×

মুক্তচিন্তা

ভার্চুয়ালে গণমাধ্যমের অ্যাকচুয়াল সর্বনাশ

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০২০, ১০:৩২ পিএম

ক্ষুদ্রের চেয়েও ক্ষুদ্র ভাইরাস করোনা বিশাল সর্বনাশ করে ছেড়েছে তাবৎ বিশ্বের গণমাধ্যমকে। দিকপাল বিজ্ঞানী, আবিষ্কারক, চিকিৎসক, দুর্দান্ত ক্ষমতাধর রাষ্ট্রনায়করা যেখানে পরাভ‚ত সেখানে সাংবাদিকরা কোনোমতে টিকে থাকবেন বা আছেন এটাই বা কম কিসের? সাংবাদিকদের কাজ ঘটমান ঘটনার যথাতথ্য যথাসময়ে প্রচার-প্রকাশ। পারলে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য তথ্য বর্তমানে নিয়ে আসা। কিন্তু করোনা নামের এই অতিমারি সব ছারখার করে দিয়েছে। পেশার সঙ্গে গোটা গণমাধ্যমকে ফেলেছে চরম অন্ধকার-অনিশ্চয়তায়। এমনিতেই আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তিগত প্রতিযোগিতার সঙ্গে তাল সামলাতে গিয়ে প্রতিনিয়ত ঝুলে যাচ্ছে সাংবাদিকতার ভাগ্য। করোনা সেখানে যোগ করল নতুন খাঁড়ার ঘা। ছোট-বড়, সাময়িক-দীর্ঘমেয়াদি মিলিয়ে সংকট বা দুর্গতি নিয়েই গণমাধ্যমের জন্ম। যুদ্ধ-মহামারিসহ কালে কালে নানা ধরনের সংকট-দুর্যোগ মোকাবিলা করে টিকে থাকতে গণমাধ্যমকর্মীরা অনেকটা অভ্যস্ত। কিন্তু এবার অকুলান। টিকে থাকাই কঠিন। করোনার তোড়ে বিপর্যস্ত অর্থনীতির মাঝে বিচ্ছিন্ন কর্মক্ষেত্রে প্রকৃত এবং ঘটনার অন্তরালের খবর তুলে আনাই সাংবাদিকের জন্য অনেক বেশি জটিল এবং দুরূহ। তারপরই না প্রচার-প্রকাশ। করোনায় আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা কত, কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার হলো কিনা, হলে কবে হবে, টেস্টিং সেন্টার কোথায়, দেশ থেকে দেশান্তরের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎটা কেমন ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর জানতে মানুষ যখন মরিয়া, ঠিক তখনই মানুষ সৃষ্টির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুর্যোগে আক্রান্ত গণমাধ্যম দুনিয়াও। গণমাধ্যমকর্মীদের সোর্স সংকীর্ণ হয়ে গেছে। ভার্চুয়াল তথ্যের বেশিরভাগই থাকছে ভাসা-ভাসা। ক্রসচেকের সুযোগও কমে গেছে। এতে সংবাদ হয়ে যাচ্ছে একমুখী। গত মাস কয়েকে করোনার ঝাপটায় গোটা বিশ্বের পত্রিকা, টেলিভিশনসহ গণমাধ্যমগুলো কল্পনাতীত নাজুকদশায় পড়েছে। কেবল বেকার নয়, চাকরিরত গণমাধ্যমকর্মীরাও কঠিন সময়ে। গণমাধ্যমকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করলেও তাদের পেশাজীবী সংগঠন ও নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের কাছে সাংবাদিক আক্রান্ত ও মৃত্যুর কোনো অফিসিয়াল তথ্য নেই। এই নিষ্ঠুর সময়ে সাংবাদিক নির্যাতন, হয়রানি, হুমকি ও পেশাগত কাজ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হওয়ার সংখ্যাও কমেনি। বরং বেড়েছে। মামলা ছাড়াও সাংবাদিকদের টুঁটি চেপে ধরা খুব সোজা কাজ। কষে মার দেয়া কোনো বিষয় নয়। যে ইচ্ছা সেই করতে পারে এ কাজি। করছেও। এর তেমন বিচার বা বিহিত হয় না। কার্যকর প্রতিবাদও হয় না। ভালো নেই গণমাধ্যমের মালিকরাও। মাঝারি এবং ছোট অনেক পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে। যেগুলো কোনোমতে টিকে আছে সেগুলোর সার্কুলেশন কমতে কমতে তলানিতে চলে এসেছে। সরকারি বিজ্ঞাপন কমেছে। প্রাইভেট বিজ্ঞাপন নেই বললেই চলে। বিজ্ঞাপনের বকেয়া বিলের স্তূপ পড়েছে। টেলিভিশনগুলোর কোনো কোনোটির অ্যাকচুয়াল অবস্থা করুণ। তাদের আয়ের একমাত্র অবলম্বন বিজ্ঞাপনে চরম খরা। ক্ষেত্রবিশেষে টেলিভিশনগুলো পত্রিকার চেয়ে খারাপ সময় পার করছে। নাটক, টেলিফিল্ম কিছুই নেই। বিশ্বের দেশে দেশে চিত্র প্রায় এমনই। ব্রিটেনে এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে ম্যানচেস্টার টাইম, গেøাবাল রিমার্ক, ফোকাস দ্য নিউজসহ অন্তত ২০টি পত্রিকা। যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসএ টুডেসহ শতাধিক স্থানীয় পত্রিকার স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান গ্যানেট জানিয়েছে, তারা ঋণ কমাতে রিয়েল এস্টেট বিক্রি করে দিচ্ছে এবং শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ প্রদান স্থগিত করেছে। দেশটির নিউজ পোর্টালগুলোতে বিজ্ঞাপনের হার কমে গেছে ৫০ শতাংশ। করোনা পরিস্থিতির ক্রমাবনতিতে রুপার্ট মারডকের অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়া গ্রæপ নিউজ কর্পোরেশন জানিয়েছে, তাদের আঞ্চলিক ৬০টি সংবাদপত্রের ছাপা বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। ছাপা সংস্করণ বন্ধ করে অনলাইনে যাওয়ার পথে নিউ সাউথ ওয়েলস, ভিক্টোরিয়া, কুইন্সল্যান্ডের মতো পত্রিকাগুলো। অনলাইন পোর্টালগুলোর অবস্থাও গুরুচরণ। নানা সীমাবদ্ধতা-জটিলতার মধ্যেও গত দুই দশকে বাংলাদেশে গণমাধ্যমে একটা নীরব পরিবর্তন এসেছিল। বেসরকারি টেলিভিশন-রেডিওর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। এখন ৩০টি বেসরকারি টেলিভিশন চালু রয়েছে। সম্প্রচারের অপেক্ষায় আরো ১৫টি। ২৬টি বেসরকারি রেডিও চালু রয়েছে। প্রত্যেক জেলায় রয়েছে কমিউনিটি রেডিও। সরকারি বিজ্ঞাপন তালিকাভুক্ত জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকার সংখ্যা ৭০৭টি। এর মধ্যে ঢাকা থেকে প্রকাশিত ৩৬৫টি, মফস্বল থেকে প্রকাশিত ৩৪৭টি পত্রিকা সরকারি বিজ্ঞাপন পেয়ে থাকে। এর মধ্যে দৈনিক রয়েছে ৫১২টি। এগুলোতে অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে। বর্তমানে হাতেগোনা কয়েকটি পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল নিয়মিত বেতনভাতা পরিশোধ করছে। ইতোমধ্যে কয়েকটি টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্রের বিভিন্ন বিভাগে কর্মী ছাঁটাই করা হয়েছে। নিয়মিত বেতন হয় না বেশিরভাগ টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে। প্রচলিত গণমাধ্যমের ইতিহাসে তীব্রতম সংকটময় এই মুহূর্তে সরকারগুলোর নিষ্ক্রিয়তায় জায়গা করে নিচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ার মতো অপ্রচলিত ভার্চুয়াল গণমাধ্যম। যার পরিণাম হতে পারে প্রাণঘাতী ভাইরাসটির চেয়েও ভয়ঙ্কর। তারওপর সংবাদ, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা সবক্ষেত্রেই একটা পিছুটান খুব খারাপ বার্তা দিচ্ছে। করোনায় বৈশ্বিক সাংবাদিকতায় কি সব পরিবর্তন এসেছে সেগুলো খুঁজে বের করতে একটি গবেষণা শুরু করেছে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর জার্নালিস্টস-আইসিএফজে এবং কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টো সেন্টার ফর ডিজিটাল জার্নালিজম। যৌথ এ গবেষণার উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছে সাংবাদিতার ওপর করোনার প্রভাব এবং সাংবাদিকরা কীভাবে প্যানডেমিক মোকাবিলা করছেন তা খুঁজে বের করা। সাংবাদিকতার চর্চা ও ব্যবসায়িক প্রক্রিয়ার পরিবর্তন জানা। মিস বা ডিসইনফরমেশন কীভাবে ছড়াচ্ছে তা খতিয়ে দেখা। সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ঝুঁকি ও সেগুলোর প্রতিরোধ ব্যবস্থা সম্পর্কে জানা। নিঃসন্দেহে আশা করা যায়, এ গবেষণায় অনেক কিছু বেরিয়ে আসবে। সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হয়। বাংলাদেশের মতো বিশ্বের দেশে দেশে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে গিয়ে অনেক জায়গায় সাংবাদিকদের প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত হয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রের সেন্সরশিপ, প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিদের চাপ ইত্যাদির কারণে করোনা ভাইরাস সম্পর্কিত সঠিক তথ্য অনেক ক্ষেত্রেই জনগণের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। সাংবাদিক ও সংবাদ উৎসের মধ্যকার পারস্পরিক বোঝাপড়া ও মিথস্ক্রিয়ায় দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। টেলিভিশন সাংবাদিকতায় নতুন নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়েছে। ব্যক্তিগত সুরক্ষাসামগ্রীর পাশাপাশি কারিগরি ডিভাইসগুলোকেও নতুন করে অ্যাসেম্বল করতে হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। স্টুডিওতে বসে টকশো ঝুঁকিপূর্ণ। এর বিকল্পও ভার্চুয়াল। অর্থাৎ ইন্টারনেট প্রযুক্তির ওপর ভরসা। অনলাইনে সংযোগ। কিন্তু অনুষ্ঠান এতে প্রাণবন্ত হয় না। হচ্ছে না। কেবল বাংলাদেশ নয়। তথ্যের সাবলীলতার অভাবে করোনা ও করোনার চিকিৎসা নিয়ে গুজব এবং কুকথা আরো অনেক দেশেই রটেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে এসব গুজব গণমাধ্যমেও অনুপ্রবেশ করেছে। তা পাঠক-দর্শক-শ্রোতাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে গণমাধ্যমকে। আতঙ্কিত মানুষ এসব গুজবে অনেক সময় বিশ্বাসও করেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রয়োজনীয়, অপ্রয়োজনীয় তথ্যের ছড়াছড়ি। ফলে কার্যকর তথ্য অপ্রয়োজনীয় তথ্যের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে। এতে কোনটি প্রকাশ করার যোগ্য আর কোনটি নয় সেই সিদ্ধান্ত নেয়া পেশাদার সাংবাদিকদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে। সাধারণ পাঠকের কাছে নিয়মিত সংবাদ পরিবেশনেও ভাবতে হচ্ছে সাংবাদিকদের। সতর্ক থাকতে হচ্ছে সংবাদের ভেতর সংবেদনশীল শব্দ লেখার ক্ষেত্রে। মফস্বলের স্থানীয় পত্রিকা থেকে শুরু করে বিখ্যাত সংবাদমাধ্যম পর্যন্ত এই যাতনার শিকার। লকডাউনে সবকিছু স্থবির হয়ে পড়ায় পত্রিকা বিক্রি কমে গেছে, বিজ্ঞাপনের সংখ্যা আগের চেয়ে আরো কমের দিকে যাচ্ছে। এছাড়া রয়েছে আর্থিক লেনদেনজনিত সমস্যা। জনবল কমে যাওয়ায় অনুষ্ঠান ও সংবাদ সম্প্রচারে অনেক চ্যানেলকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বেকার সাংবাদিকদের সঙ্গে নতুন করে আরো অনেক বেকার যোগ হয়েছেন। যারা এখনো কোনোরকমে টিকে আছেন, তারাও আশঙ্কা করছেন শেষ পর্যন্ত তারা এ পেশায় টিকে থাকতে পারবেন কিনা। এখনো বেকার না হওয়া সাংবাদিকরাও টেনশনে। তাদের একটা সিংহভাগের অ্যাসাইনমেন্টে যাওয়ার গরজ কমে গেছে। অন্য জায়গায় কর্মরতদের কাছ থেকে চেয়েচিন্তে হাওলাতি তথ্যে অ্যাসাইনমেন্ট করেন। নিজের পরিচিত গÐির বাইরে অ্যাসাইনমেন্ট দিলে নানান বাহানা ধরেন। ওজর দেখান। অনলাইন থেকে নামিয়ে দায়সারা অ্যাসাইনমেন্ট সেরেই কেটে পড়ার চেষ্টা করোনা মৌসুমে বেশ বেড়েছে। ফলোআপ রিপোর্টে নারাজি দেন। চাপ দিলে পারলে ভার্চুয়াল কিছুতে চালিয়ে দেন। পারলে বিভিন্নজনের ফেসবুকে শেয়ার দেয়া সত্য-মিথ্যাকেও তথ্য হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছেন। বড় ভয়ঙ্কর এ তৎপরতা। যারপরনাই উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে তাদের অ্যাকচুয়াল পথে আনার দায়িত্ববান অভিজ্ঞ-দক্ষ গুণীজনও কমতে কমতে তলানিতে চলে এসেছে। মোস্তফা কামাল : সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন। [email protected]

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App