×

জাতীয়

ঝুঁকি নিয়ে চলছে ট্রেন

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২০, ১০:১৪ এএম

১২৫ বছরের পুরনো সেতু অধিকাংশ ক্রসিংয়ে নেই গেটম্যান মেয়াদ উত্তীর্ণ ইঞ্জিনে চলে দূরপাল্লার ট্রেন

১৮৯৪ সালে নির্মিত অর্থাৎ ১২৫ বছরেরও বেশি পুরাতন রেলসেতুর ওপর দিয়ে চলছে দ্রুতগতির ট্রেন। আর প্রায়শ ঘটছে দুর্ঘটনা। সেই সঙ্গে সংস্কারহীন রেললাইন, ফিস প্লেট, ক্লিপ, পাথরবিহীন রেল পথের ওপর পুরনো ইঞ্জিন ও বগি জোড়াতালি দিয়ে চালান হচ্ছে প্রায় অধিকাংশ রেল। ফলে ঘটছে দুর্ঘটনা, ঝরছে প্রাণ, পঙ্গুত্ববরণ করছে শত শত মানুষ। ২০১৪ সাল থেকে চলতি বছরের অক্টোবর ছোটবড় প্রায় ১ হাজারটি রেল দুর্ঘটনায় দুই শতাধিক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। আহত ৫ শতাধিক। পঙ্গুত্ববরণ করে মানবেতর জীবনযাপন করছে অনেকেই। গত বছরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রেল দুর্ঘটনায় ১৫-১৬ জন মারা যাওয়ার পরে প্রধানমন্ত্রী পুরাতন ও মেয়াদোত্তীর্ণ সেতু দ্রুত মেরামতের নির্দেশ দেন। রেল মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে তড়িঘড়ি কিছু মিটিং সিটিং করলেও কাজের কাজ তেমন কিছু হয়নি। এসব মেয়াদোত্তীর্ণ সেতু, রেললাইন মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে যাত্রীদের।

রেলসূত্রে জানা গেছে, মূলত ব্রিটিশ আমলে তৈরি রেলপথ ও সেতু দিয়েই ১২৫ বছর পরও সচল রয়েছে দেশের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা, অধিকাংশ সেতু শুধু ইট আর চুন সুরকির তৈরি। অনেক সেতু সংস্কার করে কোনোমতে রেল যোগাযোগ চালু রাখলেও মাঝেমধ্যেই ঘটছে দুর্ঘটনা। রেলপথে প্রায় ৯০ শতাংশ সেতু-কালভার্টের আয়ুষ্কাল ১২৫ বছরের কাছাকাছি হওয়ায় ঝুঁকি নিয়েই ছুটছে ট্রেন। ফলে ঘটছে দুর্ঘটনা। রেলের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) মিয়া জাহান (চলতি মাস শেষে এল পি আরে যাবেন) জানান, দেশের প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কিলোমিটার রেলপথে ছোট-বড় সেতু রয়েছে ৩ হাজার ৩৬৭টি (২০১৪-১৫ সালের তথ্যমতে)। ব্রিজগুলোর মধ্যে ২ হাজার ৬২৯টি মাইনর (৬০ ফুটের মধ্যে) আর বাকি ৭৩৮টি ৬০ ফুটের বেশি দীর্ঘ। মূলত ১৮৯৪-১৮৯৫-১৮৯৬ সালে এসব সেতু নির্মাণ করা হয়। বিশেষ করে রেলের পূর্বাঞ্চলে যেসব রেলপথ তার আগে নাম ছিল ‘আসাম বেঙ্গল রেলপথ’। ব্রিটিশ আমলে ভারতের আসাম থেকে এসব রেলপথ এ দেশে প্রবেশ করে। রেললাইনও অধিকাংশ সেই সময়কার।

তিনি জানান, বিগত ৫ বছরে ২০১৪ সাল থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত হাজারখানেক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন দেড় শতাধিক জন এবং আহত হন ৫০০ জন। এসব দুর্ঘটনা শুধু লাইন জরাজীর্ণের কারণে হচ্ছে এমনটা নয়, মুখোমুখি সংঘর্ষ, লাইনচ্যুত ও লেভেল ক্রসিংয়েও দুর্ঘটনা ঘটছে। তবে দুর্ঘটনার হার কমছে। দুর্ঘটনা যাতে একেবারেই কমে আসে সেজন্য সব ধরনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। রেলের নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দুর্ঘটনার ১ নম্বর কারণ হচ্ছে লেভেল ক্রসিংয়ে গার্ড না থাকা, সময়মতো গেট বন্ধ না করা বা সতর্কতা সত্ত্বেও গেট পাওয়ার চেষ্টা, দুই নম্বর কারণ হচ্ছে- ঝুঁকিপূর্ণ লাইন ও সেতু।

রেলওয়ের তথ্যমতে, ২০১৪ সালে ২৪২টি দুর্ঘটনায় মারা যান ৫৮ জন এবং আহত হন ১১৯ জন। ২০১৫ সালে ১৫৩টি দুর্ঘটনায় মৃত্যু ১৩, আহত ২৫, ২০১৬ সালে ১৩১টি রেল দুর্ঘটনায় ১৩ জনের মৃত্যু এবং আহত ১২, ২০১৭ সালে ১৪০টি দুর্ঘটনায় মৃত্যু ১, আহত ৬, ২০১৮ সালে ১৫০টি দুর্ঘটনায় মৃত্যু ১৭ এবং আহত ৭১, ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত ৫২টি দুর্ঘটনায় ৯ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং আহত হয়েছেন ৬৫ জন। ২০১৪ থেকে ২০২০ সালের এ পর্যন্ত রেলের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চল মিলে মোট মৃতের সংখ্যা প্রায় দেড়শ জন। তবে অবৈধ রেলক্রসিং এবং অধিকাংশ ক্রসিংয়ে গেটম্যান না থাকায় দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানা গেছে।

রেলসূত্র জানায়, এমন অনেক ইঞ্জিন রয়েছে যার বয়সকাল শত বছর পেরিয়ে গেছে। এমন লক্কড়-ঝক্কড় বগি রয়েছে যার বয়সও প্রায় ৭০-৮০ বছর। কোনো রকম ঝালাই করে, ব্রেক তারে বেঁধে চলাচল করছে এসব ইঞ্জিন-বগি। তার ওপরে রেললাইন মেরামত ও মনিটরিং না হওয়ায় অধিকাংশ রেললাইনের দুপার্ট ধরে রাখার ফিশপ্লেট ও ক্লিপ নেই, নেই তলায় মাটি কিংবা পাথর। প্রাণ হাতে নিয়ে বছরে প্রায় আড়াই, তিন কোটি মানুষ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাতায়াত করছে এমন ঝুঁকিপূর্ণ বাহনে।

এ বিষয়ে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন জানান, বিএনপি-জামায়াত সরকার রেললাইনকে উঠিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করে চরম অবহেলা করেছে রেলওয়েকে। দীর্ঘদিন কোনো সংস্কারই হয়নি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন রেললাইন, ব্রিজ-কালভার্ট সংস্কার করার। এরই মধ্যে আমরা লাইন ও ব্রিজ সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছি। জরাজীর্ণ লাইন, মেয়াদোত্তীর্ণ সেতুর দিকেই নজর বেশি দিচ্ছি। এগুলো ছাড়া রেলের কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না। বর্তমানে লোকবল কম, আমরা আরো কর্মী নিয়োগের ব্যবস্থা নিচ্ছি।

তবে রেল বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদিও একটি স্থাপনার আয়ুষ্কাল ধরা হয় ১০০ বছর। কিন্তু এসব সেতুর আয়ুষ্কাল ১২৫ বছরেরও অধিক। ব্রিটিশ আমলের স্থাপনা বলেই এখনো টিকে আছে। বর্তমান সময়ে তৈরি হওয়ার ২০-৩০ বছর পরেই অচল হয়ে যায় যে কোনো স্থাপনা। তারা বলছেন, এখনই রেলপথে নতুন সেতু তৈরি না হলে যে কোনো সময় বড় ধরনের প্রাণহানি ঘটবে।

তথ্যমতে, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর এখন পর্যন্ত রেলওয়ের উন্নয়নে প্রায় ১ লাখ হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। তার মধ্যে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা ইঞ্জিন-কোচ বাড়ানো, ব্রডগেজ লাইন তৈরিতে খরচ করা হয়েছে। নেয়া হয়েছে পদ্মা লিংক রেল প্রকল্প, দোহাজারী-গুনদুমের মতো রেল প্রকল্প। যদিও সেই সুফল এখনো মিলছে না। তবে নতুন সেতু নির্মাণে বিশেষভাবে তেমন কোনো প্রকল্প হাতে নেয়া হয়নি। ঝুঁকিপূর্ণ সেতুতে রেল কর্তৃপক্ষ ট্রেন চালকদের স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম গতিতে ট্রেন চালানোর নির্দেশ দিয়ে থাকেন। স্বাভাবিক নিয়মে সেতুর ওপর দিয়ে ঘণ্টায় ৪৫ থেকে ৭০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চালানোর কথা থাকলেও শুধু ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় ট্রেন চালকরা ঘণ্টায় ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার গতিতে এসব সেতু পার করেন।

রেল দুর্ঘটনা নিয়ে রেলের চালক, গার্ড ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও পুরাতন রেললাইন, শতবর্ষী কালভার্ট-ব্রিজ, পুরনো বগি ও ইঞ্জিনকেই দায়ী করছেন। নামপ্রকাশ না করার শর্তে একজন ট্রেনচালক জানান, দুর্ঘটনার মূল কারণ ব্রিটিশ আমলের ইঞ্জিন, পুরাতন অকেজো বগি ও ব্রিজ। তিনি বলেন, রেললাইনে পাথর না থাকা, সিগন্যাল ব্যবস্থার ত্রুটি, লাইন ক্ষয়, স্লিপার নষ্ট, লাইন ও স্লিপার সংযোগস্থলে লোহার হুক না থাকার কারণে হরহামেশা ঘটছে দুর্ঘটনা। লক্কড়-ঝক্কড় দুটি রেললাইনের সংযোগস্থলে এক একটি স্লিপারের সঙ্গে ৮টি ক্লিপ থাকার কথা থাকলেও কোথাও ২টি, কোথায় ৩টি আবার কোনো সংযোগস্থলে ক্লিপই নেই। রেলওয়ে সেতুগুলোর আরো ভয়ানক অবস্থা রয়েছে। অনেকেই বলেছেন, ট্রেন লাইনচ্যুতের ঘটনায় চালক কিংবা গার্ড দায়ী নয়। মুখোমুখি সংঘর্ষের জন্য দায়ী মান্ধাতার আমলের সিগন্যালিং ব্যবস্থাও। তাছাড়া লোকবলের অভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা যাচ্ছে না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App