×

সাময়িকী

কবিতাপুঞ্জের কবি

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০২০, ০৪:৫৪ পিএম

কবিতাপুঞ্জের কবি
কবিতাপুঞ্জের কবি
‘একটি মানুষ হাঁটতে হাঁটতে মুখ থুবড়ে প’ড়ে যায়, তার শরীর থেকে ফিন্কি দিয়ে রক্তের স্রোত বের হয় কীভাবে মাধ্যাকর্ষণহীন হ’তে হয় সেই কৌশল বুঝতে। ‘ক্ষয় ও ক্ষতির হাত ধ’রে’ শিরোনামের এই কবিতাটির মাধ্যমে কবি রবিউল হুসাইনের সাথে আমার পরিচয় আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে। সেই থেকে তার মৃত্যু পর্যন্ত তার সাথে আমার নিবিড় সম্পর্ক ছিল। তিনি কবিতার ক্ষেত্রে তার স্বাধীন সত্তাকে ব্যবহার করেছেন। বলা যায় অনেকটা গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে হৃদয়ঙ্গম শব্দ লেপন করেছেন কবিতার শরীরে যা বৈশিষ্ট্যগতভাবে অনেকটাই ব্যতিক্রম। যেমন- ‘সময় শূন্য নয়, বরং পরিপূর্ণ বরফে ঢাকা অতিকায় দিঘি ভেতরে অন্তর্লীন বেদনার আর্তি, নিঃস্ববোধের সাজানো বাগান ওপরে ঠাÐা বাতাসহীন ধূসর চাদর, পতাকা হ’য়ে উড়ছে দিগন্তে মৃদু অন্ধকারে অপসৃয়মাণ অপচ্ছায়া, কতিপয় বেমানান মানুষ (অদৃশ্য উদ্দেশ্যহীনতায়) কবির চিন্তা-চেতনা, শব্দচয়ন, কাব্য-ব্যঞ্জনা, উপমা-উৎপ্রেক্ষা সবকিছুতেই একটি আলাদা গন্ধ আছে। এই গন্ধ রবিউল হুসাইনের নিজস্ব গন্ধ যা অনেকেই অনুভব করতে সক্ষম নন; কিন্তু গভীরে ডুব দিলে তার প্রতিটি কবিতা যদি ঝিনুক হয়, প্রতিটি ঝিনুকেই কিছু না কিছু মুক্তো আছে। এই মুক্তো কতখানি মূল্যবান জানি না। তবে হৃদয়ে ভাবাবেগ ও অনুভ‚তির প্রশ্রয় দেয় তাতে সন্দেহ নেই। যেমন- ‘বোধের মাথায় আগুন ধরিয়ে এই মশাল উজ্জ্বলতায় ম্লান, ধ্রুবতারা খ’সে গ্যালো, মধ্যদুপুরে কৃষ্ণপক্ষের গহীন অন্ধকার মানুষের মনের মধ্যেও থাকে সারি সারি ধ্রুবতারা, নক্ষত্র, স্বাতী জ্বলে নেভে পথের ঠিকানায় নির্দেশ দ্যায় কোন্ দিকে দিগন্ত, বিচ্ছিন্নতা প্রতিবেশ নিঃশব্দ হ’লে গাছে গাছে ফুল ফোটে, মানুষ মানুষকে পায় যে-দিন বহুদিন চলে গ্যাছে সেই দিন ফিরে আসে সর্বাঙ্গীণ নগ্নতায় আকাশের পরে আকাশ, মানুষের পর মানুষ, জলের পরে সমুদ্র সবকিছু থরে থরে সাজানো, মনোভঙ্গিতে দেখে নেয় বিষণ্ণতার আলো’ (নিজস্ব আকাশগঙ্গা) খুবই সাদামাটা এবং সাধারণ কথায় কবিতা লিখেছেন রবিউল হুসাইন। কিন্তু তার এই সাধারণ কথা কখনো কখনো অসাধারণ হয়ে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ একটি কবিতা তুলে ধরছি। ‘শরীরের মধ্যে স্বপ্ন ছিল, ছিল পবিত্র মন্ত্রণালয়, তার মনের মধ্যে ছিল কাঁচা শাক-সবজি, টাটকা সবুজ, এই মাত্র জমি থেকে উঠিয়ে-আনা, তিনি ছিলেন গুপ্ত অতি, ধীরে ধীরে কথা ব’লতেন এবং জোরে জোরে হেসে উঠতেন আর চিৎকার ক’রে চুপি চুপি ব’লতেন, আজকে আসতে দেরি হবে, দরোজা সব খোলা রইবে, বাতাস ছাড়া বাড়ি হয় না তেমন, রোদ ছাড়া ঘর হয় না, এক-একটি জমিতে একটি পরিবার, নদীতে সাঁতার কাটা নিষেধ বলবৎ রইলো, তা না হ’লে সে খুব (হঠাৎ ক’রে বিছানার ওপর ব’সে) তিনি ব্যতিক্রম কবিতা লিখতেন বলেই ‘না’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। এই ‘না’ দিয়ে কত কিছু বুঝিয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। জীবন ও মৃত্যু বিষয়ক লেখাগুলো এই ‘না’ এর আওতায় পড়ে না। তবু তিনি তার ব্যক্তিগত উপলব্ধিকে প্রকাশ করেছেন সক্রিয় বৈশিষ্ট্যে। ‘জীবিতদের জীবন’ শিরোনামের একটি কবিতায় লিখেছেন- ‘কেন এই শূন্য প্রভাতে নিঃশূন্য হয় বোধ যারা প্রভাতে ভ্রমণ করে কুয়াশা কিংবা অতি ভোর আঁধারে অস্পষ্ট আলোয় দেখে মনে হয় গোরস্তান থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মরা মানুষেরা উঠে এসে এই শহরের রাস্তায় রাস্তায় আর পার্কে ভিড় জমিয়ে হাঁটাহাঁটি ক’রছে নিঃশব্দে’ মৃত্যু বিষয়ক কথা তার কবিতায় স্বয়ংক্রিয় চলে এসেছে বারবার। যেমন- ‘নীলারুণ জলে কেউ সাঁতার কাটে না’ কবিতাটি শুরু করেছেন এভাবে- ‘নিরাভরণ ছাদটি হতাশায় মোড়া নিঃস্ব দেয়ালগুলো বিমর্ষের নিষ্প্রাণ জানালা ম্লান দৃষ্টির ছিন্ন পর্দা দুঃখের পতাকা গন্তব্যহীন দরোজা বুক-ভাঙা বিদায়ের অসহায় মেঝেটি মমত্বহীন নিঃসাড় একাকী আসবাবপত্র ঘড়ি কলম জুতো পঞ্জিকা খাট পালঙ্ক চেয়ার টেবিল বিছানা বালিশ বই খাতা কালি কলম পোষাক-আসাক শাড়ি চুড়ি মশারি রেডিও গানের ক্যাসেট ছোট্ট টিভি-সব ব্যথা আর বেদনার ধূসর গন্ধে জড়ানো’ কিন্তু কবিতাটি তিনি শেষ করেছেন এভাবে- ‘প্রতিধ্বনি ফিরে ফিরে আসে দেয়ালের আস্তর থেকে বালিগুলি ঝুরঝুর পড়ে খ’সে মাঝরাতে জেগে উঠলে দুঃস্বপ্নের সঙ্গে কতো কথা হয় আকাশ-ভরা এতো নক্ষত্র-সভা আঁধারে আঁধার ডুবে রয় তবু মৃত্যুর মরণ হয় না নীলারুণ জলে কেউ সাঁতার কাটে না’ প্রাণী, প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য সবই রবিউল হুসাইনের কবিতায় ধরা দিয়েছে বাস্তবসম্মতভাবে। নীলারুণ জলে সাঁতার কাটতে কাটতে তিনি ‘গোপন গুহা মাটির অধিক’ দেখে ফেলেছেন। তিনি লিখেছেন- ‘হা-পিত্যেশ ক’রে মনকে ডাকা যায়; নিজের ভেতরে রোদ-নদী সম্পন্ন সাহসে যুদ্ধ করে জীবন ও গোপন স্বভাব, রক্তনীল পাথর অনামিকায় ধারণ ক’রে মানুষ পাগল হ’য়ে ভাবে ভবিতব্যের দৈবদৃষ্টি এইবার বৃষ্টির মমতায়; দেশে দেশে নৈশ প্রহরীর আর প্রয়োজন নেই; জাহাজের মাস্তুলে আগুনের লোহিত শিখা, জলের মধ্যে নিঃশ্বাস বাতাসের সুরে বলে, সেই-ই তার অগ্নি-পতাকা, চিরকাল জ্বল-জ্বল যতোদিন আঁধারের অস্তিত্ব অলৌকিক বিনাশে, ধ্বংশ ও সৃষ্টিতে; পাহাড়ের ওই পাড়ে কারা থাকে, কে ডাক দ্যায় প্রতিধ্বনিত ত্রুন্দনে; (প্রবন্ধ এই পাথরভূমি) রবিউল হুসাইনের কবিতা একটি বিশেষ ধরনের আলাদা ঘরানার এবং সেই ঘরানায় আরো কয়েকটি নাম যুক্ত করতে পারি। যেমন- সাইয়্যিদ আতীকুল্লাহ, সিকদার আমিনুল হক, হাবীবুল্লাহ সিরাজী প্রমুখ। এই ঘরানার কবিদের কবিতা বোদ্ধা পাঠক ঠিকই অনুধাবণ করতে পারবেন। বিষয়বন্তু এবং ভাবনায়, চিত্রকল্প এবং অনুসন্ধিৎসু উৎসে অনেক দূর এগিয়ে। ‘মানুষের তো কোনো বন্ধু হয় না’ শিরোনামে কবিতায় একটি জায়গায় রবিউল হুসাইন লিখেছেন- ‘বোবাধরা দুঃস্বপ্ন মিলে যায় দিব্যদৃশ্যে, দুর্ঘটনা ভাংচুর গাড়ি, হীরকচ‚র্ণ ইতিউতি, রাতের গহন আঁধারে স্বপ্নের বুদ্বুদি, শিবাম্বু সফেন, সাইকেলের চাকা, বসনে ঘনজলের দাগ, নদীর ভেতর শীতল এক মাছের শহর, পথে পথে খড়কুটো, রবিউল হুসাইনের অনেক কবিতা পড়ে বিস্মিত হতে হয়। কোনো কোনো কবিতা একটি গল্প। যেমন ‘দারোগার ঘোড়া’ শিরোনামে একটি দীর্ঘ কবিতার একাংশ- ‘বহুদিন আগে এক দারোগার একটা ঘোড়া ঐ বেলগাছটার গোড়ায় বাঁধা থাকতো। একদিন প্রচণ্ড রোদ আর খরার ভেতর অনেকক্ষণ ভীষণ দ্রুত ঘোড়া চালিয়ে দারোগা সাহেব সন্ধ্যাবেলার দিকে ঘোড়া বেঁধে রেখে বাড়ি চ’লে গেলেন। সেদিন ছিল অমাবস্যার রাত। পূর্বেই উল্লেখ করেছি রবিউল হুসাইনের কবিতা ব্যতিক্রম। তার আর একটি প্রমাণ ‘শুয়োরের সৌন্দর্য’ শিরোনামে কবিতাটি। কবি এখানে একটি শুয়োরের কি এমন সৌন্দর্য খুঁজে পেলেন যা অভাবনীয়, অতুলনীয়! বাস্তবভিত্তিক এই কবিতাটির শেষাংশে তিনি বলেছেন, ‘আকুল আর্তি, আহা, আমি যদি কোনোরকমে একটি খাঁটি শুয়োরের বাচ্চা হ’তে পারতাম!’ রবিউল হুসাইনকে কোনো ভাষা দিয়ে ব্যাখ্যা করে কবি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়ার দরকার হয় না। তার কবিতা পড়লেই তার সম্পর্কে জানা হয়ে যায়। ‘নিশ্চয়ই মানুষেরা খুব ভালো স্বভাবে আচরণে তা না হ’লে আকাশে কেন এত মেঘ জমে, প্রকৃতির পরিবারবর্গ কেন এত ব্যস্তসমস্ত, মাটিতে শস্য ফলে, ফুল ফোটে, জল গড়ায় আর বাতাস কেন ব’য়ে যায় হু হু ক’রে তাদের জন্যে নিশ্চয়ই মানুষেরা খুব সুন্দর মনেপ্রাণে, (কোথায় আমার নভোযান) ‘দারুণ এই অন্তিম সময়’ শিরোনামে তিনি লিখেছেন- ‘এই বাঁচার বিবর্তন খুব হৃদয়গ্রাহী বটে অস্পষ্ট অধীর জন্ম রূপান্তরটুকু জানি ভ্রুণের ভেতর কতিপয় জিয়ল মাছ মাটি ধেয়ে যায় সবুজ ডিমের নিকট কৃতজ্ঞ স্রোতে বাইরে কী উচ্ছল উচ্ছ¡াস লজ্জার খোয়াই মূর্তহীন সময় ভাঙে ঝরে মৃগনাভির কাছে নতুন শেকড় পেয়ে মাটি খুব তৃপ্ত ও সমৃদ্ধ একটি বিষণ্ণ সাপ খোলস বদলায় প্রকাশ্যে মরা পিঁপড়ের গায়ে পুরনো শিশির শরীর একটুখানি আলোর সঙ্গে জ্বলে আর নেভে’ ‘ওই পাড়ে তুর্কীদের ভুতুড়ে শহর, এই পাড়ে নিয়ন-কৃষ্টি-মোড়া নীলোম্বল শহর ও সাগর। আমাদের জিজ্ঞাসার মানুষ কতোদূর পেছনে প’ড়ে আছে উত্তরের সফল কোলাহল থেকে কোথাও তৃপ্তি নেই জন্মভ‚মি, কেউ কি জেনেছে কত কাছে থমকে আছে মানুষের প্রখর প্রাপ্তি’ (মধ্যাহ্ন ভ্রমণ) ‘কথা ছিল নিরীক্ষর আকুতি প্রকাশিত হবে প্রতিবাদহীন উপক্রমনিকায়, আশাতুর এই বিশ্বাসে মাটির স্পর্শ খায় খয়েস রোদ্দুর, জানা যায় সবুজাভ বৃষ্টিপাতে বৃক্ষকুল স্নাত হলে তামাটে রং-এর এইসব দুঃখী মানুষ খুব সুখী হয়ে থাকে।’ (শব্দের ব্যায়াম) এমনই সব কবিতার কবি রবিউল হুসাইন। তিনিই কেবল লিখতে পারেন, ‘কেউ নত, কেউ উন্নত’ কবিতা। তিনিই কেবল লিখতে পেরেছেন ‘নৈঃশব্দের ইতিহাস’। এতক্ষণ কবির ‘কবিতাপুঞ্জ’ বইটির কিছু কবিতা নিয়ে অল্পবিস্তর আলোচনা করা হলো। কবিতাপুঞ্জ গ্রন্থটি ২০০১ সালে প্রকাশিত হয়েছে আগামী প্রকাশনী থেকে। ভ‚মিকায় তিনি লিখেছেন, ‘আমার বই প্রকাশের অনাগ্রহ সবসময়, মূলত মনো-আলস্যের কারণে, কী হবে, কিছুই তো রইবে না ত্রিভুবনে- এইরূপ বিপরীত দর্শনে আমি খুব বিশ্বাসী।’ তারপরও তার ২৫টির অধিক গ্রন্থ রয়েছে। কবি রবিউল হুসাইনের প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- সুন্দরী ফণা, কোথায় আমার নভোযান, কেন্দ্রধ্বনিতে বেজে ওঠে, কী আছে এই অন্ধকারের গভীরে, আরও ঊনতিরিশটি চাঁদ, কর্পূরের ডানাঅলা বরফের পাখি, আমগ্ন কাটাকুটি খেলা, স্বপ্নের সাহসী মানুষেরা, যে নদী রাত্রির, এইসব নীল অপমান, কবিতাপুঞ্জ, নির্বাচিত কবিতা প্রভৃতি। লিখেছেন শিশুসাহিত্য, স্থাপত্য, অনুবাদ ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে। শিল্প সমালোচক হিসেবেও তিনি সবার দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছেন। আমার অতি প্রিয় এবং কাছের মানুষ রবিউল হুসাইন জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৩ সালের ৩১ জানুয়ারি, ঝিনাইদহ জেলার রতিডাঙ্গায়। কবি ও স্থপতি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App