পাচারকারীদের শাস্তি হয় না!
কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২০, ১০:৫২ পিএম
ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন পথ ব্যবহার করে বাংলাদেশের লোকজনের বিদেশে পাড়ি দেয়া থামছে না। ভাগ্য বদলাতে অনেকে দেশি-বিদেশি মানব পাচারকারীদের প্রলোভনের শিকার হচ্ছে। এর ফলে সাম্প্রতিক সময়ে পাচারের শিকার ব্যক্তির মধ্যে বাংলাদেশিদের নাম বারবার আসছে। পাঁচ বাংলাদেশি মানব পাচারকারীর বিরুদ্ধে এবারই প্রথম রেড নোটিস জারি করল ইন্টারপোল। এর মধ্যে তিনজন আগে থেকে লিবিয়ায় অবস্থান করছেন। আর বাকি দুজনের অবস্থান সম্পর্কে এখনো কিছু জানতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ২৫ নভেম্বর এদের বিরুদ্ধে রেড নোটিস জারি করা হয়। এর আগে ৬ নভেম্বর মিন্টু মিয়া নামে আরো এক মানব পাচারকারীর নামে রেড নোটিস জারি করা হয়। এ নিয়ে মোট ছয় বাংলাদেশি মানব পাচারকারীর বিরুদ্ধে রেড নোটিস জারি হলো। এদের নামে রাজধানীর পল্টন ও বনানী থানায় মানব পাচারের অভিযোগে ২ জুন মামলা হয়েছে। রেড নোটিসের পর ওই ব্যক্তিরা যে কোনো দেশের স্থল, নৌ ও আকাশ পথের বন্দরে গেলেই গ্রেপ্তার হবেন। এরপর সে দেশের আইনকানুন পর্যালোচনা করে দেশে তাদের ফেরত আনা সম্ভব। এ পর্যন্ত ১৫ বাংলাদেশিকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফেরত আনা গেছে। এখন পর্যন্ত ৮১ জন মানব পাচারকারীকে চিহ্নিত করেছে সিআইডি। এর মধ্যে ৩১ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। আর বিদেশে অবস্থান করছেন ২৭ জন। ঢাকা থেকে মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যরা প্রথমে ভিজিট ভিসায় বাংলাদেশিদের শ্রীলঙ্কায় পাঠান। সেখান থেকে দুবাই, মিসরের আলেকজান্দ্রিয়া কিংবা লিবিয়ার বেনগাজিতে নিয়ে যান। এরপর সুযোগ বুঝে তাদের ইউরোপ পাঠান। এর আগে একটি ঘরে জিম্মি করে রাখেন। মানব পাচারকারী চক্রের মূল অংশটি দেশের বাইরে। স্থানীয় পর্যায়ে কিছু দালাল কাজ করেন। তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা তথ্য দেন না। অভিবাসন প্রক্রিয়ায় যুক্ত অভিযুক্ত রিক্রুটিং এজেন্সি, পাচারকারী, দালালদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
মানব পাচার একটি জঘন্য অপরাধ। পাচারের সংঘবদ্ধ চক্রের বিশ্বজুড়ে বিস্তৃতি রয়েছে এবং ক্রমেই মাত্রা বাড়ছে। বাংলাদেশের জন্যও এটি একটি বড় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। প্রতিনিয়ত এ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ব্যাপক হারে মানুষ পাচার হচ্ছে। সত্যিকার পরিস্থিতিটা এই যে, কোনো সরকারই মানুষ পাচারের বিরুদ্ধে নানা পদক্ষেপ নিয়েও পাচার প্রতিরোধে সাফল্য অর্জন করতে পারছে না। পাচার বিষয়ে কাজ করে এমন সংস্থাগুলোর তথ্যমতেÑ লালমনিরহাট, হিলি, কিরণগঞ্জ, সোনা মসজিদ, রাজশাহীর চরঘাট, খিদিরপুর, সাতক্ষীরা, কলারোয়া, কাকডাঙ্গা, বৈকান্দি, দেবহাটা, কালিগঞ্জ, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর, চুয়াডাঙ্গা, জীবননগর, জয়পুরহাট, পাঁচবিবি, লালমনিরহাটের বুড়িমারী, পাটগ্রামের সীমান্ত এলাকা ইত্যাদি নারী ও শিশু পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মোটা অঙ্কের বেতনের লোভ দেখিয়ে সমুদ্রপথে মানুষ পাচারের ঘটনা বেশি হচ্ছে। পাচার হওয়ার পথে অনেকে সাগরে দস্যুদের কবলে পড়ে বা নিরাপত্তারক্ষীদের গুলিতে প্রাণ হারাচ্ছে কিংবা আটক হয়ে বিদেশের জেলে বন্দি থাকছে। যারা পাচার হতে পারছে তারা মালয়েশিয়া-থাইল্যান্ডে শ্রমদাসে পরিণত হচ্ছে। জাতিসংঘ ২০০৩ সালে বহুজাতিক সংঘবদ্ধ অপরাধবিষয়ক আইন প্রণয়ন করেছে। এর ফলে মানব পাচারের মতো আন্তর্জাতিক অপরাধের তদন্ত ও বিচারের আওতায় আনার ক্ষেত্রে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সহযোগিতার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ সুযোগকে কাজে লাগাতে আমাদেরও উদ্যোগী হতে হবে।
জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদান যেমন অনস্বীকার্য তেমন আদম ব্যাপারি নামের প্রতারকদের প্রতারণাও অনেক বিয়োগান্ত ঘটনার জন্ম দিয়েছে। বিদেশে চাকরি দেয়ার নাম করে লাখ লাখ টাকা নিয়ে উধাও, চাকরি না দিয়ে প্রতারণা শুধু নয়, জীবন কেড়ে নেয়ার ঘটনাও অনেক ঘটেছে। সাম্প্রতিক সময়ে জনশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে দুর্নীতি তুলনামূলকভাবে হ্রাস পেলেও থেমে নেই মানব পাচারের ঘটনা। লিবিয়া থেকে নৌকায় ইউরোপে সাগর পাড়ি দেয়ার ঘটনা বেড়েছে ব্যাপক হারে। চলতি বছর বিশ্বের যে কোনো দেশের চেয়ে বেশি বাংলাদেশি শরণার্থী হিসেবে নৌকায় করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। আশ্রয় পাওয়ার জন্য এমন সব কারণ দেখানো হচ্ছে যা বাস্তবতাবিবর্জিত এবং দেশের জন্য অসম্মানজনক। মানব পাচার একটি জঘন্য অপরাধ। এ ঘৃণ্য অপরাধে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করে বিচারের মাধ্যমে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা হবেÑ এমনটিই কাম্য।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ।