×

রাজধানী

২৬ সংস্থার সমন্বয় কতদূর

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২০, ০৯:২৯ এএম

২৬ সংস্থার সমন্বয় কতদূর

প্রতি বছরই চলে ড্রেনের কাজ।

কাজের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে মাত্র চারটি সেবাদানকারী সংস্থা। কাউকেই ইচ্ছেমতো কাজ করতে না দেয়ার ঘোষণা মেয়র তাপসের।

ঢাকার সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পরিপত্র জারি করে ২০১৬ সালের ২৭ জুন। এতে বলা হয়- বিভিন্ন সেবাদানকারী সংস্থার কাজে আরো গতিশীলতা আনতে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন ২০০৯ এর ৪৯ (১৫) ধারা অনুযায়ী সিটি করপোরেশনের অধিক্ষেত্রে অন্তর্ভুক্ত সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট সরকারি দপ্তরের প্রধানরা সিটি করপোরেশনের আমন্ত্রণে সভায় যোগ দিবেন। সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবেন এবং বাস্তবায়ন অগ্রগতি সিটি করপোরেশনকে অবহিত করবেন। এর আগে মেয়রের দায়িত্ব নিয়েই ২০১৫ সালের ২৭ ডিসেম্বর নগরীর জলাবদ্ধতা ও যানজট নিরসনসহ সমন্বয়হীন কর্মকাণ্ডকে এক ছাতার নিচে আনতে সর্বপ্রথম সেবা সংস্থাগুলোর সঙ্গে জরুরি সভা করেন ডিএসসিসির মেয়র সাঈদ খোকন। বৈঠকে বেশকিছু সিদ্ধান্ত হয়।

ওই সভায় রাজউক থেকে বলা হয়েছিল অনুমতি ছাড়া বহুতল ভবন নির্মাণ বিষয়ে ডিএসসিসির সব কাউন্সিলরকে সতর্ক থাকতে হবে। কাউন্সিলরদের এ ধরনের ভবন নির্মাণ বন্ধে ভ‚মিকা রাখার সিদ্ধান্ত হয়। ডিএমপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল জলাবদ্ধতা দূরীকরণে পলিথিনের বদলে পাটের ব্যাগ ব্যবহার করতে। যত্রতত্র পোস্টার না লাগানোর সিদ্ধান্তও হয়। কিন্তু পরবর্তীতে কোনো সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন হয়নি।

এরপর কয়েকটি বৈঠকও করেন ডিএসসিসি মেয়র। সেখানে অনেকগুলো সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও কোনোটিই সফল হয়নি। সবশেষ ডিটিসিএ বৈঠকে নগরীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরাতে বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্ত হলেও সেগুলোর কোনোটিই বাস্তবায়ন হয়নি। ১১তম বৈঠকে রাজধানীর ৩টি সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। সেটি কার্যকর করতে গেলে রিকশা চালকদের আন্দোলনসহ নানা বাধার কারণে তাও শেষ পর্যন্ত ঝুলে গেছে।

ডিএসসিসির বর্তমান মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস চলতি বছরের মে মাসে দায়িত্ব নেয়ার পর নগরীর উন্নয়ন ও শৃঙ্খলা ফেরাতে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ঘোষণা দেন ৩১ অক্টোবরের মধ্যে ঢাকার ২৬টি সেবাদানকারী সংস্থা তাদের কাজের চাহিদাপত্র ডিএসসিসিতে জমা দেবে। তারপর রাস্তা-ঘাটসহ অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পে সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করবে। কে কোথায় উন্নয়ন কাজ করতে চায়, তা জানতে চেয়ে একটি চিঠি ২৬টি সংস্থাকে দিয়েছিল ডিএসসিসি। মেয়রের পক্ষে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সই করা চিঠিটি পাঠানো হয় গত ৭ অক্টোবর। চিঠির উত্তর দিতে অনুরোধ জানিয়ে ২৫ দিন সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মাত্র ৪টি সরকারি সংস্থা চিঠি দিয়ে তাদের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে। বাকিরা চিঠির কোনো জবাবই দেয়নি।

চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, জলাশয় ভরাট করে আবাসিক ভবনের অনুমতি দেয়ায় দুর্যোগপ্রবণতা বাড়ছে; খাল বেদখল হয়ে যাওয়ায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে, সুপেয় পানি ও সুষ্ঠু পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বিভিন্ন সংস্থা রাস্তা কাটার কারণে সর্বসাধারণ ও যানবাহন চলাচলে বিঘœ সৃষ্টি হচ্ছে। ডিএসসিসির মতামত নিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হলে ঢাকা শহর পরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে উঠবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। এছাড়া বিভিন্ন সরকারি সংস্থার বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্প এবং আগামীদিনে কী উন্নয়ন প্রকল্প নেয়া হবে, তার বিবরণ পাঠাতে অনুরোধ করা হয়।

ডিএসসিসি সূত্রে জানা যায়, বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে ৪টি প্রতিষ্ঠান তাদের উন্নয়ন পরিকল্পনার কথা জানিয়ে চিঠির জবাব দিয়েছে। এর মধ্যে সরকারি ৪টি প্রতিষ্ঠান ডিপিডিসি, বিটিসিএল, ঢাকা ওয়াসা ও ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড।

চিঠি পাঠানোর পরও ২২ সংস্থার সাড়া না দেয়ার বিষয়ে মেয়র শেখ তাপস জানান, যারা ডিএসসিসির উদ্যোগে সাড়া দিয়েছে, তাদের ধন্যবাদ। আর যারা সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের জন্য আগামী বছরের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তিনি বলেন, একই জায়গায় একাধিক সংস্থা পৃথকভাবে কাজ করায় জনগণের দুর্ভোগ বেড়ে যায়। কিন্তু সেটা যদি সমন্বয়ের মাধ্যমে করা যেত, তাহলে একই সড়কে বারবার কাজ করার প্রয়োজন পড়ত না। এতে জনদুর্ভোগ লাঘব হওয়ার পাশাপাশি উন্নয়নও টেকসই হতো। আগে না জানালে এখন থেকে কোনো সংস্থাকে ইচ্ছেমতো কাজ করতে দেয়া হবে না।

যে ২২টি সংস্থা চিঠির জবাব দেয়নি, তার মধ্যে রয়েছেÑ রাজউক, জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ, গণপূর্ত অধিদপ্তর, স্থাপত্য অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ, বিআরটিএ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, ত্রাণ ও পুনর্বাসন অধিদপ্তর, বাংলাদেশ রেলওয়ে, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, ফায়ার সার্ভিস এন্ড সিভিল ডিফেন্স, তিতাস গ্যাস, হাতিরঝিল প্রকল্পের পরিচালক, মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার প্রকল্পের পরিচালক, পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক ও ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ। ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের জানান, ৩১ অক্টোবরের পর কোনো সংস্থার চিঠি না নেয়া হয়নি।

সিটি করপোরেশন এলাকায় বিভিন্ন সংস্থার কাজে শৃঙ্খলা আনতে নগর পরিকল্পনাবিদদের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক করেন মেয়র তাপস। সেখানে পরিকল্পনাবিদরা তাকে সেবা সংস্থার কাজে সমন্বয় আনতে উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দেন।

নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান ভোরের কাগজকে বলেন, ঢাকায় একেক সংস্থা একেকভাবে কাজ করে। সিটি করপোরেশন আইনে বলা আছে- নগর সেবায় সম্পৃক্ত প্রতিটি সংস্থা সিটি করপোরেশন এলাকায় যা যা করবে বা করতে চায়, সেটা সিটি করপোরেশনকে অবহিত করতে হবে। সিটি করপোরেশন পুরো জিনিসটাকে সমন্বয়ের মধ্যে নিয়ে আসবে। আন্তঃসংস্থা সমন্বয়ের ব্যাপারে তারা যে পরামর্শগুলো দেবে, তাতে দুটি কাজ হবে। একটি হলো অর্থের অপচয় কম হবে। আরেকটি জনগণের দুর্ভোগ লাঘব হবে। আমরা একটা ভালো নগর পাব। কিন্তু এই কাজ অন্য সংস্থাগুলো না করার পেছনে আমার দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে- তারা মনে করে যদি সমন্বয়ের মধ্যে আসে তাহলে তাদের খবরদারি, নজরদারি, প্রকল্প নেয়ার সক্ষমতা বাধাগ্রস্ত হবে। বাংলাদেশে যত বেশি প্রকল্প আসে, তত বেশি এই সংস্থাগুলো মনে করে যে তাদের সুবিধা বেশি।

তিনি বলেন, আগে যারা ঢাকার মেয়র ছিলেন, তারা সিটি করপোরেশন আইনে তাদের যে সুস্পষ্ট ক্ষমতা সেটা নিজের মনে করে অথবা জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে প্রয়োগের চেষ্টা করেননি। এখন মেয়ররা দায়িত্ব নিয়ে সংস্থাগুলোকে ডাকার চেষ্টা করছেন। সিটি করপোরেশনের অধীনে এই সংস্থাগুলোকে যেতেই হবে। তার কোনো বিকল্প নেই। আইনি বাধ্যবাতকতায় একমাত্র সিটি করপোশেনের এখন সেই অথরিটি আছে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিপত্র বাস্তবায়ন বিষয়ে এই নগরবিদ বলেন, পরিপত্রটি বাস্তবায়ন হয়নি। কারণ সিটি করপোরেশন যখন কোনো সংস্থাকে চিঠি দেয়, তখন তারা সেটাকে সেভাবে আমলে নেয় না। অথচ সেটা তাদের বাধ্যবাধকতার অংশ। সরকারের যে কার্যপরিধি সেই অনুযায়ী তাদের সেটা মানতে হবে। এই দৃষ্টিভঙ্গিটা এখনো তৈরি হয়নি। সমন্বয়ের জন্য বিদ্যমান আইন যথেষ্ট। এই আইনে সব ক্ষমতা দেয়া আছে। তবে ঢাকা দক্ষিণের বর্তমান মেয়র যে উদ্যোগ নিয়েছেন। তার যে আন্তরিকতা...আমরা আশা করি তিনি সেটা করতে পারবেন। তবে দুই সিটি করপোরেশনের মধ্যেও সমন্বয় প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। ডিটিসিএ বৈঠকেরও ১৩টি সভার সিদ্ধান্তও খুব একটা বাস্তবায়িত হয়নি বলেও জানান ড. আদিল মোহাম্মদ খান।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App