×

জাতীয়

ভগীরথীর একাত্তর, বীরকন্যার ঠাঁই হয়নি ইতিহাসে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২০, ০৯:৩৮ এএম

ভগীরথীর একাত্তর, বীরকন্যার ঠাঁই হয়নি ইতিহাসে

পিরোজপুর শহরের ভগিরথী চত্বরে বীরকন্যা ভগিরথীর ভাস্কর্য। ছবি: ভোরের কাগজ।

‘বোলো মুক্তি কাঁহা, বহোত ইনাম মিলবে।’ পাকিস্তানি সুবেদার সেলিমের এমন প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান তিনি। বুকের ভেতরের জ্বলন্ত বারুদকে অগ্নিকুণ্ডে পরিণত করার শপথকে বাস্তবে রূপ দিতে এমন সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করেননি। প্রায়ই পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দেন। এমনই এক উত্তাল দিনে (২৯ আগস্ট) গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রস্তুত রেখে পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে যান পিরোজপুরের বাগমারায়।

মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর অনেক সৈন্য মারাত্মকভাবে আহত হয়। শুধু তাই নয়, শহরে ফিরে যাওয়ার পথে খানাকুনিয়ারীতেও গেরিলা আক্রমণের শিকার হয় পাকিস্তানি সৈন্যরা। একইভাবে মুক্তিবাহিনীর মিথ্যা তথ্য দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের বিপদে ফেলেন আট এবং নয় সেপ্টেম্বর। ক্যাম্পে ফিরে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন এজাজ নিশ্চিত হয়, বাঙালি অষ্টাদশী এই নারী পাকিস্তানি সেনাদের নয়, বরং মুক্তিযোদ্ধাদের চর। তাৎক্ষণিক তাকে হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়। তার জীবিত মাথার মূল্য ধরা হয় নগদ এক হাজার টাকা। কিন্তু রক্তে যে তার মারণ নেশা। সেই নেশার কারণে ফের শহরে গিয়ে নজর রাখেন পাকিস্তানিদের গতিবিধির। এবার ভাগ্য তার সুপ্রসন্ন ছিল না। রাজাকার শামসুল হক ফকির ও আশরাফ হোসেনের সংবাদে দুইজন পাকিস্তানি সেনা ও ছয়জন রাজাকার এসে তাকে ধরে নিয়ে যায় ক্যাম্পে ক্যাপ্টেন এজাজের সামনে। মুক্তিযোদ্ধাদের ওই চরকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার জন্য সুবেদার সেলিমকে নির্দেশ দেয় এজাজ। এরপর শহরের চৌমাথায় এনে প্রকাশ্যে বিবস্ত্র করে দুই গাছি দড়ি দুপায়ে বেঁধে চলন্ত জিপে বেঁধে শহরের রাস্তা প্রদক্ষিণ করে।

ঘণ্টাখানেক রাজপথে এভাবে চলার পর আবার যখন সেই চৌমাথায় ফিরে এলো, তখনো তার দেহে মৃদু প্রাণের স্পন্দন। পৈশাচিক হানাদাররা তার দুটি পা দুটি জিপের সঙ্গে বেঁধে জিপ দুটিকে চালিয়ে দিল বিপরীত দিকে। দুভাগ হয়ে গেলেন বাংলা মায়ের ওই দুঃসাহসী কন্যা। তার দেহ থেকে রক্ত-মাংস খসে পড়ে পিচঢালা রাজপথে। দুভাগ দেহ দুই জিপে শহর পরিক্রমা শেষে চৌমাথায় ফিরে সুবেদার সেলিমের নির্দেশে অবশিষ্ট মাংসপিণ্ড নিক্ষেপ করা হয় বলেশ্বর নদে। একাত্তরের ১৩ সেপ্টেম্বর পিরোজপুর শহরের পিচঢালা রাজপথে তাজা রক্ত দিয়ে বাংলার মানচিত্র এঁকে দেয়া বীরকন্যা ভগীরথী সাহা।

বিজয়ের অর্ধশতাব্দীতে এসেও ইতিহাসে ঠাঁই হয়নি ভগীরথীর। লাল-সবুজ পতাকার জন্য নির্মমভাবে জীবন দেয়া ভগীরথী পাননি শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। এ ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির ভোরের কাগজকে বলেন, একাত্তরের গণহত্যা ও নির্যাতনের প্রতীক ভগীরথী। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ায় নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে তাকে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের প্রায় পাঁচ দশকেও ইতিহাসে নেই ভগীরথী। না শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়, না পিরোজপুরের মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ট্রাইব্যুনালে এসেছে ভগীরথীর নাম।

ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান ডা. এম এ হাসান ভোরের কাগজকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীরদের আমরা স্বীকৃতি দিতে পারিনি। কার্পণ্য করেছি। জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছু নেই। ভগীরথীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে পাকিস্তানি সেনারা। আমরা এই বীর কন্যার অবদানের স্বীকৃতি দেইনি। ইতিহাসে উপেক্ষিত তার নাম।

ভগিরথীর একাত্তরনামা: একাত্তরের ৪ মে। ৩২ পাঞ্জাবের এক প্লাটুন সেনা হামলে পড়ে পিরোজপুরে। নির্মমভাবে হত্যা করে কয়েকশ নিরীহ মানুষ। জ্বালিয়ে দেয় ঘরবাড়ি। স্বামীহারা অবোধ দুই ছেলের মা ভগীরথীকে ট্রাকে তুলে নিয়ে যায় পিরোজপুরে। ক্যাম্পে তার ওপর চলে হিংস্র পাশবিক নির্যাতন। মরে যেতেই চেয়েছিলেন ভগীরথী। ফন্দি আঁটলেন মরতেই যদি হয়, তাহলে মেরে মরব। বাধ্য মেয়ের মতো পাকিস্তানিদের সব কথা মেনে নিতেন। ধীরে ধীরে পাকিস্তানিদের আস্থা অর্জন করলেন ভগীরথী। জানতেন ওদের অনেক গোপন তথ্য। মুক্তিবাহিনীর খবর দেয়ার মিথ্যা অভিনয় করেন তিনি। পাকিস্তানিরাও তাকে গ্রামে যেতে দিত।

সাহসী ভগীরথী মূল লক্ষ্য অর্জনের জন্য গোপনে যোগাযোগ গড়ে তুললেন মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে। জুন মাসে একদিন পাকিস্তানি বাহিনীকে নিমন্ত্রণ করলেন নিজের গ্রামে। সংবাদ জানিয়ে রাখলেন মুক্তিবাহিনীকেও। সেদিন ৪৫ জন খানসেনার মধ্যে ৪/৫ জন ক্যাম্পে ফিরতে পেরেছিল। একইভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রস্তুত রেখে ২৯ আগস্ট বাগমারা, ৮ ও ৯ সেপ্টেম্বর পোরগোলাসহ আশপাশের গ্রামে যায় খানসেনারা। প্রতিবারই মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা মারা যায়। ফেরার পথে প্রতিশোধ হিসেবে নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে তারা। পাকিস্তানিরা বুঝতে পারে ভগীরথী মুক্তিযোদ্ধাদের চর। শাস্তি হিসেবে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে ভগীরথীর তাজা রক্তে লাল করে পিরোজপুরের কালো পিচঢালা পথ।

একাত্তরে ভগীরথীর নির্মম প্রাণ বিসর্জনের দৃশ্যের সাক্ষী পিরোজপুরের সাংবাদিক খালিদ আবু। তিনি বলেন, আমি স্বচক্ষে পোস্ট অফিস রোড থেকে ভগীরথীকে টেনে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখেছি। দেখেছি ভগীরথীর রক্তাক্ত সাদা শাড়ি আর রাস্তায় রক্তের ছোপ। বাঙালির বিজয়ের অর্ধশতকেও স্বীকৃতি পাননি শহীদ ভগীরথী সাহা। শুধু পিরোজপুর শহরের একটি চত্বরের নাম তার নামে রাখতে পেরেছি। ইতিহাসের আর কোথাও নেই ভগীরথী।

এ ব্যাপারে শাহরিয়ার কবির বলেন, আমরা তাদের স্বীকৃতির জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছি। এটি পিরোজপুরের স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের দায়িত্ব ছিল। তারা কেন ভগীরথীর নাম তালিকাভুক্ত করেননি? তার পরিবারের পক্ষে আপিল করার মতো তো কেউই আর বেঁচে নেই।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App