তখন পূর্ব দক্ষিণ থেকে পাল্টা আক্রমণ করেন সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ। এ সময় টের পান পশ্চিম দিক থেকে মেশিনগান নিয়ে কেউ তাকে সাহায্য করছে। সেই মুক্তিযোদ্ধার হাতে অটোমেটিক মেশিনগান। তিনি অনর্গল গুলি ছুড়ছেন। এক সময় যুদ্ধ শেষ হয়। পুরো এলাকা আবার কব্জায় নিয়ে এলেন বাঙালি সেনানায়ক কে এম সফিউল্লাহ। সাহায্যকারীকে খুঁজতে কিছুটা পশ্চিমে এগিয়ে গিয়ে দেখতে পান শত্রুদের লাইন অফ ফায়ারে পড়েও গুলি না থামানো মুক্তিযোদ্ধার ডান হাত মেশিনগানে, বাম হাতে পেট চেপে রক্তের ডোবায় পড়ে আছেন। রক্তে ভেসে যাচ্ছে সারা শরীর। পা দুটোও ক্ষতবিক্ষত গুলির আঘাতে। গুলিতে ঝাঁঝরা নাড়িভুঁড়ি বের হওয়া ব্যক্তিটি ক্ষীণ গলায় ‘জয় বাংলা’ জয়ধ্বনি করে তাকে বলেন- স্যার, আমি তো আর বাঁচবানো। মুক্ত স্বাধীন দেশ আমার দেখে যাওয়া সম্ভব হবে না। আমার এই রক্তমাখা শার্ট আপনি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দিয়ে বলবেন আমি তার ডাকে যুদ্ধ করেছি। একইসঙ্গে তার অনুরোধ ছিলÑ মুক্ত স্বাধীন দেশের মাটিতেই যেন তার শেষ আশ্রয় হয়। শত্রুর গুলি বুকে নিয়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করার সাহসী ওই যোদ্ধার নাম দৌলা মিয়া। অকুতোভয় বীর দৌলা মিয়া বেঁচে যান সেই যাত্রায়। অপারেশন এবং চার মাস হাসপাতালে থাকার পর পুরোপুরি চিকিৎসা শেষ হওয়ার আগেই হানাদার বধে আরো দৃঢ়প্রতিজ্ঞবদ্ধ হয়ে ফেরেন যুদ্ধক্ষেত্রে।

দেশ মানেই যার কাছে এক তাল কালো কাঁদা মাটি যাকে বুকে আগলে রাখতে হয়, জীবনবাজি রেখে ভালোবাসতে হয়, সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা দৌলা মিয়ার নাম আজো ইতিহাসে উপেক্ষিত। অসম সাহসিকতার জন্য পাননি কোনো খেতাব, কোনো স্বীকৃতি। এ ব্যাপারে সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের চেয়ারম্যান কে এম সফিউল্লাহ ভোরের কাগজকে বলেন, মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও আমাদের দৌলা অসীম সাহসিকতায় কভার দিয়ে গেছে মুক্তিবাহিনীকে। অথচ শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে দৌলা মিয়াকে বহিষ্কার করেছিলাম আমি। একটিবার তাকে সুযোগ দেয়ার জন্য আমাকে অনেক অনুরোধ করেছিল সে। তাকে সে সুযোগ দেইনি। আর একাত্তরের ২১ জুন ওই দৌলা মিয়াই মারাত্মক আহত হয়েও ফায়ার করে শত্রু হটিয়ে আমার জীবন রক্ষা করে প্রমাণ করেছে সে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক। ওই সময়ই আমি তাকে আগরতলা হাসপাতালে নিয়ে যাই এবং সেখানে চিকিৎসার পর সে সুস্থ হয়। কিন্তু তার বীরত্বের কোনো স্বীকৃতি পায়নি স্বাধীন দেশে। পায়নি বীরত্বসূচক কোনো উপাধি। এ দায় আমার, আমাদের।

দৌলার যুদ্ধগাথা : দৌলা মিয়ার জন্ম কুমিল্লা জেলার শালদা নদী গ্রামে। দীর্ঘাকৃতি, স্বাস্থ্যবান দৌলা পৌরনীতি, সমাজনীতির কঠিন সংজ্ঞায় দেশ বোঝেন না। দেশ মানেই তার কাছে নিজ গ্রাম, গ্রামের ছোট্ট পুকুর, বাতাসে সবুজ ধানক্ষেতের সোনালি শীষগুলোর থির থির কাঁপন। আর খাকি পোশাকের পাকিস্তানি সেনা যারা তার দেশের শত্রু; তাদের তাড়াতে হবে, প্রয়োজনে উৎসর্গ করতে হবে প্রাণ। আর তাই যুদ্ধ শুরুর পরপরই স্ত্রী-সন্তান ছেড়ে চলে যান মুক্তিযুদ্ধে। ক্যাপ্টেন মতিনের অধীনে একের পর বিজয়গাথার অধিকারী হন। একদিন এক অপারেশনে গিয়ে চা-বাগানের শ্রমিকদের দেশি মদ খেয়ে অপ্রকৃতস্থ দৌলা নিজের প্রিয় এসএমজিকে তাক করেন সঙ্গী মুক্তিযোদ্ধাদের দিকেই। অত্যন্ত কৌশলে মাতাল দৌলাকে নিরস্ত্র করেন ক্যাপ্টেন মতিন। তবে সামরিক আইনে দৌলার এই কর্মকাণ্ড ছিল মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ। সেক্টর কমান্ডার কে এম সফিউল্লাহ অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে তার সেক্টর এরিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু রক্তে যে তার মারণ নেশা। মুক্তিবাহিনী ছাড়তে হবে, দেশের জন্য যুদ্ধ করতে পারবে না এই দুঃখে হু হু করে কেঁদে ওঠেন দৌলা। এ যে মৃত্যুদণ্ডের চেয়েও বড় শাস্তি! কাতরকণ্ঠে আরেকবার সুযোগ দিতে অনেক অনুনয় করেন কে এম সফিউল্লাহকে।

দৌলা বলেন, স্যার, আমাকে একবার সুযোগ দিন, যদি আমার আরেকবার ভুল হয় আমাকে কিছু না বলেই গুলি করবেন। দয়াপরবশ হয়ে সফিউল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিয়ে লে. হেলাল মোর্শেদের কোম্পানিতে নিয়োগ দেন। এর কিছুদিন পর মনতলার যুদ্ধে শত্রুমুক্ত করে মেজর সফিউল্লাহর জীবন বাঁচান দৌলা। বিজয়ের পর দুঃসাহসিক দৌলা মিয়ার সাহসিকতার কথা হবিগঞ্জ, কুমিল্লার মানুষের মুখে মুখে ফেরে। তবে বিজয়ের অর্ধ শতক পরও ইতিহাসে উপেক্ষিত তার বীরত্বগাথা। ইতিহাসে উপেক্ষিত দৌলা মিয়া। এ ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির ভোরের কাগজকে বলেন, দৌলা মিয়ার মতো সাধারণ জনগণ নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করেছেন। যাদের আত্মত্যাগে আমাদের বিজয়গাথা, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের স্বাধীন দেশ, আমরা তাদের সত্যিকারের সম্মান জানাতে পারিনি। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান ডা. এম এ হাসান ভোরের কাগজকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধ জনযুদ্ধ ছিল। দৌলা মিয়ার মতো মানুষেরাই জয়বাংলা বলে হাসতে হাসতে প্রাণ দিতেও দ্বিধা করেনি। কিন্তু তাদের সাহসিকতাকে আমরা সম্মান দেইনি। দেইনি কোনো খেতাব। এভাবে ইতিহাসের বিস্মৃতির আড়ালে চাপা পড়ে আছে অসংখ্য দৌলা মিয়ার বীরত্বগাথা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App