×

মুক্তচিন্তা

এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২০, ১০:০৬ পিএম

এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী
সময়ের রাজনৈতিক পরিক্রমায় জীবনে জেল-জুলুম সয়ে, মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে পথচলা আজীবন সংগ্রামী এ বীরপুরুষ কারো কাছে ছিলেন রাজনৈতিক সহযোদ্ধা, কারো কাছে রাজনৈতিক গুরু অথবা কারো কাছে ছিলেন রাজনৈতিক অভিভাবক। কিন্তু দল-মতের ঊর্ধ্বে সবার কাছে ছিলেন তিনি ‘মেয়র সাব’। তিনি আর কেউ নন, তিনি চট্টলার নয়নমণি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। আজ এ চট্টলবীরের শুভ জন্মদিনে জানাই শুভেচ্ছাসহ বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি। মূলত তার রাজনীতি ছিল সেবামূলক। তিনি শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে সবসময় রাজনীতি করেছেন। যখনই কোনো মানুষ দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে পড়েছেন তখনই তার সাহায্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তিনবার জনগণের ভোটে নির্বাচিত সাবেক এ মেয়র স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলন ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনসহ প্রজন্ম পরম্পরায় মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পৌঁছে দেয়ার জন্য প্রতি বছর বিজয়মেলার আয়োজন করে ইতিহাসে কিংবদন্তি হিসেবে স্থান করে নেন। ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর (সেবার প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ মারা যান) ক্ষমতাসীন সরকার ও বিএনপির নেতাকর্মীরা যখন কোনো ভ‚মিকা রাখতে ব্যর্থ হন, তখন তিনি নেতাকর্মীদের নিয়ে ‘মানুষ মানুষের জন্য’ সেøাগানকে বুকে ধারণ করে নিজ কাঁধে লাশ বহন করে দাফন করাসহ মুসলিম হলে ক্যাম্প স্থাপন করে হাজার হাজার আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন এবং উদ্বাস্তু মানুষের আশ্রয়ে লঙ্গরখানা খোলে সারাদেশে গণমানুষের নেতা হিসেবে নিজেকে পরিচিত করে তোলেন। ফলে চট্টগ্রামের মানুষও ১৯৯৪ সালে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত করে তাকে যোগ্য সম্মানে ভ‚ষিত করেন। বিরোধী দল আওয়ামী লীগের জন্য এ বিজয় ছিল তখন ভিটামিন। মূলত চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য খাত এ চট্টলবীরের হাতে উজ্জীবিত হয়ে ওঠে এবং চট্টগ্রাম নগর একটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন সিটি করপোরেশন হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। মানুষের বিপদে তিনি প্রাণ দিতেও প্রস্তুত ছিলেন। তিনি তখন চসিকের মেয়র। এ অবস্থায় চট্টগ্রাম শহরের একটি বিল্ডিং ভ‚মিকম্পের কারণে ঢলে পড়ে ৬-৭ জন নিচে চাপা পড়ে চ্যাপ্টা হয়ে মারা যান। দুর্গন্ধের কারণে এবং চাপা পড়ার ভয়ে ডোমরাও এ লাশগুলো টানতে রাজি হচ্ছিল না। এ অবস্থায় তিনি নিজেই প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে লাশগুলো তুলে এনে নিজের হাতে দাফন করেন। ১৯৯২ সালে ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙার পর চট্টগ্রামে হিন্দু বাড়ি ও মন্দিরে হামলা ঠেকাতে তিনি দলবল নিয়ে পাহারার ব্যবস্থা করেন এবং মেয়র থাকাকালীন তিনি পরিচ্ছন্ন কর্মীদের ‘সেবক’ উপাধিতে ভ‚ষিত করে তাদের নয়নমণিতে পরিণত হন। চট্টগ্রামের জনগণ ছিল তার কাছে সন্তানের মতো। এজন্য মন্ত্রিত্ব ও কেন্দ্রীয় নেতা হওয়ার ডাক পেয়েও তিনি চট্টগ্রামবাসীকে ফেলে যাননি। আপসহীন নেতা ছিলেন এ চট্টলবীর। কোনো কাজ যদি কৃষক-শ্রমিকের স্বার্থের পরিপন্থি হতো, তাহলে তিনি নিজ দলের কর্মসূচি হলেও তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতেন। ২০০১ সালে বেসরকারি উদ্যোগে বন্দর চ্যানেল এসএসএ পোর্ট স্থাপনের উদ্যোগ নিলে শ্রমিকদের স্বার্থে নিজ দলের সরকারের বিরুদ্ধে তিনি আন্দোলনের ডাক দেন। লালদীঘির মাঠে জনসভা করে তিনি ঘোষণা দেন, বন্দর স্থাপনের প্রক্রিয়া বন্ধ না হলে চট্টগ্রাম থেকে এক টাকাও ঢাকায় যাবে না। ২০০৭ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর মহিউদ্দিন চৌধুরী গ্রেপ্তার হন। এ সময় তার আদরের কলিজার টুকরা মেয়ের ক্যান্সার ধরা পড়ে। ব্যাংককে চিকিৎসাধীন মেয়েকে দেখতে পরিবার প্যারোলে মুক্তি চাইলে ‘রাজনীতি ছাড়ার শর্তে’ তাকে মুক্তি দিতে রাজি হয় সরকার। কিন্তু এ মহান সংগ্রামীর হয়তো আদরের মেয়ের জন্য কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল। তারপরও সেনা নিয়ন্ত্রিত সরকারের এ ফালতু শর্ত তিনি মেনে নেননি। মানবেনই বা কেন? বীরের আচরণ তো বীরের মতোই হয়। হোল্ডিং ট্যাক্স পুনঃমূল্যায়নের বিরুদ্ধে নগরবাসীর পক্ষে অবস্থান নিয়ে নিজ দলের মেয়র ও সাংসদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে পিছপা হননি। তিনি চট্টগ্রামবাসীর কতই যে আপনজন ছিলেন তা বুঝা যায় ১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকার তাকে গ্রেপ্তার করলে মুহূর্তে সারা চট্টগ্রাম বারুদাগারে পরিণত হয়। চট্টগ্রামের হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন প্রিয় নেতার মুক্তির দাবিতে। প্রশাসন তখন পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল। এভাবে পাঁচ দশকেরও বেশি সময় সুখে-দুঃখে ও রাজনৈতিক সংকটে চট্টগ্রামবাসীর সঙ্গে থেকে এ মহান ব্যক্তিত্ব বিভিন্ন রোগে ভুগে ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর দল-মত নির্বিশেষে সবার ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ইহজগৎ ত্যাগ করেন। এ চট্টলবীরের অবদানকে বিনম্র চিত্তে স্মরণ করছি এবং জন্মদিনে আবারো শুভেচ্ছাসহ বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাচ্ছি। পটিয়া, চট্টগ্রাম। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App