×

বিনোদন

পড়ে রইল ‘গ্যালিলিও’র ইতিহাস

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০২০, ১১:২০ এএম

পড়ে রইল ‘গ্যালিলিও’র ইতিহাস

আলী যাকের

পড়ে রইল ‘গ্যালিলিও’র ইতিহাস

বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনের অন্তপ্রাণ আলী যাকের। মঞ্চনাটকে কখনো ছিলেন দেওয়ান গাজী, কখনো ছিলেন গ্যালিলিও। অভিনয়ের প্রয়োজনে আলী যাকের মিশে গিয়েছিলেন সেইসব চরিত্রে। টিভি নাটক কিংবা চলচ্চিত্রে অভিনয় করেও তিনি বারবার ফিরে এসেছেন মঞ্চ নাটকে। মঞ্চ থেকেই শুরু হয়েছিল তার পথচলা। অবশেষে গতকাল থেমে গেল আশির দশকের সেই জ্বলন্ত শিখা। জীবনের শেষ দিনগুলোতে তার শরীরে বাসা বেঁধেছিল ক্যান্সার। এই মরণব্যাধির সঙ্গে যুদ্ধ শেষ হলেও করোনার সঙ্গে পেরে ওঠেননি তিনি। চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রয়াত হন। বর্ষীয়ান এ অভিনেতার মৃত্যুতে দেশের শোবিজ অঙ্গনে তৈরি হয়েছে বিপুল শূন্যতা। যে শূন্যস্থানজুড়ে এতদিন ছিলেন কিংবদন্তি আলী যাকের। তার পদচারণায় মুখর ছিল শুটিংস্পট কিংবা নাট্যমঞ্চ বা তার নিজস্ব অফিস কিংবা বাসা। আজ সেখানে কেবল স্মৃতি আর শূন্যতা।

ব্যক্তিজীবনে আলী যাকের কেমন ছিলেন, তা তার ঘনিষ্ঠজনরা সঠিক জানেন। কিন্তু দর্শকদের কাছে তিনি যেভাবে একজন আলী যাকের হয়ে উঠেছেন, সেই পথচলা ছিল বর্ণাঢ্যময়। মঞ্চনাটকে অভিনয় দিয়ে শুরু হয়েছিল সেই বর্ণিল যাত্রা। ‘আরণ্যক’ নাট্যদলের হয়ে ১৯৭২ সালে তিনি মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকে প্রথম অভিনয় করেন। এ নাটকের নির্দেশনায় ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ। একই বছর জুন মাসের দিকে আতাউর রহমান ও জিয়া হায়দারের আহ্বানে ‘নাগরিক’ নাট্যসম্প্রদায়ে যোগ দেন আলী যাকের। সেখানে তিনি আতাউর রহমানের নির্দেশনায় ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ নাটকে প্রথমবার অভিনয় করেন।

১৯৭৩ সালে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ে তিনি প্রথম নির্দেশনা দেন বাদল সরকারের ‘বাকি ইতিহাস’ নাটক। এ নাটক দিয়েই শুরু হয়েছিল বাংলাদেশে প্রথম দর্শনীর বিনিময়ে নাট্য প্রদর্শনী। মঞ্চ থেকে ধীরে ধীরে টিভি নাটকের দিকে চলতে শুরু করেন তিনি। কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বেশিরভাগ নাটকে আলী যাকেরের চরিত্রগুলো ছিল একবার দেখেই চোখে পড়ার মতো। যেসব চরিত্রে কাজের জন্য তিনি পেয়েছেন দর্শকদের তুমুল প্রশংসা। একই সঙ্গে হয়ে ওঠেন জনপ্রিয়। অভিনয় করেছেন চলচ্চিত্রেও। তবে মঞ্চের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল আমৃত্যু। ছিলেন নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের সভাপতি। দীর্ঘদিন সফলতার সঙ্গে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেছেন চ্যানেল আই ও বাংলাভিশনের পর্দায়। অভিনয়ের পাশাপাশি দেশীয় বিজ্ঞাপনশিল্পের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্বও ছিলেন আলী যাকের। বাংলাদেশের শীর্ষ বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিক থ্রিসিক্সটি’র কর্ণধার ছিলেন তিনি।

শিল্পকলায় অবদানের জন্য ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদকে ভূষিত করেন। পেয়েছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী পদক, নরেন বিশ্বাস পদকসহ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা। সবচেয়ে বড় বিষয় তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক। ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি। যুক্তরাজ্যের রয়্যাল ফটোগ্রাফিক সোসাইটির পূর্ণ সদস্য। বহুমাত্রিক প্রতিভাবান এই মানুষটির জন্ম চট্টগ্রামের রতনপুর ইউনিয়নে। জন্মদিন ১৯৪৪ সালের ৬ নভেম্বর।

মহীয়সী সারা যাকেরের সঙ্গে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯৭৭ সালে। এই দম্পতির দুই সন্তান, পুত্র অভিনেতা ইরেশ যাকের ও কন্যা শ্রিয়া সর্বজয়া। বিয়ে প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে আলী যাকের জানিয়েছেন, নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ের জন্য বিশ্বখ্যাত বিদেশি নাটকের বাংলা রূপান্তর আর নাটক নির্দেশনা এসব কাজে আলী যাকের ব্যস্ত ছিলেন তিনি। ১৯৭৩ সালে সেই দলে যোগ দেন সারা যাকের, যাকে শুরুতে চোখেই পড়েনি আলী যাকেরের। একটি নাটকের প্রদর্শনীর আগের দিন একজন অভিনেত্রী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে গেলে সারা যাকেরকে দেয়া হয় চরিত্রটিতে অভিনয় করতে। আলী যাকেরের ওপর দায়িত্ব পড়ে চরিত্রটার জন্য তাকে তৈরি করার এবং খুব দ্রুত চরিত্রটির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেন সারা যাকের। এই প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে যান আলী যাকের। এই ঘটনার রেশ ধরেই আলী যাকের আর সারা যাকেরের বিয়ে হয়। লেখালেখি এবং সাহিত্যচর্চার সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন আলী যাকের।

কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের খুব ভক্ত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে আলী যাকের বলেছিলেন, আমার দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ হলেন ভারত উপমহাদেশের সর্বপ্রথম আধুনিক বাঙালি; যিনি তার চিন্তা-চেতনায়, দার্শনিকতায়, ভাষায় আমাদের এই বাঙালি জাতীয়তাবাদকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছেন। তার রচনার মাঝেই আমরা বাঙালিরা জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি খুঁজে পেয়েছি। অবসরে শুনতেন রবীন্দ্রসংগীত। ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’, ‘ঐ পোহাইল তিমির রাত্রি’, ‘প্রথম আদি তব শক্তি’, ‘আমার সোনার বাংলা’ গানগুলো ছিল এ কিংবদন্তি অভিনেতার খুব প্রিয়।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App